সকল মেনু

উত্তরের রেলওয়ে শহর সৈয়দপুরে দেখার অনেক কিছু আছে

 মো. আমিরুজ্জামান, সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা: উত্তরের বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুর। নীলফামারী জেলার এ উপজেলা শহরটি বাঙালি- বিহারীর এক বৈচিত্রময় শহর। স্বাধীনতার পর থেকেই এই শহরে প্রচার-প্রচারণায় বাংলার পাশাপাশি উর্দুতে চলে। এই নীলফামারী-৪ আসনের সংসদ নির্বাচন ও পৌরসভার নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে অবাঙালি ভোটারদের ওপর। প্রচলিত প্রবাদ আছে রঙের রংপুর শখের সৈয়দপুর। এক সময়কার সিটি শহর সৈয়দপুরে রয়েছে অনেক দর্শনীয় ও বৃটিশ আমলের তৈরি বেশ কিছু অবকাঠামো। যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। ক্ষণিকের জন্য হলেও পথিক অতীত হাতরাতে থাকেন। এখানে রয়েছে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা, বিমানবন্দর, সেনানিবাস, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এসপি অফিস, রেলওয়ের বিভাগীয় হাসপাতাল, ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ, দর্শনীয় গির্জা, মুর্তজা ইন্সটিটিউট, বিশ্বের অন্যতম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, হরেক রকম কুটির শিল্প, টায়ার জ্বালিয়ে জ্বালানি তেল তৈরি, জুট মিল, বেনারসি পল্লী, বৃটিশ আমলে নির্মিত টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস, সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক শতবছরের পুরাতন শিল্প সাহিত্য সংসদ অন্যতম। কথায় আছে জাতীয় সংসদের এমপি হওয়াটা যতটা সহজ তার চেয়ে কঠিন এর সদস্য হওয়া। এখানে আসলে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পাশে স্বচক্ষে দেখতে পাবেন বাস-ট্রাক-এর পরিত্যক্ত টায়ার জ্বালিয়ে জ্বালানি তেল তৈরি, এর একপাশে তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের নোয়া প্রেসার কুকার, ননস্টিক প্যান, ওভেন ও অন্যান্য তৈজষপত্র। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করা হচ্ছে। সেই সাথে এখানকার তৈরি পরচুলা বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে।

রেলওয়ে কারখানা ঃ
দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা এখানে অবস্থিত । ১৮৭০ সালে ১শ’ ১০ একর জমির উপর বৃটিশ আমলে নির্মিত এ কারখানার ২৪টি শপে শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। নাট- বল্টু থেকে শুরু করে রেলওয়ের ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতসহ সকল কাজ করা হয়। পলিটেকনিক ও কারিগরী শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা সফর বা পরিদর্শন করে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেন। এই কারখানার প্রধান হলেন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায় (ডিএস) নূর আহম্মদ হোসেন। তারই অফিসের সামনে সবুজ চত্বরে রাখা আছে বৃটিশ আমলের ন্যারোগেজ ইঞ্জিন। রেলগাড়ির ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম- ছড়ার এই ইঞ্জিন আজ অতীত। ৭২ সালে সর্বশেষ ইঞ্জিনটি চলতো বাগেরহাট- রুপসা সেকশনে। ১৯০১ সালে ইংল্যান্ডের ভলকান কোম্পানির তৈরি এ্ই ইঞ্জিনটিসহ এ ধরণের ৩টি ইঞ্জনের ঠাঁই হয়েছে এখন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার লোকো ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে। কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ইঞ্জিনগুলো। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে নতুন প্রজম্মের অনেকে আসে স্বচোখে দেখতে একনজর এই কয়লার ইঞ্জিন। এই কারখানায় প্রবেশ ও ছবি তুলতে গেলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।

