সকল মেনু

নীরব ঘাতক

 আফিফা জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম:অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তিনি। এরই মধ্যে ল্যান্ড ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখেছেন। মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রাখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়। রাজনীতির দীর্ঘ এই চল্লিশ বছরের জীবনে জেল হাজতের মতো ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। কিন্তু এমন নাজেহাল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে দলের মধ্যেই তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। ভীষণ এক বিব্রতকর অবস্থার ভিতর দিয়ে সময় পার করতে হচ্ছে আহমেদ সাহেবকে। অথচ সাধুবাদ তার প্রাপ্য ছিল। গত সপ্তাহে এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে হঠাৎ করেই তিনি খাদ্যে ফরমালিনের প্রসঙ্গটা তোলেন। কথা প্রসঙ্গেই কথাটা বলা। ফরমালিন, কীটনাশক, ভেজাল এই সব নানা কথা বলতে বলতে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে তিনি দেশবাসীকে বিষমুক্ত খাবারের প্রতিশ্রুতি দেন। জনসভায় হাততালি পড়ে। আহমেদ সাহেব ভীষণ শিহরিত হন। এবং এক পর্যায়ে ফরমালিনকে নীরব ঘাতক আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি।

তিনি বলতে দেরি করেছেন কিন্তু তার দপ্তর কাজ শুরু করতে দেরি করেনি। ঘটা করে শুরু হয় দেশব্যাপী ফরমালিনের বিরুদ্ধে অভিযান। মানুষ এই পদক্ষেপ সাদরে গ্রহণ করে। যারা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। দেশজুড়ে বেশ সাড়া পড়ে যায়। বড় বড় শহরের প্রবেশ পথে খাদ্য বা ফলে ফরমালিন শনাক্তের জন্য চেক পোস্ট বসানো হয়। পরীক্ষায় ফরমালিন শনাক্ত হলেই সেগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে সোজা ট্রাকের চাকায় পিষে নষ্ট করে ফেলা হয়। টিভি চ্যানেলগুলো এসব দৃশ্য ফলাও করে দেখাতে থাকে। জনগণ টেলিভিশনে সেই দৃশ্য দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। রিপোর্টারদের কেউ কেউ আরেক কাঠি সরেস। তাদের আরো গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চাই। তারা ফরমালিনের উৎস সন্ধানে ক্যামেরা, বুম হাতে ছুটে যায় উত্তরাঞ্চলের আম বাগানগুলোতে। টিভি চ্যানেলগুলো সেগুলো লাইভ দেখাতে থাকে।

ফরমালিন সাফল্যে সরকার নড়েচড়ে বসে। অনেকে এক কাঠি এগিয়ে বিভিন্ন সমাবেশে বলতে শুরু করে- আমরা সুবিধার রাজনীতি করি না। সরকার জনগণের সুস্থ, সুন্দর জীবনের লক্ষ্যে বিষযুক্ত খাদ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জনগণের সুরক্ষায় সরকার বদ্ধ পরিকর।
দলের মধ্যে থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসায় আহমেদ সাহেব খুশি হন। তিনি অবশ্য এখন প্রতিদিন দেশের সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন সমাজ সেবা সংঘের বাহবা পাচ্ছেন। অনেকে যখন ফোন করে এমন একটা যুগান্তকারী ঘটনার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান তখন গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। ফোন রেখে অফিসের জনালা দিয়ে আষাঢ়ের ঐ কালো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আহমেদ সাহেব আত্মতৃপ্তিতে ভেসে যান। তিনি ধরেই নেন, তার দীর্ঘ এই রাজনৈতিক জীবনে এটাই সেরা সাফল্য। এত বাহবা তিনি এই জীবনে আর কখনো পাননি।

ওদিকে বিরোধীরাও বসে থাকে না। দেশের উত্তর প্রান্তে যেখানে আমের চাষ হয় সেখানে এক জনসভায় তাদের একজন বলে, দেশের আম চাষীদের আজ পথে বসিয়ে দিয়েছে সরকার। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। এই অগণতান্ত্রিক সরকার গরিব আম চাষীদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এই সরকার ফরমালিনের কথা বলে মাছ, ফল, সবজি নষ্ট করছে। এতে দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আমরাও চাই দেশের মানুষ বিষমুক্ত নির্ভেজাল খাবার খাক। কিন্তু এভাবে গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা আমরা বরদাস্ত করব না। তাই আমরা ফরমালিন বন্ধের নামে এই ধরনের হয়রানির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

