সকল মেনু

আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসের স্বার্থকতা

 এম. শরীফ হোসাইন,ভোলা:আধুনিক সভ্যতার মূলে রয়েছে কোটি কোটি মানুষের তিল তিল শ্রম। শ্রমজীবি মানুষের রক্ত ও ঘামেই নির্মিত হয়েছে সমুন্নত বিশ্বসভ্যতা। যাদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে সভ্যতার পত্তন হয়েছে, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হয় রক্ত আত্মদানের মাধ্যমে। কিন্তু মে বা শ্রম দিবসের ১২৬ বছর পার হলেও অদ্য পর্যন্ত শ্রমিকদের অধিকার ফিরে পায়নি। পদে পদে তারা বঞ্চিত, শোষিত, লাঞ্ছিত, পদদলিত। প্রাচীনকালের দাস ও বর্ণ প্রথার লোমহর্সক শৃংখলে আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে রেখে শ্রমের ফসল আহরণ করত মহাজন ও ক্ষমতাশালীরা। নাম মাত্রে মুজুরীতে অমানবিক ভাবে দৈনিক ১৬-১৮ ঘণ্টা শ্রম দিতে হত শ্রমিকদের। বর্তমানে কৃতদাস প্রথার প্রচলন না থাকলেও ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা বঞ্চিত শ্রমিক সমাজ।

শ্রম ও শ্রমিক:
জিবিকা নির্বাহের জন্য মনও দেহকে কজের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করাকে শ্রম বলে। উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সমুহে যে সকল নরনারী মুজুরীর উদ্দেশ্যে কাজ করে তাদেরকে শ্রমিক বলে। শ্রম ও শ্রমিক ‘মুজুর’ শব্দের দুটি রূপ।
শ্রমিকের অধিকার বলতে কি বুঝায় ?
খেয়েপরে বেচে থাকার মত মাসিক মুজরি, দৈনিক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ। অতিরিক্ত কাজের জন্য বারতি মুজুরি কার্যক্ষেত্রে চিকিৎসার সুবিদা, সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা ইত্যাদি ন্যায়সঙ্গত দাবীকে শ্রমিক অধিকার বলে। মহানবী (সঃ) বলেছেন “তাদের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দাও”
শ্রম দিবস কি ও কেন:
আন্তর্জাতিক মে দিবস বা শ্রম দিবসএক ধারাবাহিক রক্তাক্ত সংগ্রামের মহা ইতিহাস। শ্রম অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে বলি দিতে হয়েছে অনেক জীবন। ইতিহাসের রক্তাক্ত পথ বেয়ে পহেলা মে স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ-ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় পনে দু’শত বৎসর পূর্বে।
শ্রমিকের অধিকার আদায়ের জন্য প্রথম আন্দোলন শুরু হয় অবিভক্ত বঙ্গে। শিকাগো শহরের প্রায় ৬০ (ষাঁট) বৎসর পূর্বে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয় বাংলায়। এ যেন “আজ বাংলা যা ভাবে, কাল বিশ্ব তা ভাবে”। ১৮২৩ সালে ইতিহাসের প্রথম কর্ম বিরতি বা ধর্মঘট পালন করে বঙ্গদেশের পালকির বেয়ারারা , অধিকার আদায়ে সে কর্ম বিরতি নাড়া দিয়েছিল ইংরেজ শাসক কে। ১৮৩৫ সনে নদী পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত মাল বাহকেরা অধিকার আদায়ের জন্য ধর্মঘট করেছিল। অবশ্য এ দুটি ধর্মঘট কোন সংগঠিত ধর্মঘট ছিল না। সংগঠিত ধর্মঘট হয় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দারীতে ১৮৬২ সালে। হাওড়া রেল ষ্টেশনের ১ হাজার ২শত রেল শ্রমিক ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ধর্মঘাটের ডাক দেয়।
বঙ্গদেশের ৪ বৎসর পর ১৮৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি নিধিরা এক জোট হয়ে কর্ম দিবস ৮ ঘণ্টা নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। শ্রমিক সংগঠনের প্রস্তাব কে পাত্তা না দিয়ে মালিক শ্রেণী ভাড়াটে গুন্ডা ও অর্থের বিনিময়ে শ্রমিক দিয়ে শ্রমিক হত্যা করে আন্দোলন দমানোর ব্যর্থ নেশায় মেতে উঠে। শাসক ও মালিক শ্রেণী আন্দোলন কে দমন করার জন্য পিংকার্টন এজেন্সি খোলেন। তাদের নিজস্ব গুন্ডা বাহিনী আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হলে পিংকার্টন ঠ্যাঙ্গারেরা সেনা বাহিনী তলব করত। প্রবল প্রতিরোধের মুখে মার্কিন শ্রমিকেরা আন্দোলন চালু রাখে এবং সর্বত্র ধর্মঘটের উত্তার তরঙ্গ ছড়িয়ে পরে।
আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ১৮৮৪ সালে শ্রমিকদের নতুন কর্মসূচী ঘোষিত হয়। ফেডারেশন অব লেবার সিদ্ধান্ত নেয় ১৮৮৬ সালের পহেলা মে ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে লাগাতার ধর্মঘট শুরু হবে। অন্যান্য লেবার সংগঠন এতে সমর্থন দেয়। দিন যতই ঘনিয়ে আসে শ্রমিক শ্রেণী ঐকবদ্ধ হতে থাকে। অন্যদিকে মালিক শ্রেণী আন্দোলন দমানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এরই মঝে ১৭ এপ্রিল মিসিশিপি নদীর তীরে গুম হওয়া ৭ শ্রমিকের লাশ পাওয়া যায়। আন্দোলন দমানোর জন্য হুমকি স্বরূপ এ হত্যা হলেও অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছু হাটেনি শ্রমিকেরা। আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু তখন আমিরিকার শিকাগো শহরে। ১ লা মে ১৯৮৬ শনিবার স্বাভাবিক কাজের দিন কারখানার চাকা বন্ধ। শ্রমিকেরা নেমে আসে রাস্তায়।
চলে গেলেন মিসিগাণ এভিনিউর মিছিলে যোগদিতে। সমাবেশ হল, দাবীর আওয়াজ উঠে আসল ভাষনে (১) খেয়ে পরে বেচে থাকার মতো মুজরী নির্ধারণ (২) অসুস্থ্য হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ (৩) বিশ্রামের জন্য সাপ্তাহিক একটা ছুটির দিন (৪) দৈনিক কজে সময়সীমা ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে সবাই চলেগেলেন যার যার গন্তব্যে। কোথাও কোন গোলমাল নেই। রবিবার সরকারি ছুটির দিন। সোমবার চলে ধর্মঘট।
ম্যাককর্মিক হার্ভেষ্টার ওয়ার্কসর্পের শ্রমিকেরা ধর্মঘট ভাংতে আসা ট্যাঙার বাহিনির মোকাবেলা করতে গেলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় ঘটনস্থলেই নিহত হয় ছয় শ্রমিক। পরদিন ৪ মে প্রতিবাদ সভার আহবান করা হয় শিকোগোর হে নামক মার্কেট স্কয়ারে, রাত তখন ১০টা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি প্রতিবাদ সভায় বক্তৃতা করছেন শ্রমিক নেতা এলভাট পারসন। আকর্শ্মিক পুলিশ এসে সমাবেশ বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। সমাবেশের প্রচন্ড ভীরের মধ্যে আত্মগোপনকারী অন্তর্ঘাতকেরা ছুড়ে দেয় বোমা। প্রচন্ড বিষ্কোরন, অন্যদিকে পুলিশ ঝাপিয়ে পরে সমাবেশে উপস্থিত শ্রমিকদের উপর। ব্যপরোয়া পুলিশের গুলি ও বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলে শ্রমিক নেতাসহ ১০ নিহত হয়, আহত হয় কয়েকশত। কয়েশত শ্রমিক কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হল। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্য থেকে বাচাই করে ৬ জন শ্রমিককে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলানো  হল। এত কিছুর পরও শ্রমিকদের দমাতে না পেরে মালিক পক্ষ দাবী মেনে নিতে বাধ্য হল। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে শ্রমিক সমাজ আদায় করে নিয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের উল্লেখিত অধ্যায়কে চির স্মারণীয় এবং  আগামী দিনের প্রেরণার উৎস হিসাবে ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বৎসর যে মাসের পহেলা তারিখে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

