সকল মেনু

অস্থির মহানগর বিএনপি : কার্যালয়ে ভাঙচুর

 রেজা পারভেজ : ‘ব্যর্থতার’ অভিযোগ তুলে ঢাকা মহানগরীর পুরোনো কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করেছে বিএনপি। প্রত্যাশা সংগঠনকে শক্তিশালী করে আন্দোলনের উপযোগী করে তোলা। নতুন কমিটি ঘিরে বিএনপি এমন প্রত্যাশার বীজ বুনলেও কাক্সিক্ষত ফল ঘরে উঠানো নিয়ে সংশয় রয়েছে নেতাকর্মীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রত্যয় থাকলেও কমিটি গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন কমিটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চরম স্নায়ুযুদ্ধে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। আব্বাস-খোকার সেই পুরোনো দ্বন্দ্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কমিটির সদস্য সচিবকে মেনে না নেওয়ার বিষয়টি। দায়িত্বশীলরা বিষয়টি অস্বীকার করলেও দিন দিন বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারন করায় দুটি পক্ষ এখন মুখোমুখি। ঢাকা মহানগরের কমিটি গঠনের পর দলের অভ্যন্তরীণ এ বিভাজনের খবর ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে সৌদি আরবে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কাছে। এ নিয়ে ভীষন রকম ক্ষুদ্ধ তারেক রহমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্যসচিব করে শুক্রবার ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষনা করা হয়।

দলীয় সূত্র জানায়, ঘোষনার পরই কমিটি নিয়ে নাখোশ হন বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস। ঢাকা মহানগর বিএনপিকে শক্তিশালী করতে তিনি চেয়েছিলেন তার ইচ্ছা অনুযায়ী ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হোক। যেখানে তার পছন্দের নেতার প্রাধান্য থাকবে এবং সদস্য সচিব হিসেবে কোনো পদ থাকবে না। দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে এ বিষয়ে তার প্রত্যাশার কথা জানালে সেই অনুযায়ী কমিটি করার প্রতিশ্রুতি আসে। কিন্তু দলের সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ৫২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষনা করা হয়। আর তাতে ঢুকে যায় খোকার অনুসারীরা। মূলত এরপরই বিরূপ আচরণ করেন মির্জা আব্বাস। কমিটি গঠনের পর সাংবাদিকদের ডেকেও কথা বলেননি, দেখা দেননি দলের নেতা-কর্মীদেরও। এমনকি সদস্য সচিব ছাড়াই তার সার্কেলের লোক নিয়ে নিজ বাসায় বৈঠক করেন তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও বেরোয়।

তবে বিভাজনের এসব বিষয় উড়িয়ে দেন মির্জা আব্বাস। ঢাকা মহানগর বিএনপিতে কোনো ‘বিভাজন’ নেই দাবি করে আগামী দিনে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

বুধবার দুপুরে নতুন কমিটির প্রথম বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘খোকা কিংবা আমার তৈরি কোনো গ্রুপ নেই। গ্রুপিংয়ের বিষয়টি কিছু মানুষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই দলের একটাই গ্রুপ, তা হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার গ্রুপ।’ নতুন কমিটির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী সোহেলের সঙ্গে আহ্বায়কের ‘বিরোধ’ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মির্জা আব্বাস হেসে ফেলেন। এরপর মাইক সোহেলের কাছে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সোহল ভাল বলতে পারবে।’

হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, ‘মির্জা আব্বাস ভাই আমার বড় ভাই। আমি ছোট ভাই। আমরা ভাই-ভাই। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নাই।’

তবে ‘বিভাজন’ নেই বলে মহানগর আহ্বায়কের এই বক্তব্যের ১২ ঘন্টার মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্য রূপ নেয়। বিশেষ  করে সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে মেনে না নেওয়ার বিষয়টি আরো প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বুধবার রাত আড়াইটার দিকে মহানগর বিএনপির অফিস ভাসানী ভবনের দোতালায় সদস্য সচিবের জন্য নির্ধারিত কক্ষটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় আব্বাস সর্মথকরা। এ সময় সদস্য সচিবের নামফলকটি ফেলে দিয়ে সেখানে পল্টন থানা বিএনপির ফলক লাগিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় তারা। খবর পেয়ে সোহেল সমর্থকরা এসে তালা ভেঙে আবারো পল্টন থানার ফলকটি নামিয়ে দেন। ভোরের দিকে আব্বাস সমর্থকরা আবারো একই কাজ করেন। পল্টন থানার নাম টাঙিয়ে দিয়ে নতুন করে দরজা তালাবন্ধ করে রাখে। বিষয়টি সোহেল সমর্থকরা জানার পরে সেখানে যেতে চাইলে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল তাদের নিষেধ করেন। এ অবস্থায় দুটি পক্ষের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। বিশেষ করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা বিষয়টি ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেনা।