চিনি মসজিদ ঃ
সৈয়দপুর শহরের গোলাহাটে শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটির নির্মাণ কারুকাজ ও মনোরম সৌন্দর্য্য দেখে ইসলাম ধর্ম অনুসারী মানুষের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এসময় এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। এলাকার বাসিন্দা হাজী বকর আলী ও হাজী ময়খু মহল্লাবাসীকে ডেকে ৬ জন সর্দার নির্বাচন করে প্রতিঘর থেকে দৈনিক এক মুঠো চাল সংগ্রহ করার নির্দেশ দিলেন। সংগৃহিত চাল বিক্রি করে জমাকৃত টাকা দিয়ে এক সময় মসজিদটি দালানে পরিণত হয়। মসজিদটি নির্মাণ করেন শইখ নামের হিন্দু মিস্ত্রী। সেসময় কোন সিমেন্ট ছিল না। তাই চুন ও সুড়কি দিয়ে গাঁথুনি দেওয়া হয়। মহল্লার মহিলাগণ ঢেঁকি কুটে সুড়কি তৈরি করতেন। মহল্লার কিছু লোক কোলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে দেখলেন চীনা কোম্পানির চিনামাটির তৈরি পেটের টুকরা পড়ে আছে। কোম্পানির অনুমতি সাপেক্ষে তারা সেগুলো নিয়ে আসেন এবং ওই মিস্ত্রীর সহায়তায় মসজিদের দেওয়ালে লাগান। মসজিদের প্রথম ভাগটির মেঝেতে লাগানো মরমর পাথর কোলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এখানে এসে পাথরগুলো বসিয়ে যান। মসজিদেও দেওয়ালে লাগানো চিনামাটির টুকরার প্রতি খেয়াল রেখে এর নামকরণ করা হয় চিনি মসজিদ। চিনি মসজিদের গোটা অবয়ব উজ্জ্বল রঙিন চীনা পাথর দ্বারা আবৃত। অত্যন্ত নয়নাভিরাম এ মসজিদে ৩২টি মিনার ও ৫টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের দোতলায় রয়েছে একটি কক্ষ। সেখানে বাইরে থেকে আগত পর্যটকদেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সৈয়দপুরের চিনি মসজিদটি এক নজর দেখতে বহু দেশি- বিদেশি পর্যটক ঘুরে গেছেন।

দর্শনীয় গির্জা ঃ
উত্তরের ব্যবসা- বাণিজ্য কেন্দ্র সৈয়দপুর শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল বৃটিশ কোম্পানি শাসনামলে। সেসময়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সৈয়দপুর ছিল একটি ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। রেলওয়ে কারখানা স্থাপনে বৃটিশরা বিবেচনায় নিয়েছিল এর অবস্থান, জলবায়ূ ও পরিবেশগত অবস্থান। এ কারখানায় বাঙালি- বিহারীর সাথে কাজ করত বহু বৃটিশসহ এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টান। এদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় বেশ কটি আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স ক্লাব অন্যতম। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য বৃটিশ সরকার সাহেবপাড়ার দু’প্রান্তে দুটি গির্জা নির্মাণ করে। এর একটি ছিল রোমান ক্যাথলিক ও অপরটি প্রোটেষ্টান্ট সম্প্রদায়ের। এ গির্জা দুটি উত্তরাঞ্চলের সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম গির্জা। এর নির্মাণ শৈলী রোমান ও ইউরোপীয় স্থাপত্য কলায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রেলওয়ে কারখানা গেট সংলগ্ন গির্জাটি কুমারী মরিয়মের নামে উৎসর্গ করা হয়। এই সাহেবরা আজ নেই। কিন্ত তাদেও গড়া ধর্মপল্লী, দর্শনীয় গির্জা ও সেন্ট জোরোজা নামে একটি স্কুল। যেখানে সুনামের সাথে লেখাপড়া করছে ছেলে- মেয়েরা।

মুর্তজা ইন্সটিটিউট ঃ
সৈয়দ বংশীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও ধর্মপ্রচারকের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে সৈয়দপুর। বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানায় কর্মকর্তারা সেসময় বেশির ভাগই ছিলেন বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয়ান দেশের। কুলি- মজুরসহ নিম্ন শ্রেনীর পদে কর্মরত ছিল অবিভক্ত ভারতীয়রা। রেলওয়ে কারখানা ছাড়াও ভারতের দার্জিলং, জলপাইগুঁড়ি, হলদিবাড়ি, শিলিগুঁড়ি এবং দেশের খুলনা পর্যন্ত সরাসরি চলাচলরত বিদেশি সাহেব ও তাদের পরিবার- পরিজন নিয়ে চিত্তবিনোদনের জন্য ১৮৭০ সালেই নির্মাণ করে ‘দি ইউরোপিয়ান ক্লাব’। কারখানার কাজ শেষে প্রতিদিন সমবেত হতেন এ ক্লাবে। পরিবার- পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত আনন্দ, ফুর্তি, নাচ-গান করে ক্লান্তি দুর করতো। এক সময় এ ক্লাবে ভারতীয়দের সদস্যপদ ও পদচারণা ছিল নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে নিয়ম- কানুন শিথীল করায় ভারতীয়রা সদস্যপদ লাভের সুযোগ পায়। পরবর্তীতে দি ইউরোপিয়ান ক্লাব নাম পরিবর্তন করে বিআরসিং ক্লাব করা হয়। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর ইন্সটিটউটের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারী ও তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় মুর্তজা ইন্সটিটিউট। সৈয়দপুরে অনুষ্ঠিত যে কোন অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক আয়োজন, নাট্য সংগঠনের নাটক, যাত্রাপালা ওই ইন্সটিটিউটে মঞ্চস্থ হয়। এই মুর্তজা ্ইন্সটিটিউটের পাশে রয়েছে রেলের শহীদদের নামে স্মৃতি ফলক ও শিশু পার্ক।

