সকল মেনু

বেঁধেছি আমার প্রাণ

 শানজানা জামান: ভেবে অবাক হলো নওরিন। আট বছর হতে চলেছে। কখনো এভাবে উপলব্ধি করেনি বিষয়টি। এ কারণে অবাক হওয়া। বিষয়টিকে মগজে ঘুরপাক খাওয়াতে থাকল নওরিন। ঘুরপাক খেতে খেতে বিষয়টি যে তার মগজে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, তা বেশ বুঝতে পারছে সে। এর আগে কখনো নওরিনের চিন্তায় এটা হাজির হয়নি, এমন নয়। তবে তা উপলব্ধির পর্যায়ে পৌঁছেনি। আজ যখন হলো, তখন প্রবলভাবে হলো। তাই বিমর্ষতা জড়াল তাকে। খানিকটা বিষণ্নতাও। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খালিদ যখন নওরিনের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিনেমার নায়কের মতো রোমান্টিক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মন খারাপ কেন?’ নওরিন তখন বেশ বুঝতে পারল- মগজে ঘুরপাক খাওয়া বিষয়টি তাকে কাবু করেছে! সঙ্গে সঙ্গে  সে এর প্রতিকারের তাগিদ অনুভব করল। কিন্তু এই অনুভবের তীব্রতা আগে ছিল না! খালিদের চোখ এড়াতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করল নওরিন। এ কারণে অফিস ফেরত ক্লান্ত স্বামীকে চা-নাস্তা খাইয়ে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ খুনসুটিতে মেতে উঠল। স্বামীর প্রতি ভীষণ মমত্ব অনুভব করল আজ। খুনসুটিতে তাই বিচ্ছিন্ন রোমান্টিকতার উঁকিঝুঁকি। কিন্তু ঘুমাতে এসে সেই বিপত্তি। স্বামী যখন তার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ঘুমের আশ্রয় নিল, তখনই ভাবনাগুলো জড়িয়ে ধরল নওরিনকে। অন্ধকার ঘরে ভাবনাগুলোর সে কী বাড়াবাড়ি! একদণ্ড নিস্তার নেই নওরিনের। সে জানে, আজ আর ঘুম আসবে না তার। তাই ভাবনাগুলোকে নিবিড় আশ্রয় দিল। ভাবতে ভাবতে নওরিনের মনে হলো- এত ভাবনার কিছু নেই। এর প্রতিকার খুব সহজ। কনসিভ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাহলে মনের কাছে এভাবে পর্যুদস্ত হতে হবে না। পরক্ষণেই তার মনে হলো- মন তাকে খুব সহজে মুক্তি দেবে না। অনুশোচনায় বেঁধে রাখবে। তাই বলে তাকে তো বসে থাকলে চলবে না। তাতে অনুশোচনার বাঁধন আরো পোক্ত হবে। এলোমেলো ভাবনাগুলো নওরিনকে ক্লান্ত করে তুলল। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

দুই
সকালে ঘুম থেকে জেগে টয়লেট-বাথ সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নওরিনের ঘুম ভাঙাল খালিদ। প্রতিদিন নওরিন তার ঘুম ভাঙায়, আজ সে।
চোখ মেলতেই নওরিন দেখল- খালিদ একেবারে তৈরি হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে।
মুচকি হেসে খালিদ বলল, ‘আমি অফিসে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ করে এসে তুমি আবার ঘুমাও।’
ঘুমের জড়তা নিয়ে খালিদের পেছনে পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে বেডরুমে এসে শুয়ে পড়ল নওরিন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে নিজেকে ঘুমের কোলে সমর্পণের চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম উধাও।
ঘুমের জড়তা কাটতেই নাস্তা না খেয়ে খালিদের অফিসে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ভাবল নওরিন। মুহূর্তে মন খারাপ হয়ে গেল তার। স্বামীর জন্য খুব মায়া হলো।

নওরিন শতভাগ চেষ্টা করে স্বামীকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দিতে। এ কারণে যত রাতেই ঘুমাতে যাক, সকাল বেলা সময়মতো ঘুম ভাঙে তার। এভাবে ঘুম ভাঙে বলে মাঝেমাঝে অবাক হয় নওরিন। ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখতে হয় না। প্রতিদিন সঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যায়। নিয়মিত এমনটি কী করে সম্ভব!
হঠাৎ কখনো হয়তো এদিক-সেদিক হয়। তাছাড়া নওরিনের শরীর খারাপ থাকলে খালিদই তাকে সকাল সকাল বিছানা ছাড়তে দেয় না। বলে, ‘তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। আমি বাইরে নাস্তা সেরে নেব।’
কিন্তু আজ এমন হলো কেন?

