সকল মেনু

রোগব্যাধি রবীন্দ্রনাথের

 অাছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম: নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে গর্ববোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখা বিভিন্ন চিঠিতে এর সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু শৈশবে তিনি যে সকল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, ওষুধ খেয়েছেন; এমনকি এ কারণে হাওয়া বদল করেছেন সেসব কথা তিনি কোথাও উল্লেখ করেন নি। তবে রবীন্দ্রজীবনীতে উল্লেখ আছে, বাল্য ও কৈশোরের নীরোগ স্বাস্থ্য নিয়ে কবি এতবার এত জায়গায় গর্ব প্রকাশ করেছেন যে, তার সঙ্গে অনেক তথ্য মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। সে সময়ের জমিদারির ক্যাশবুক থেকে অবশ্য তার চিকিৎসার কিছুটা খবর জানা যায়। যদিও আমরা সেখান থেকে রোগের নাম জানতে পারি না। কারণ সেখানে রোগের নাম উল্লেখ নেই।

১৮৭৬ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পনের। এর আগের বছর কবি মাতৃহারা হন। তিনি শিলাইদহ আসেন। সে সময় কলকাতা থেকে ডাকযোগে তার কাছে ওষুধ পাঠানো হয়। ক্যাশবুক থেকে আরো জানা যায়, ভাদ্র মাসে ব্রজেন্দ্রনাথ রায় (রবীন্দ্রনাথের মামা) এবং রবিবাবুর চিকিৎসার ওষুধ ও দ্বারকানাথ রায় কবিরাজকে রবিবাবুর চিকিৎসার জন্য ঘিয়ের  দাম দেয়া হয়েছিল। তখন একটি খল (ওষুধ পেষণের পাত্র বিশেষ) কেনা হয় কবির চিকিৎসার জন্য।
আশ্বিন এবং কার্তিক মাসেও যে এই চিকিৎসা চলছিল সে বিষয়টিও ক্যাশবুকে লেখা খরচ থেকে জানা যায়। সেখানে রবি ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য কবিরাজের যাতায়াত খরচ লেখা আছে। এরপর অগ্রহায়ণ মাসের খরচ হিসেবে ক্যাশবুকে যা লেখা রয়েছে, তা পাঠ করে শিউরে উঠতে হয়! সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, রবি বাবুর জন্য বিয়ার ক্রয়ের অর্থের উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ফাল্গুন এবং চৈত্র মাসের হিসাব থেকে সোডাওয়াটার, লেমনেড বরফ এবং হোমিওপ্যাথি ওষুধ ক্রয়ের কথাও জানা যায়। তবে সে সময় যে কবির জন্য অসংখ্য পরিমাণে বিয়ার কেনা হয়েছিল এটা জানা গেলেও সেগুলো কী উদ্দেশে কেনা হয়েছিল তা লেখা নেই। তবে ধারণা করা হয়, ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই বিয়ার কেনা হয়েছিল। সে কালে বিয়ার স্নায়ুবিক রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কবিরাজি ওষুধ ও ঘি একই কারণে ব্যবহৃত হতে পারে।

ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের মস্তিষ্ক বিকৃতি ছিল। তার দাদা বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথও এই রোগে আক্রান্ত হন। তার ভ্রাতুস্পুত্র কৃতীন্দ্রনাথও সাময়িকভাবে এ রোগের শিকার হয়েছিলেন। পারিবারিক চিকিৎসক ডা. কেলি ও বাঙালি চিকিৎসক ডা. নীলমাধব হালদার তাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। ১৮৭৯ সালের মার্চে সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বায়ু রোগে আক্রান্ত হন। কবিরাজ রসিক লাল গুপ্ত তার চিকিৎসা করেন। শিলাইদহ থেকে সোমেন্দ্রকে কলকাতা নিয়ে আসা হয়। অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে এপ্রিলে। তবে বীরেন্দ্রনাথের মতো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে নি। ফলে তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাবার দরকার হয় নি। সুধীন্দ্রনাথ লিখেছেন : সোমকাকা আজীবন বায়ু রোগে কষ্ট পাইয়াছেন। … কুকুরকে কোলে তুলিয়া লইয়া তাহার মুখ চুম্বন করিতেন। সকলের আহারের উচ্ছিষ্টর জন্য লালায়িত হইতেন। এমন কি মেথরকে পর্যন্ত ঘরে আনিয়া তাহার পালঙ্কে বসাইতেন। ১৮৭৯ সালে হাইকোর্ট থেকে সোমেন্দ্রনাথকে অপ্রকৃতস্থ ঘোষণা করা হয়।

