সকল মেনু

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি : মরমি তত্ত্বের এক অলৌকিক বাগান

ধর্ম প্রতিবেদক, ৬ এপ্রিল (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : [৫ জমাদিউস সানি মোতাবেক ৬ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত মুসলিম কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর ওফাত দিবস (ইনতিকালের দিন)। ৬৭২ হিজরি সনের এই দিনে ইহলৌকিক জীবন ছেড়ে পরলৌকিক জীবনের বাসিন্দা হন মহান এই কবি। গভীর শ্রদ্ধায় আজ স্মরণ করছি মাওলানা রুমীকে…]

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে যে ক’জন মুসলিম কবি সাহিত্যিক ও মনীষী তাঁদের রচনায় ইসলামী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে অমর হয়ে আছেন তন্মধ্যে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী শীর্ষ স্থানীয়দের অন্যতম একজন। কেবল আধুনিক ইরানের নয়, গেটা বিশ্বসাহিত্যে সুপরিচিত একটি নাম। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক আধ্যাত্মিক চিন্তা চর্চার সাধক। দর্শন ও বিশ্বসাহিত্যের একজন অগাধ পান্ডিত্যপূর্ণ মনীষী। মাওলানা রুমী সাহিত্যচর্চা করেছেন ফার্সীতে। তিনি ফার্সী ভাষায় অনেক জ্ঞানগর্ভ শিক্ষামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক ও উপদেশমূলক একাধিক প্রবন্ধও আছে। তন্মধ্যে ‘ফিহি মা ফিহি’ অন্যতম। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উল্লেখযোগ্য কীর্তিমান অমরত্ব পাওয়া গ্রন্থ “মসনবী”। মসনবী শুধু ফার্সী সাহিত্য ভান্ডারে নয়। এটি বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারেরও একটি অমূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থে দ্বিপদী ছন্দবদ্ধ কবিতার সংখ্যা পঁচিশ হাজার। যা ছয় খন্ডে বিভক্ত। মসনবী গ্রন্থে তিনি কাব্য আকারে বহু কাহিনী উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে। এগুলো প্রায় সবই মূল্যবান উপদেশাবলী। আমাদের দেশও মসনবী বাংলায় অনূদিত হয়েছে। শুধু তাই নয় আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে তথা বাঙালি মুসলিম সমাজে ‘মসনবী’ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। যার কারণে তিনি আমাদের কাছেও হয়ে আছেন একান্ত প্রিয়। ‘মসনবী কেবল ধর্মতত্ত্বের উপর নয়, সাধারণ দর্শনের একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবেও পরিচিত।’ মসনবী প্রসঙ্গে উক্ত কথাগুলো অকপটে স্বীকার করেছেন মসনবীর বৃটিশ অনুবাদক উইলসন। গ্রন্থের পরতে পরতে বর্ণিত হয়েছে মানবাত্মা ও মহাত্মার মধ্যে চিরন্তন বন্ধন ও প্রেমের কথা। এক কথায় যাকে বলা যায় “নিরঙ্কুশ আল্লাহর প্রেম।” এতে নেই কোন বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে কোন জোরজবরদস্তি। তাই মসনবীকে এক বাক্যে বলা যায় একটি ধর্মীয় নীতিশাস্ত্র গ্রন্থ।

কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম ১২০৫ সালের (মতান্তরে ১২০৭) ২৯ সেপ্টেম্বর, ৬০৪ হিজরীর ৬ রবিউল আউয়াল, আফগানিস্তানের বালখে। তাঁর প্রকৃতনাম মুহাম্মদ। জালালুদ্দিন ছিল তাঁর উপাধি। সুলতান মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ ছিলেন মওলানা রুমীর পিতা। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন মাওলানা রুমীর পিতৃকুল থেকে নবম বংশধর এবং মাতৃকূল থেকে ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর (রা.) বংশধর। তাঁর দাদা হোসাইন ইবনে আহম্মদ বালখীও ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সৌভাগ্যবান ও আধ্যাত্মিক সাধক। ১২১১ সালে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে মাওলানা রুমী তাঁর সঙ্গে পিতার আধ্যাত্মিক ওস্তাদ খাজা ফরিদুদ্দিন আক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি রুমীকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি শিশু রুমীর বুদ্ধিদীপ্ত সুরত দেখে মন্তব্য করেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শিশু সন্তান সমাজের একজন বিদ্বান হবে ও বিজ্ঞ লোকদের সচেতন আত্মাকে আলোকিত করবে। ওস্তাদ খাজা সাহেব শিশু রুমীকে তাঁর রচিত ‘গহের নামা’ কিতাবটি উপহার দেন। মাওলানা রুমী ছিলেন একজন আলেম পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতৃ মাতৃকুল ছাড়াও তাঁর বিবাহ হয় সমরখন্দের এক বিশিষ্ট আলেম কন্যার সাথে। তাঁর দাম্পত্য জীবনে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সে শ্বশুর কুলও ছিলেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। যৌবনের প্রারম্ভেই মওলানা রুমী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন এবং পবিত্র হজব্রত পালন করেন। মক্কা থেকে ফিরে তিনি তুরস্কের আনাতোলিয়া কৌনিয়ায় পৌঁছে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তখন তাঁর বয়স বাইশ। সঙ্গে তাঁর পিতাও ছিলেন। জানা যায়, তদানীন্তন রোমের বাদশাহ সুলতান আলাউদ্দীনের অনুরোধে তিনি কৌনিয়ায় আসেন। কৌনিয়ায় বাদশাহ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে রুমীর পিতা এই মাদ্রাসায় যোগ দেন। পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা রুমী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ৬৩০ হিজরীতে ২৪ বছর বয়সে সিরিয়ায় গমন করেন এবং হালবস্থ ছালাবিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি হাদিস, ফিকাহ, তাফসির, সাহিত্য, দর্শন, মারেফাত, তরিকত এবং অন্যান্য মতবাদ ও তত্ত্ব সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করে তদানীন্তন বিশ্বখ্যাত আলেমে দ্বীন মঈনুদ্দীন ইবনে আরাবিয়া, শেখ সদরুদ্দীন কৌনভী ও শেখ ওসমান প্রমুখের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন। উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি ৬৩৪ খৃষ্টাব্দে পুনরায় কৌনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন।

