সকল মেনু

মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন

 এম শাহজাহান আহমদ, মৌলভীবাজার: দেশের অন্যতম রপ্তানীমূখী চা শিল্পের সাথে জড়িত ৭ লক্ষাধিক শ্রমিকদের দাবী দাওয়া আদায়ের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১০ আগষ্ট। দীর্ঘ ৬ বছর পর নির্বাচনকে ঘিরে মৌলভীবাজার জেলার ছোট বড় মিলিয়ে ১৩৫টি চাবাগানসহ দেশের ২২৮টি চা বাগানে বিরাজ করছে উৎসবমূখর পরিবেশ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিজেদের পক্ষে ভোট আদায়ে প্রচার প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পাড় করছেন দুটি প্যানেলে বিভক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী প্রার্থীরা। তিন ধরনের ব্যালটের মাধ্যমে মোট ৯৪ হাজার ৫৮৩ জন চা শ্রমিক ভোটারের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন পঞ্চায়েত কার্যকরী কমিটি, ভ্যালী কার্যকরী কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি।
প্রকৃতির সবুজ চাদরে মোড়ানো সারি সারি চা বাগান তার মাঝখানে পরিশ্রমী ঘামে ভেজা শ্রমিকদের দু‘হাতে পাতা তোলার শৈল্পিক দৃশ্য- যে কারো জন্যে মনোমুগ্ধকর হলেও সাধারন শ্রমিকদের দুঃখ দুদর্শা ও অভিযোগের শেষ নেই। বছরের পর বছর ধরে বেতন বৈষম্যসহ বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে চা শ্রমিকরা আন্দোলন সংগ্রাম করলেও নির্বাচিত কমিটি না থাকায় তাদের দাবীগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে দীর্ঘ ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির নির্বাচন। সর্বশেষ ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে বিবাদমান দুটি অংশের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণে ২০১৩ সালের মে মাসে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয় ‘লেবার হাউসে‘ তালা ঝুলিয়ে দিয়ে সংগঠনটির সার্বিক দায়িত্ব গ্রহন করে শ্রম মন্ত্রনালয়। এর পর থেকে অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছিল লেবার হাউস।
এদিকে চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এক লাখ চা শ্রমিকসহ তাদের ৭ লাখ শ্রমিক পরিবারের দাবী বাগানে নিয়মিত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী ২০০ টাকা বৃদ্ধি, রেশন বৃদ্ধি, বছরে ২০ দিন ছুটি উপভোগ এবং উৎসব ভাতা বাড়ানোসহ ১৮ দফা দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বাগানে বাগানে সাধারন শ্রমিকদের নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচার প্রচারণা। অপরদিকে নিজেদের পক্ষে ভোট আদায়ে চা শ্রমিক গণঐক্য পরিষদের নেতারা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে গিয়ে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
নানা ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়া বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উভয় পক্ষের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে চা শ্রমিকদের ইউনিয়নের একাংশের নেতা মাখন লাল কর্মকার সভাপতি ও রাম ভজন কৈরী সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর নির্বাচিত কমিটিকে লেবার হাউস থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাচনে পরাজিত সভাপতি প্রার্থী বিজয় বুনার্জীকে আহ্বায়ক করে একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। তার পর থেকে লেবার হাউসের কর্মকান্ডে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
এদিকে এবারের নির্বাচনেও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক পদে শ্রমিক ইউনিয়নের দুটি প্যানেল অংশ নিচ্ছে। চা শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে সভাপতি পদে মাখন লাল কর্মকার ও সাধারন সম্পাদক পদে রাম ভজন কৈরী এবং চা শ্রমিক গণ্যঐক্য পরিষদের ব্যানারে সভাপতি পদে বিজয় বুনার্জী ও সাধারন সম্পাদক পদে সীতারাম অলমিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়াও ২২৮টি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটি এবং ৭টি ভ্যালীর কার্যকরী কমিটির নির্বাচনেও আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন উভয় প্যানেলের নেতৃবৃন্দরা। দু‘দলের নেতৃবৃন্দ জয়ের ব্যাপারে আশাবাদি।
দীর্ঘ ৬ বছর পর নির্বাচনকে ঘিরে চা শ্রমিকদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দিপনা। মৌলভীবাজার জেলার ছোট বড় মিলিয়ে ১৩৫টি চা বাগানের ৫৮ হাজার ৩৩৬ জন ভোটার ছাড়াও সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলার ২২৮টি চা বাগানের প্রায় লক্ষাধিক ভোটারদের মাঝে চলছে জল্পনা কল্পনা। কে হচ্ছেন তাদের নির্বাচিত নেতা। প্রতিদিনই শ্রীমঙ্গল থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা ছুটে যাচ্ছেন এসব জেলায় অবস্থিত চা বাগানের ভোটারদের কাছে। তাদের হাতে বিলি করা হচ্ছে লিফলেট পোষ্টার। বাগানের হাট বাজারগুলোতে ঝুলছে প্রার্থীদের ছবি ও মার্কা সম্বলিত পোষ্টার। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে সাধারন চা শ্রমিকদের দাবী তারা চান প্রকৃত শ্রমের মর্যাদা ও মজুরীবৃদ্ধসহ তাদের ১৮ দফা দাবীর বাস্তবায়ন। এসব দাবী দাওয়া পূরণে যারা ভূমিকা রাখবেন তাদেরকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে চান প্রায় লক্ষাধিক চা শ্রমিক ভোটার।
মৌলভীবাজার চা শিল্প শ্রম কল্যাণ বিভাগের উপ-শ্রম পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের জন্য ৫টি জেলার আওতাধীন মোট ২০টি উপজেলার সম্পৃক্ততা থাকায় এসব উপজেলার নির্বাহী অফিসারগণ সহকারি রির্টানিং অফিসারের দ্বায়িত্ব পালন করবেন এবং ৫টি জেলার ৫ জন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজেষ্ট্রিট রিটানিং অফিসারের দ্বায়িত্ব পালন করবেন। আর এসব কিছুর মনিটরিং করবেন শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে ইতোমধ্যে আইনশৃংখলাসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামী ১০ আগষ্ট ১২৮টি চা বাগানে একযোগে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে ভোট গ্রহন অনুষ্ঠিত হবে।
চা শ্রমিকরা মনে করেন, বর্তমানে চা শিল্প একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এক সময়ে দেশ থেকে বিশ্ববাজারে রপ্তানীমূখী এই শিল্পের অবস্থান অনেকটাই কমে এসেছে। তবে সাধারন শ্রমিক, ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এখনও আশা করেন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী প্যানেল তাদের দাবী দাওয়া আদায়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করলে এবং সরকার তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের চায়ের সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top