একবার রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়িতে খবর এলো তিনি অসুস্থ। তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, কলকাতা থেকে ডাক্তার পাঠাতে হয়েছিল তাকে নিয়ে আসার জন্য। কবি কলকাতা ফিরে শচীন্দ্র মজুমদারকে লেখেন : আমি প্রায় একমাস কাল দার্জিলিংয়ে কাটিয়ে এলুম। … আমার কোমরে বাত হয়ে কিছুকাল শয্যাগত হয়ে পড়েছিলুম, এখনো ভালো করে সারে নি। তবে এখন বিছানা থেকে উঠে বসেছি। কিন্তু বেশিক্ষণ চৌকিতে বসে থাকতে পারিনে। পা টন টন করে। আমার কোমর ছাড়া পৃথিবীতে  আর সমস্ত মঙ্গল। আমার স্ত্রী, কন্যা, দার্জিলিংয়ে আমি কলকাতায় ঘরে বসে বিরহ ভোগ করছি। কিন্তু বিরহের চেয়ে কোমরের বাতটা বেশি গুরুতর বোধ হচ্ছে। কবিরা যাই বলুন, আমি এবার টের পেয়েছি বাতের কাছে বিরহ লাগে না।

১৯০৩ সালের ১৭ মার্চ কবি হাজারিবাগ গিয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন। সে সময় তিনি এক চিঠিতে লেখেন : এখানে এসে জ্বরে পড়েচি। যত শীঘ্র পারি ঝেড়ে ওঠবার চেষ্টায় আছি। কিন্তু আপাতত অনেকগুলো লেপ-কম্বল আমাকে বিছানার সঙ্গে বেধে রেখেছে।
কয়েক দিন পর ২৮ মার্চ লেখেন : এখানে আসিয়া কাশি ও দুর্বলতা যায় নাই। কাশি আছে। আজ মীরা পড়িয়াছে। নগেন্দ্রর স্ত্রী জ্বরে পড়িয়াছিল। পিসিমার শরীর অসুস্থ। চাকরদের অনেকেই শয্যাগত। মেয়ে রেণুকার প্রত্যহ ১০২ জ্বর আসিতেছে। কোন দিকেই আশাজনক কিছু দেখি না। … আমার মনটা পালাই পালাই করিতেছে।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কবি শিলাইদহে আসেন। এখান থেকে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখেন : কিছুদিন অজ্ঞাতবাসের জন্য মনটা উৎসুক আছে তাই সমস্ত কর্মের জাল কাটিয়া পদ্মায় ভাসিয়া পড়িয়াছি।
পরের দিন তিনি বিজয়চন্দ্র মজুমদারকে লেখেন : আবার আমি পলাতক। সম্প্রতি আমি পদ্মা নদীর উপর বোটে বিশ্রাম এবং স্বাস্থ্যের প্রত্যাশায় আসিয়াছি।
সেই একই বছর ৮ অক্টোবর এক চিঠিতে কবি লেখেন : আমি বিশ্রাম করিতেছি। বেশি কিছু কাজ নাই, ভিতরে স্টীম বন্ধ করিয়া দিয়াছি। কলম আর চলিতেছে না। এক ঘণ্টা ছেলেদের পড়াই তারপরে পড়ি, চুপচাপ করিয়া থাকি, গল্প স্বল্পও করি। এ রকম করিয়া কাটিয়া যায়। কিন্তু শরীরটাকে এখনো ভাটার লাইনের উপরে টানিয়ে তুলিতে পারি নাই। তাই ঠিক করিয়াছি স্কুল খুলিলে পর মাসখানেক বিদ্যালয়ের সমস্ত বন্দোবস্ত পাকা করিয়া দিয়া অগ্রহায়ণের আরম্ভে একবার পদ্মার হস্তে আমার শুশ্রূষার ভার অর্পণ করিব।