জালালুদ্দীন রূমীর (১২০৭-১২৭৩) ‘মসনভি’কে চূড়ান্ত সম্মান জানিয়ে বলা হয়, ‘মসনভি-এ মৌলভি-এ মা’নভি/হাস্ত কুরআন দার জোবানে প্যহলভি’—অর্থাত্ মৌলভি রূমীর আধ্যাত্মিক দ্বিপদী ফারসি ভাষার কোরানস্বরূপ। মসনভি বা দ্বিপদী ফারসি ভাষার আদি কাব্যপ্রকরণগুলোর অন্যতম। পদ দুটি যুগ্মক হিসেবে মসনভিকে ‘মুজদাওওয়াজ’ও বলা হয়। মসনভির অর্ধচরণ দুটির ছন্দ এক। কিন্তু প্রতিটি দ্বিপদীর অন্ত্যমিল থাকে স্বাধীন। এ জন্যই একে মসনভি বা কাপলেট বলা হয়। কারণ ‘মসান্না’র অর্থ কাপল। দ্বিপদীর সংখ্যা সীমাবদ্ধ নয় বলে এ প্রকরণটি কিংবদন্তি, কাহিনী, ইতিহাস ইত্যাদি বর্ণনার জন্য সমধিক উপযোগী। ফারসি সাহিত্যে রচিত বেশ কয়েকটি মসনভিই বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে মাস্টারপিস কিংবা অত্যুত্কৃষ্ট শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হয়। ফারসি সাহিত্যে মসনভির চারটি সংরূপ নিম্নরূপ।

ক. এপিক মসনভি। এ সংরূপটি উদ্ভূত হয় খ্রিস্টীয় দশম শতকে এবং চূড়ান্ত রূপ পায় ফেরদৌসির ‘শাহনামা’য়। শাহনামার মানের না হলেও ‘গুশ্তাস্পনামা’, ‘গারশাস্পনামা’ও অবশ্যই এপিক। দ্বাদশ শতকোত্তর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক এপিকগুলোকেও একই শ্রেণীভুক্ত করা যায়।

খ. নীতিবিষয়ক ও শিক্ষামূলক মসনভি। বিস্তারিত ও দীর্ঘায়িত বাচন-ভাষণের উপযোগী বিধায় নীতি-শিক্ষা বিষয়াদিরও স্থান সঙ্কুলান সম্ভব মসনভিতে। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ শেখ সাদীর ‘বুস্তাঁ’, আরেকটি দৃষ্টান্ত হাকিম সানায়ির ‘হাদিকাতুল হাকিকা’।

গ. আধ্যাত্মিক মসনভি। তাপস্যিক এবং আত্মিক প্রসঙ্গ মসনভি-শীর্ষক প্রকরণে প্রবেশ করেছে দ্বাদশ শতকের শিক্ষামূলক কবি সানায়ির হাত ধরে। তাঁর ‘হাদিকাতুল হাকিকা’ নামক মসনভিটি আংশিক ঔপদেশিক, আংশিক আধ্যাত্মিক। তাঁর পরবর্তী মহত্ কবি ফরিদুদ্দীন আত্তারের ‘মানতিকুত্ তায়ের’ (পক্ষী-সম্মেলন)-কেই প্রথম অবিমিশ্র আধ্যাত্মিক মসনভি বলা হয়। অতঃপর এই শ্রেণীর মসনভি শীর্ষারোহণ করে জালালুদ্দীন রূমীর ‘মসনভি-এ মা’নভি’ শীর্ষক গ্রন্থটি মারফত। ষটপার্বিক ছন্দের রমল্-এ রচিত, ছয় খণ্ডের এই কাব্যগ্রন্থে বস্তুত মসনভির নৈতিক, ঔপদেশিক এবং ধর্মীয়-সব সংরূপই স্থান পায়। মাওলানার পরে কবি ইরাকী ও জামী মসনভি রচনা করেছেন বটে তবে রূমীর শীর্ষ ছুঁতে পারেননি কেউই। জামী তাঁর সপ্তপার্বিক ছন্দে রচিত মসনভি ‘সাব’আ-এ জামী’-তে আত্তার এবং রূমীর বদলে নিজামীকেই বেশি অনুসরণ করেছেন।