রাতের কথা মনে পড়ল নওরিনের। কী কারণে বিষণ্ন ছিল সে, রাতে কেন ঘুমাতে দেরি হয়েছে- একে একে সব মনে পড়ল। একইসঙ্গে গতরাতে খুঁজে পাওয়া প্রতিকারও। আর প্রতিকারের কথা মনে পড়তেই হঠাৎ চমকে উঠল- কাল রাতে কন্ট্রাসেপটিভ পিল মিস করেছে সে!
ব্যাপারটি নিশ্চিত হতে স্মৃতি ঘাটতে শুরু করল নওরিন। তারপর পিলের পাতা ঘেটে দেখল। ঠিক, কাল রাতে পিল মিস করেছে সে। তার ওপর কাল রাতে খালিদকেও নিবিড়ভাবে পেয়েছে।
ভেবে অবাক হয় নওরিন, এমন তো হয়নি কখনো। যত কিছুই হোক, পিল খাওয়া মিস হয় না তার। তাহলে কাল রাতে বেমালুম ভুলে গেল কেমন করে?

তিন
সাংসারিক কাজে পূর্ণ মনোযোগী নওরিন সব কাজের ভিড়ে গত রাতে পিল মিস করার কথা ভুলল না। মিস করা পিলের কথা মনে পড়তেই এর বিকল্প সমাধানও মনে পড়ল তার। একসঙ্গে দুটো পিল খেয়ে নিলেই হয়; অথচ নওরিন তাতে গা করল না। সে বরং নতুন একটা রেসিপি নিয়ে বেশ খাটাখাটি করে যাচ্ছে। রেসিপি নতুন হলেও তার রান্না খালিদের পছন্দ হবে, এতে কোনোরকম সন্দেহ নেই।

খালিদের কথা মনে উঁকি দিতেই গতকালের সেই বিমর্ষতা পুনরায় আচ্ছন্ন করল নওরিনকে। আর সকালে খালিদের জন্য যে মমত্বটুকু অনুভব করেছিল, এখন তার মাত্রা দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে বাড়তেই থাকল।
রেসিপির লবণ চাখতে গিয়ে নওরিন উপলব্ধি করল- এই মুহূর্তে রান্নায় তার মনোযোগ নেই! তার মন কেড়ে নিয়েছে বিমর্ষতা। আর বিমর্ষতার বয়স যত বাড়ছে, অনুশোচনাও তার সঙ্গে জোট পাকাচ্ছে।
রান্না শেষে গোসল করতে গেল নওরিন। শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে বেশ ভালো লাগল তার। শাওয়ারের জলে ভিজতে ভিজতে তার বিমর্ষতা কেটে যেত যদি! অনুশোচনা না হয় থাকুক, কেননা এটুকু তার প্রাপ্য!
গোসলের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হলো নওরিন। তখনই রাতের কথা মনে পড়ল। খালিদকে নিবিড়ভাবে কাছে পাওয়ার কথা মনে পড়ল! পিল মিস করার কথা মনে পড়ল!
পিলের কথা মনে পড়লেও নওরিন কোনো তাড়া অনুভব করল না। আগে কখনো পিল মিস হলে বুক কেঁপে উঠেছে। যত দ্রুত সম্ভব পিল খেয়ে নিয়েছে। অথচ আজ…।

চার
বাসায় ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল খালিদের।
দেরিতে ফেরার কারণ শুনেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল নওরিন। খালিদের দেরিতে ফেরার কারণই যে নওরিনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে এত সহজ করে দেবে, তা ভেবে অবাক হলো সে। বেশ মজাও পেল।
খালিদ যখন বলছিল, কলিগের মেয়ের জন্মদিন। এক রকম জোর করেই নিয়ে গেল। অন্য কোনো উপলক্ষ হলে না হয় এড়িয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু বাচ্চার জন্মদিন বলাতে আর এড়াতে পারলাম না। ভাবলাম মন খারাপ করবে বেচারা। কলিগের কাছ থেকে হাজার খানেক টাকা ধার নিয়ে একটা গিফট কিনে চলে গেলাম।

নওরিন খেয়াল করল, খালিদ যখন কলিগের মেয়ের কথা উল্লেখ করল, তখন হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটার মতো খালিদের চোখে-মুখে এক পশলা বিষণ্নতা ছুঁয়ে গেল। নিখুঁতভাবে খেয়াল না করলে যা দেখা যায় না। আর নওরিন তা খেয়াল করল বলেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল- মিস হওয়া পিল দূরে থাক, আপাতত সে আর পিল খাবে না।
খালিদ রাতের খাবার খেয়ে এসেছে বলে একটু মন খারাপ হলো নওরিনের। আজ সে একটা নতুন রেসিপি রাঁধল, আর আজই কিনা খালিদকে কলিগের মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াতে যেতে হলো!
খালিদের প্রতি কিছুটা অভিমান জন্মালো তার।  একটা ফোন তো করতে পারত।
পাশাপাশি নওরিনের নিজের দোষটুকুও ধরা পড়ল- খালিদের বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে সেও তো একবার ফোন করে খোঁজ নিতে পারত!