১৯১১ সালের মার্চে কবি শিলাইদহ থেকে প্রিয়ম্বদা দেবীকে লেখেন : …জাহাজে ওঠবার মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেই দিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল।
পরের বছর এপ্রিলে কবি শান্তি নিকেতনে অসুস্থতার কারণে ‘রাজারানী’তে অভিনয় করতে পারেন নি। ১৯১২ সালের ১৬ অক্টোবর কবি ইংল্যান্ড থেকে অজিত কুমারকে লেখেন :  অর্শের রক্তপাতটা কিছুদিন থেকে বেড়েছে। অ্যালোপ্যাথদের মতে এ রোগে অস্ত্রাঘাত ছাড়া অন্য পন্থা নেই। তাহলে আমাকে অন্তত একমাস হাসপাতালে শয্যাগত হয়ে পড়ে থাকতে হবে। সেটা আমার ভাল লাগছে না। তাই ঠিক করেছি আপাতত কিছুদিন আমেরিকায় গিয়ে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করাব। তাতে যদি ফল না পাই তখন অস্ত্র চিকিৎসা করলেই হবে।

১৯১৪ সালের জুনে কবি বিদেশে নার্সিং হোমে থেকেছেন। তখন তার বয়স ৫৩ বছর। এর কারণ অর্শ। ৩১ পাউন্ড ১০ শিলিং খরচ করে তিনি সেখানে অপারেশন করিয়েছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীর লেখায় পাওয়া যায়; তিনি লিখেছেন : অর্শ আমার বাপের বাড়ির বংশগত রোগ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই হাওয়া বদল করতে গঙ্গার ধারে অবস্থিত একটি বাগানে যেতেন। শ্রীরামপুরের কাছে চাপদানিতে ঠাকুর বাড়ির একটি নিজস্ব বাগান ছিল। জ্যোতিরিন্দ্র বিভিন্ন সময় সস্ত্রীক সেই বাগানে অবস্থান করেছেন। প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথকেও তিনি সঙ্গে নিয়েছেন। অর্থাৎ দাদার সঙ্গে কবি বিভিন্ন স্থানে হাওয়া বদলে গিয়েছেন। বাবার সঙ্গে গিয়েছেন হিমালয়ে। এ অবশ্য কবির ছেলেবেলার কথা। বয়সজনিত কারণেও কবি বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন।

১৯২৯ এর ২১ এপ্রিল সুধীন্দ্রনাথ বরাবর এক পত্রে কবি লেখেন : আমার শরীরটাকে সত্তর বৎসরে নির্মমভাবে ব্যবহার করেচি অন্তত দুটো জন্মের মতো কাজ এক জন্মে আদায় করা গেছে। সুতরাং আজ যদি তার চাকা আলগা হয়ে থাকে নালিশ চলবে না। কিন্তু তোমার তরুণ দেহ যদি বে মজবুৎ হয়ে পড়ে তাহলে নিতান্তই ঠকা হবে।
১৯৩৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি সেই একই জনের কাছে লেখেন : আমার শরীরটা আজকাল প্রায়ই হরতাল করতে উদ্যত হয় মনটাও তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে। একদিন বিনা নোটিসে হঠাৎ কল বন্ধ করে দিয়ে বসবে। … বয়সটা আমার শরীর মনের উপর কী রকম বোঝা হয়ে চেপেছে।
১৯৩৭ এর ১০ সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চেতনা হারান। এ খবর প্রকাশিত হলে দেশ এবং বিদেশের নানা স্থান থেকে অনেক উদ্বিগ্ন গুণগ্রাহীর পত্র এবং তারবার্তা আসতে থাকে। যদিও এ যাত্রায় কবি দুদিন সম্পূর্ণ অচৈতন্য থেকে এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top