ঘ. প্রণয়ঘটিত মসনভি। গীতিকাব্যধর্মী এই শ্রেণীটিতে দ্বাদশ শতকের নিজামী তাঁর অনুজ ত্রয়োদশ শতকের আধ্যাত্মিক মসনভির রূমীর মতোই শীর্ষস্থানটি দখল করে আছেন এবং একই রকম অবিসংবাদিতভাবে। তাঁর বিখ্যাত ‘খাম্সাহ্’ অথবা ‘পঞ্চ মসনভি’র সবচেয়ে উদযাপিত তিনটি মসনভি হল—‘খসরু ও শিরিন’, ‘লায়লী ও মজনু’, ‘হাফ্ত পায়কার’ (সপ্ত সুন্দরী)। এঁর আধ্যাত্মিক মসনভির নাম ‘মাখজানুল আসরার’ (রহস্যভাণ্ডার)। নিজামীর অনুকরণে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের ফারসি ভাষার দিল্লির কবি আমীর খসরুও তিনটি জনপ্রিয় প্রণয়ঘটিত মসনভি রচনা করেন। নিজামীর অনুসারী পঞ্চদশ শতকের কবি জামী প্রণয়ঘটিত মসনভির চেয়ে বেশি লিখেছেন আধ্যাত্মিক এবং ঔপদেশিক মসনভি, যথা— ‘সিলসিলাতুল জাহাব’, ‘তুহফাতুল আহরার’, ‘সাবহাতুল আহরার’ এবং ‘খিরাদনামা ইসকান্দারি’।

মাওলানা জালালুদ্দীন রূমীর মৌলিক দীক্ষা হল হৃদয় এবং মস্তিষ্কের একীকরণ। অন্য মরমি কবি-দার্শনিকদের থেকে তিনি ভিন্ন। মরমিয়াবাদী হিসেবে তিনি ছিলেন নীতিশিক্ষক এবং সংস্কারক। তিনি লিখেছেন, অবিশ্বাসও একধরনের ধর্ম, রক্ষণশীল ধর্মীয় বিশ্বাসও একরকমের অবিশ্বাস— এসব না বুঝলে এবং বিপরীত ধারণাসমূহের প্রতি সহনশীলতা না দেখালে কেউ সফল হতে পারে না। কেবল সত্যান্বেষীই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। তার কাছে মানুষকে ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় কথা।’ জালালুদ্দীন রূমীর সাধারণ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল তওহিদ। সাধনার বিষয়টি ছিল উত্স থেকে বিযুক্ত মানুষের পরমসত্তার সঙ্গে পুনরায় সংযুক্তি। কারণ বিযুক্তিপীড়িত মনুষ্য বস্তুতই নিঃসঙ্গ। তাই তার স্বাভাবিক প্রবণতা আল্লার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া—যা ব্যাকুলতার স্তর পেরিয়ে তাকে ঘিরে বিরাজ করে তীব্র আকাঙ্ক্ষা হয়ে। রূমীর সকল কাব্য ও সংগীত নানারূপে কেবল এই কথাটিই বলে। তাঁর মসনভি বিচিত্র এক জটিল বয়ন—কোরানের অলৌকিক প্রকাশন, অধিবিদ্যা, উপকথা, রূপকথা, দৈনন্দিন জীবনগাথা ইত্যাদির। ‘মস্নভি-এ মা’নভি’ কিংবা ‘স্পিরিচুয়েল কাপলেটস’ অথবা ‘আধ্যাত্মিক যুগ্মক’-এর বিচারে রূমী ‘ইনসান-এ কামিল’ কিংবা ‘পূর্ণ মানুষ’রূপে বিবেচিত হন। প্রাচ্যের একটা প্রচলিত কথা এই যে ‘জালালুদ্দীন রূমী পয়গম্বর ছিলেন না, কিন্তু নিশ্চিতই তিনি একটি ধর্মগ্রন্থ রচনায় সক্ষম ব্যক্তিত্ব।’

তথ্যসূত্র : ইরান স্টাডি রুম, আন-নুর.আইটি, ইন্টারনেট

গ্রন্থনা : মাওলানা মিরাজ রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top