বেনারসি ও কারুপন্য ঃ
সৈয়দপুরে রয়েছে সম্ভাবনাময় বেনারসি শিল্প। শহরের গোলাহাট, কাজীহাট, হাতিখানাসহ বেশ কিছু এলাকায় গড়ে ওঠেছে বেনারসি শিল্প। সেখানে কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে বেনারসি শাড়ি। মনকড়া ডিজাইনের এসব বেনারসি তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকার বড় শপিং মলসহ মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে। এ কাজে কারিগররা রং, সুতা ও বিপননে জড়িয়ে পড়েছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। যারা এ বেনারসি তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভর হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। আপনিও প্রয়োজন মনে করলে রং ও ডিজাইন মোতাবেক ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় এসব বেনারসি শাড়ি তৈরি করে নিতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও বড় বড় শপিং মলে স্থানীয় মহিলাদের নকশা ও ডিজাইন করা আনকমন থ্রী পিস, সালোয়ার- কামিজ, শার্ট, ফতোয়া, বিছানার চাদর, কুশন কভার, শাড়ি, শাল প্রভৃত মিলছে। এসব স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে কোলকাতার বাজার ধরেছে। শহরের গোলাহাটে এমসিসি (ম্যানোনাইট সেট্রারেল কমিটি) এ্যাকশন ব্যাগ হ্যান্ডি ক্রাফট বছরে কোটি টাকার পাট পণ্য রপ্তানি করছে। চিনি মসজিদ এলাকায় অবস্থিত এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। এদের তৈরি পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে অতি আকর্ষণীয় এবং এর ব্যাপক চাহিদা। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানী, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া পভৃতি দেশে এসব রপ্তানি করা হয়। পাটের তৈরি এসব বিভিন্ন ব্যাগ নানা ডিজাইনের হয়ে থাকে। এগুলো হলো লন্ড্রী ব্যাগ, টয় (খেলনা) ব্যাগ, গেম ব্যাগ, সোলজার ব্যাগ, শপিং ব্যাগ প্রভৃতি। সৈয়দপুরের আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ২২টি ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পের বাইরে কারচুপি ও পুঁথির কাজ সংসার চলছে অনেক পরিবারের সংসার চলছে, চাহিদামত সরবরাহ করা হচ্ছে সবখানে।

বিমানবন্দর ও সেনানিবাস ঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা স্থানীয় বাঙালিদের আটকিয়ে নির্যাতন করে সৈয়দপুর বিমাবন্দরের মাটি ভরাটসহ প্রাথমিক কাজ করে নেয়। পরবর্তীতে সরকার এটির অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে বিমান চলাচলের উপযোগি করে তোলে। প্রথম অবস্থায় বাংলাদেশ বিমান চলাচল করলেও বন্ধ যায় এবং বর্তমানে বেসরকারি বিমান সপ্তাহে সাতদিন চলাচল করছে। বিমানবন্দরটি দেখার জন্য প্রতিদিন লোকজন আসেন। এর পাশেই রয়েছে সৈয়দপুর সেনানিবাস, ইএমই সেন্টার এন্ড স্কুল, সম্মলিত সামরিক হাসপাতাল। এখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত। এই সড়কে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব, প্রতিবছর বোর্ডের মেধা তালিকায় অবস্থানকারী সরকারি কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ, বেশ কিছু রেলওয়ে অফিসারদের সদৃশ্য বাংলো, সরকারি ডাকবাংলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top