সকল মেনু

শুভ জন্মাষ্টমী আজ :মর্তে মহাবতারের আবির্ভাব

 আছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: ‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত। অভ্যূত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।’ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, জ্ঞানযোগ ৭/৮)

অর্থাৎ হে ভরত, যখন পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখনই আমি অবতীর্ণ হই। অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় স্বয়ং ভগবান তার আবির্ভাব সম্পর্কে এ কথা বলেছেন।

আজ শুভ জন্মাষ্টমী। পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি। বিশ্বব্যাপী শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই এ তিথির তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দিবসটি উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বিরা নানা আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে আছে গীতাপাঠ, কীর্ত্তন, প্রসাদ বিতরণ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বড় আয়োজনে আছে জস্মাষ্টমীর মিছিল। ঢাকায় মিছিলটি বের হবে স্বামীবাগ ইসকন মন্দির থেকে।

ইসকন ভক্ত স্বামীজী নিত্যানন্দ বলেন, সনাতন ধর্মের একমাত্র পূর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, অর্থাৎ আজকের এই দিনে আবির্ভূত হয়েছিলেন মাটির এই পৃথিবীতে। তার আর্বিভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয়। দ্বাপর যুগে অশুভ শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতা গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অশুভ শক্তিকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভশক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে।

নিত্যানন্দ বলেন, ভারতবর্ষে তখন ঘোর অমানিশার কাল। রাজ্যলোভে তখন রাজন্যবর্গের মধ্যে রক্তপাত নিত্য ঘটনা। সমাজে যখন অনাচার, অধর্ম, অসততা ছড়িয়ে পড়েছে ঠিক তখন একজন অবতারের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ জন্য প্রয়োজন হয় কিছু ঘটনার। সেই ঘটনার মধ্যে দিয়েই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। তার জন্মবৃত্তান্তের পটভূমি সংক্ষেপে অনেকটা এ রকম : মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস। তার অন্যায় শোষণে মথুরাবাসী অতিষ্ঠ। ক্ষমতালোভী কংস এতটাই অত্যাচারী ছিলেন যে, মথুরার সিংহাসন দখল করার জন্য পিতা উগ্রসেনকেও বন্দী করতে পিছপা হননি। এ ঘটনায় অনেকেই কংসের বিপক্ষে অবস্থান নেন। চতুর কংস বিপদ বুঝতে পেরে বিদ্রোহীদের, বিশেষ করে যাদবদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে সচেষ্ট হন। তিনি যাদবকূলের শুর সেনের পুত্র, বিশ্বস্ত বন্ধু বসুদেবের সাথে বোন দেবকীর বিয়ে দেন।

কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হঠাৎ কংস দৈববাণী শুনতে পান- ‘তোমার এই বোনের অষ্টম সন্তানই হবে তোমার মৃত্যুর কারণ।’ মৃত্যু আশঙ্কায় ভীত হয়ে কংস দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। তখন বসুদেব অনেক অনুনয় করে কংসের হাত থেকে নব পরিণীতা বধূকে উদ্ধার করেন এই বলে যে, তাদের সন্তান হলে তিনি অবশ্যই সেই সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেবেন। এ কথায় কংস শান্ত হন বটে কিন্তু পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারেন না। তিনি বোন এবং ভগ্নিপতীকে কারাগারে আটকে রাখেন।

সেই কারাগারে দেবকীর একে একে সাতটি সন্তান হয়। প্রতিটি নবজাতককে কংস নির্দয়ভাবে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এভাবে কংসের নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার রাজ্যের আরো অনেকেই হয়েছিলেন। এরপর দেবকী অষ্টমবারের মতো সন্তানসম্ভবা হলে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো কঠোর করা হয়। অন্যদিকে সাতটি সন্তান হারিয়ে শোকে কাতর কারারুদ্ধ দেবকী-বসুদেব দম্পতি। তারা কংসের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের সেই যুগসন্ধিক্ষণে তারা শুরু করেন বিষ্ণুর বন্দনা। দেবতা বিষ্ণু ভক্তের ডাকে সাড়া দেন। ফলে কংসের অত্যাচারে মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে এবং অরাজক দিনের অবসান ঘটাতে ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথির কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাতে চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত করে আর্বিভূত হন শ্রীকৃষ্ণ।