বৃহস্পতিবার মহানগর অফিসে গিয়ে দেখা গেছে আহ্বায়কের দরজার ওপরে মির্জা আব্বাসের নাম থাকলেও সদস্য সচিবের দরজার সামনে নেই হাবিব-উন-নবী খান সোহলের নাম। সেখানে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে পল্টন থানা বিএনপির একটি ফলক। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দপ্তরের দায়িত্বে থাকা কর্মচারিরা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি।

তবে সূত্র জানায়, মহানগর বিএনপিতে সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার একটি বড়, নিবেদিত এবং অনেক বেশি শক্তিশালী একটি সমর্থক রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই সাবেক কাউন্সিলর। নতুন কমিটি ঘোষনার পর সাদেক হোসেন খোকার ওই অনুসারীরা মির্জা আব্বাসকে মেনে নিতে পারেননি। তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তে আসেন। সোহেলও তাদের স্বাগত জানান। এ নিয়েও দারুন ক্ষুদ্ধ হন মির্জা আব্বাস।

এদিকে নতুন কমিটি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়ও সোহেলকে অনেকটা একপেশে করে রাখেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে মীর সরাফত আলী সপুর সঙ্গে মৃদু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও করেছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। জিয়াউর রহমানের সমাধিতে নেতাকর্মীরা যখন নতুন আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের অপেক্ষা করছিলেন, সেই মুহূর্তে আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে নিয়ে সমাধিস্থলে আসেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে মাঝে রেখে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের দুপাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে বিরক্ত প্রকাশ করেন নতুন কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি নিজে মহাসচিবের পাশে দাড়াতে চান। এ নিয়ে পেছনে দাড়িয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু সদস্যসচিবকে মহাসচিবের পাশেই দাড়াতে বলেন। তিনি বলেন, ‘নতুন কমিটির দুই নেতা মহাসচিবের দু’পাশে থাকুক।’ এতে সপুর ওপর তেতে ওঠেন গয়েশ্বর। মির্জা আলমগীর তাকে থামানোর চেষ্টা করেন। তখন মির্জা আব্বাস সপুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এই সপু চুপ।’ এ নিয়ে সমাধিস্থলে আসা নেতাকর্মীরা গয়েশ্বর চন্দ্রের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের যুক্তি নতুন কমিটির দুই নেতা মহাসচিবের পাশে থাকবেন এটিই নিয়ম। কিন্তু স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েও এই সাধারণ বিষয়টিও মেনে নিতে পারেননি গয়েশ্বর। তাহলে দলের জন্য বৃহৎ স্বার্থ ত্যাগ করবেন কিভাবে, প্রশ্ন করেন তারা।

দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের পর থেকে হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের ব্যাপারে মির্জা আব্বাস এবং অন্য নেতাদের আচরণের সারসংক্ষেপ বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের মাধ্যমে ইতিমধ্যে পৌছে গেছে সৌদি আরবে অবস্থানরত দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে। দক্ষ সংগঠক হিসেবে হাবিব-উন-নবী খান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দু’জনের কাছেই অনেক জনপ্রিয়। মির্জা আব্বাসকেও পছন্দ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে সোহেলের সঙ্গে মির্জা আব্বাসের এমন ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ তারেক রহমান। খালেদা জিয়া দেশে আসার পরে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেবেন বলে জানায় সূত্রটি।

বৃৃহস্পতিবার জিয়াউর রহমানের সমাধিতে পুস্পস্তাবক অর্পন শেষে সদস্য সচিবের সঙ্গে আহ্বায়কের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্পর্কে মির্জা আব্বাসকে প্রশ্ন করা হলে সাংবাদিকদের প্রতি তিনি বিরক্ত হন। তিনি বলেন, ‘আমাকে রাজনৈতিক প্রশ্ন করবেন। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার মতো কিছু বলবেননা। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইনা।’

তবে মহানগর বিএনপির বিভাজনের বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে দলের ভারপ্রাপ্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দল হিসেবে বিএনপি অনেক বড় একটি সংগঠন। সেজন্য দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতেই পারে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব সমস্যা থাকবে না। প্রাথমিকভাবে কোনো কমিটি করা হলে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। আর ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে ছোটখাট কিছু ঘটতেই পারে। বিএনপি কমিটি দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তো কমিটি দেওয়ার সাহসই করেনি।’

তিনি বলেন, ‘এদিক-ওদিক একটু সমস্যা থাকলেও তা কেটে যাবে। এগুলো সাময়িক সমস্যা।’

ভবিষ্যত সরকার বিরোধী আন্দোলনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের নতুন কমিটির নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top