বিশেষ মর্যাদার কারণ:
একটি দেশের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য শ্রমের মর্যাদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রম ও অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। প্রতিটি সৃষ্টি, নির্মাণ-বিনির্মাণ, সাফল্যের পেছনে রয়েছে যথাযথ শ্রম। শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন ও শ্রম শক্তিকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর উপর নির্ভর করে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক উন্নতি। সঠিক এবং প্রকৃত উৎপাদনের সাফল্যকে ধারণ করতে হলে প্রয়োজন সঠিক শ্রম, মেধা এবং পুঁজি। এ কথা অনস্বীকার্য যে কর্মরত শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মানউন্নত হলে আবশ্যিক ভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মজবুত হবে জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
শ্রমিকদের রক্তের উপর ভর করে গড়ে উঠল শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমজীবি মানুষের ন্যায় সংগত অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের কাজের মানোন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনের ক্ষেত্রে গতিশীলতা নিশ্চিত করাই ছিল তাদের কাজ। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের অধিকার বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দল ও সরকারের লেজুড়াবৃত্তিতে পরিনত হওয়ার কারণে উৎপাদনে ব্যহত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংশ করার পথে নিয়ে গিয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষমতা যাওয়ার সেতুতে পরিনত করছে। ধুলা মিশিয়ে দিয়েছে শ্রমিকদের অধিকার ও রক্তক্ষয় সংগ্রামের ইতিহাস। দল লেজুরা বৃত্তি থেকে বেড়িয়ে এসে ক্রমে ট্রেট ইউনিয়নগুলোকে শ্রমিদের প্রকৃত অধিকার আদয়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে। জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে হাত লাগাতে হবে। অন্যথায় মে দিবেসর রক্তমাখা ইতিহাসকে কালিমা লেপন করা হবে।
শ্রম এবং অর্থনীতির মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তার প্রতিটি সৃষ্টি, নির্মাণ এবং সাফল্যের পেছনে রয়েছে মানুষের শ্রম। মানুষ নিয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্র। সুতরাং, সব শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং তাদের মানবিক মর্যাদায় পাশাপাশি যথাযথ উৎপাদনশীলতা অভ্যাহত রাখার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থেকে কাজ করতে হবে। এ মহৎ কর্মটির মধ্যে লুকায়িত আছে মে দিবসর যথার্ত সার্থকতা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top