নবজাতক শিশুর হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম দেখে বসুদেব বুঝতে পারেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন দেবকীর গর্ভে সেই অন্ধকার কারাকক্ষে। বসুদেব সেই রাতেই বিষ্ণুর আশীষে নবজাতককে কংসের চোখ এড়িয়ে গোকুলে যশোদার ঘরে রেখে আসেন। ভগবানের অসীম লীলায় যশোদার ঘরে তখন সদ্যভূমিষ্ঠা এক কন্যাসন্তান। বসুদেব সেই কন্যাকে এনে কারাগারে রেখে দেন। এই কন্যাসন্তান কিন্তু আর কেউ নন, তিনিই ভগবানের অন্তরঙ্গ শক্তি যোগমায়া।

রাতের অন্ধকারে কারাগারে কী ঘটল যোগমায়ার প্রভাবে আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলায় কংস কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিন্তু পরদিন সকালে যখন বুঝলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি কারাগারে এসে সেই কন্যাসন্তানকে হত্যার উদ্যোগ নিতেই দৈববাণী শুনতে পেলেন- ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’

ওদিকে মাতা যশোদার কোলে বড় হতে থাকে শ্রীকৃষ্ণ। এর মাঝে কংস নানাভাবে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সব চক্রান্তই ব্যর্থ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মথুরায় মল্লক্রীড়ার আয়োজন করা হয়। এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় কৃষ্ণ এবং ভাই বলরামকে। এখানেই কংস কৌশলে কৃষ্ণ বধের আয়োজন করেন। কিন্তু অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। হতভম্ব কংস উপস্থিত নিজ রাজন্যবর্গ, সেনাদল ও সহচরসহ সবাইকে তার পক্ষে অস্ত্রধারণ করতে বলেন। কিন্তু কেউই সেই আবেদনে সাড়া দেন না। তখন নিরুপায় কংস অস্ত্র নিয়ে নিজেই শ্রীকৃষ্ণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবশেষে কৃষ্ণের লৌহ মুষ্ঠির আঘাতে কংস ভূপাতিত হন। সমাপ্তি ঘটে সকল অন্যায়, অত্যাচারের।

সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র মতে, যুগে যুগে বিপথগামী মানুষদের সত্য পথে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং অপশক্তিকে ধ্বংস করে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান বিভিন্নরূপে এ পৃথিবীতে অবতরণ করেন। ভগবানের এই অবতরণের জন্যই তিনি ‘অবতার’ বলে পরিচিত হন। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কেবলমাত্র অবতার বলে অভিহিত করেননি। শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ, প্রেম, অনাসক্তি এবং অন্যান্য দিব্যগুণে ভূষিত কৃষ্ণকে `কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং` বলে চিহ্নিত করেছেন।

সকল অবতারের সারটুকু দিয়ে তৈরি তিনি, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজনীন নেতা। জগতের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত তার প্রাণ। আর এ কারণেই সকল সময়ে সর্বত্র তার স্তব হয়। তিনি জগৎশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলেই যুগে যুগে উচ্চরিত হবে তার নাম। ‘কৃষ্’ মানে সত্তা আর ‘ণ্ এর অর্থ হলো আনন্দ। এই দুই মিলিয়েই তিনি কৃষ্ণ। সেই পরমপুরুষ মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পৃথিবী থেকে দূর হোক সকল অসত্য, অন্যায়, অধর্ম। সাধুদের পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ ঘটিয়ে পৃথিবীতে সত্য, ধর্ম আর ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই প্রত্যাশা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top