এই প্রথম ব্যবসায়ীরা তাদের বক্তব্য খুঁজে পায়। তারা পরদিনই দেশের বড় বড় শহরে ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ী সমিতির ব্যানারে এই অভিযানের নামে হয়রানি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করে। এটুকু করেই তারা ক্ষান্ত হয় না। প্রতিবাদস্বরূপ তারা দেশব্যাপী ধর্মঘটেরও ডাক দেয়। পুলিশের বিরুদ্ধে তারা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগও তোলে। ঘুষ না পেয়েই নাকি পুলিশ ট্রাক ভর্তি আমে ফরমালিন পাওয়া গেছে-এমন অভিযোগ করে।
এতদিন চুপ করে থাকা আমচাষীরাও এবার সরব হতে শুরু করে। তাদের দাবি, তারা আমে ফরমালিন দেন না। ফরমালিন দেয় আড়ৎদার। সুতরাং কর্তৃপক্ষের উচিত আড়ৎদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।

তাদের এই বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে এলে দেশের মানুষ স্পষ্টতই দুই ভাগ হয়ে যায়। অসহায় ক্ষুদ্র আম চাষীদের পক্ষ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলার মানুষের অভাব হয় না। এই ঘটনা আহমেদ সাহেবকে চিন্তায় ফেলে দেয়। শুরুতে এই কাজ করতে গিয়ে তার মনে যে গর্ব দানা বেঁধেছিল তা অনেকটা আলগা হতে শুরু করে। সেখানে দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। কারণ ভাবমূর্তি বলে একটা কথা আছে। জনগণ সমর্থিত এমন একটা ভালো কাজকে কিছু লোক শুধুমাত্র কয়েকটা নীতিবাক্য দিয়ে তাদের অনুকূলে নিয়ে যাচ্ছে। আহমেদ সাহেব করণীয় বুঝে উঠতে পরেন না। যে কোন মূল্যে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হবে-ওপর থেকে এমন একটি কথা তার কাছে এসেছে। উর্ধ্বতনদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। আহমেদ সাহেবকে গত রাতে সিনিয়র একজন ফোনে কটু কথা শুনিয়েছেন। এতে অবশ্য তিনি মন খারাপ করেননি। কেননা তার হাত ধরেই তিনি এত দূর এসেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আহমেদ সাহেব যে তার সঙ্গে একমত নন, এ কথাটি তিনি বলতে পারেন নি। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আছেন বলে তিনি যে খাদ্য নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না-এ কেমন কথা! অথচ এই যুক্তিটিও তিনি বড় ভাইকে ফোনে বলতে পারেন নি। আহমেদ সাহেব ফোনে শুধু বারবার একই কথা বলে গেছেন- জি ভাই, হ্যাঁ ভাই, আপনে ঠিকই বলছেন। আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেন ভাই।

সেই ফোন পাওয়ার পর থেকেই আহমেদ সাহেবের মনে নতুন শঙ্কা দানা বাঁধে। দলীয় সভায় তাকে জবাবদিহি করতে হতে পারে। পরদিন হয়ও তাই। সভায় উত্তরাঞ্চলের একজন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলেন, আপনি জানেন, আমার এলাকায় চাষীরা এ মৌসুমে কত কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন? আপনি এমন একটা বিষয় আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কীভাবে করলেন? এখন এটা একটা সেনসেটিভ ইস্যু!

আহমেদ সাহেব মাথা নিচু করে সব শুনলেন। তার মনে পড়ল কিছুদিন আগে উত্তরাঞ্চলের অনেকের কথা; যারা তাকে এই ইস্যুতে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। তারপর রাতভর তিনি চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে এই ইস্যুটিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়।

পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবরটি জানা গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছেন, ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্রটা সঠিক নয়। তাছাড়া ফরমালিন মাপার পদ্ধতিটাও ভুল।
আহমেদ সাহেব টিভি অফ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় শরীর এলিয়ে দিলেন। আজ রাতে তার ভোলো ঘুম হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top