আসলে ভাবনায় ঘুরপাক খাওয়া বিষয়টি নিয়ে সে এতটাই দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল, অন্যকিছু মাথায় ঢুকছিল না।
খেয়ে এলেও নওরিনকে সঙ্গ দিল খালিদ। শুধু তাই নয়, নতুন রেসিপির বেশ প্রশংসাও করল সে। খালিদ অবশ্য এমনই, নওরিনের অনেক সাধারণ বিষয়েও সে প্রশংসা করে। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে নওরিন বোঝে- এই প্রশংসা অকৃত্রিম নয়। স্বামীর এই গুণটি নওরিনকে সব সময় মুগ্ধ করে। শুধু এই গুণটি কেন? খালিদের এমন আরো অনেক গুণ আছে, যা অনেক স্বামীরই থাকে না। এই গুণের কারণেই হয়তো সেই যে বিয়ের পর পর নওরিন বলে দিয়েছে, ‘আমার পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চা নেবার জন্য তাড়াহুড়ো করতে পারবে না’, তারপর এতগুলো বছর পার হলো, তিন বছর হলো নওরিনের মাস্টার্স শেষ হয়েছে; আজ অব্দি এ ব্যাপারে একটি কথাও বলেনি খালিদ।

অথচ খালিদের পরিবারে এ নিয়ে আড়ালে-আবডালে অনেক কথা হয়। কম-বেশি খালিদকেও নানা কথা শোনায় তারা। এমনকি শাশুড়ি-ননদরা আকার-ইঙ্গিতে নওরিনকেও মাঝে মাঝে খোঁচা দিয়ে দু’চার কথা বলতে কার্পণ্য করে না। তবু মুনিমের কথা ভেবে এসব গায়ে মাখেনি নওরিন। কিন্তু বিষয়টা হঠাৎ মনে আসাতে, মন কেমন করে উঠল!

মন কেমন করে ওঠাটাই হয়তো নওরিনের উপলব্ধির লক্ষণ! কিন্তু মুনিমকেই বা কী করতে পারত সে? তাকে ভালোবেসে মুনিম এখনো বিয়ে করেনি। বলেছে বাকি জীবন একাই কাটিয়ে দেবে। এমন অদম্য প্রেমের কাছে কে নতজানু না হয়? তাছাড়া মুনিমের সঙ্গে দশ বছরের সম্পর্ক। তার সঙ্গে বিয়ে হলে এখন সম্পর্কটা দাঁড়াত আঠারো বছরে।

মুনিমের সঙ্গে বিয়েটা হয়তো হতো কিন্তু মাত্র তিন মাসের ব্যবধান। পাঁচ বছর বিদেশে চাকরি শেষে মুনিম যখন দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন নওরিনের দুঃসম্পর্কের এক খালু প্রস্তাবটা নিয়ে এলেন। এ ধরনের দুর্ঘটনা সাধারণত দুঃসম্পর্কের লোকদের দ্বারাই ঘটে!
বিয়েটা ঠেকাতে জোর চেষ্টা করেছিল নওরিন। এর আগেও এমন আরো অনেক প্রস্তাব এসেছে। পড়াশোনার ছুঁতোয় তা ঠেকিয়েও দিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। তাও হতো, যদি পাত্র অর্থাৎ খালিদের ঠিকানাটা পেত! এতটাই কঠোর পারিবারিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নওরিনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করানো হয়েছে যে, তার কোনো প্রচেষ্টা কাজে আসেনি।

তারপর মুনিম দেশে ফেরার পর নওরিনের সঙ্গে শুধু যোগাযোগই হলো না, দু’জনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার হিসেব-নিকেষের ব্যর্থতা তাদের সম্পর্ককে নতুন সুরে বাঁধল। সেই সুরের মোহে প্রথম দিকে ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোনো পার্কে নয়তো রেস্তোরাঁয়; পরবর্তীতে নিরাপত্তার ছুঁতোয় মুনিমের নির্জন ফ্ল্যাটে ছুটে যেত নওরিন।
এক সময় সে উপলব্ধি করল, বাচ্চাকাচ্চা থাকলে এভাবে যখন-তখন মুনিমের কাছে ছুটে যেতে পারবে না সে। আর এখন, বিয়ের আট বছরের মাথায় হঠাৎ তার কেনই বা মনে হচ্ছে, এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যত দ্রুত সম্ভব সন্তান গ্রহণ করা জরুরি। নাহলে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গেলে বাবার মাথায় সাদা চুলের বহর দেখে লোকে ভেবে বসবে- নাতিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে এসেছেন দাদা! তাছাড়া সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার তো আছেই।

পাঁচ
স্বামী নাকি প্রেমিক? নাকি দু’জনই? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে নওরিনের উপলব্ধিতে একটি কথা বার বার কড়া নাড়ল- জীবনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top