একশ্রেণীর পরিবহন মালিক টোকেন বাণিজ্যের সুবিধা নিচ্ছেন শতভাগ। তারা গাড়ির কাগজপত্র আপডেট ছাড়াই দাপটের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব মালিকের গাড়ির চালকের লাইসেন্সও নেই। এদের ভরসা টোকেন। পুলিশের টোকেন নিয়ে মফস্বলের গাড়ি চলছে নগরীতে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালক অবৈধ সুবিধা নিয়ে সড়ক-মহাসড়কে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। পুলিশকে টাকা না দিলে গাড়ির কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও নানা অজুহাতে মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। টোকেন নিয়ে ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ যানবাহন চলাচলের কারণে নগরজুড়ে চলছে নৈরাজ্য। চালকরা তাদের মর্জিমাফিক গাড়ি চালালেও ট্রাফিক পুলিশ নীরব। আর এ কারণে নগরীতে যানজট লেগেই আছে। সম্প্রতি কিছু অসাধু ট্রাফিক পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চেকিংয়ের নামে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে যানবাহন থামিয়ে মালিক-চালকদের হয়রানি করছে। কাগজপত্র ঠিক আছে এমন প্রাইভেট কারগুলোকেও ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে অন্তত ৫-৭ বার থামতে হচ্ছে তাদের হাতের ইশারায়।
মহানগরী ও সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে মোট ১০৩টি সড়কে ভারি, মাঝারি ও হালকা ধরনের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এদের অধিকাংশই নানাভাবে হয়রানির শিকার। বিভিন্ন রুটের টোকেনের নাম ভিন্ন। নাম অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে টাকার অংক। এগুলো রাখতে হয় গাড়ির সামনে। যাতে দূর থেকে ট্রাফিক দেখতে পায়। কিছু এলাকায় ডিউটি স্লিপের প্রচলনও আছে। টাকা দিয়ে এ ধরনের স্লিপ সংগ্রহ করতে হয়। অন্যথায় পকেটের টাকা খরচ করে কাজ করে দিতে হবে অসাধু পুলিশের। এছাড়া গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও চাঁদা দিতে হয়। এ কারণে অনেকে এখন আর কাগজপত্র ঠিক করতে বিআরটিএতে যান না। তাদের বক্তব্য বিআরটিএতে গেলেও টাকা দিতে হয়, রাস্তায়ও টাকা লাগে। এছাড়া গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলেও টোকেন বাণিজ্যে অর্থের জোগান দিতেই হবে। কাজেই সড়কে থাকাকেই তারা শ্রেয়তর মনে করে। কারণ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় থাকলে আয় হয় সেখান থেকে কিছু অসাধু পুলিশ বা তাদের প্রতিনিধিদের দিলেই কাজ শেষ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার যুগান্তরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, অবৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। মফস্বলের গাড়ি অবৈধভাবে শহরে ঢুকলে মামলা দিয়ে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। তবে টাকার বিনিময়ে টোকেন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কে টোকেন দিয়ে পয়সা নিচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
টোকেন বাণিজ্য সম্পর্কে সিএমপির সদরের ডিসি ট্রাফিক ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সিএমপির ট্রাফিক পুলিশ কোনো চালককে টাকার বিনিময়ে টোকেন দেয়নি। টোকেন নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে গাড়ি চলে এরকম নজির নেই। এ কথা যারা বলে তারা পাগলের স্বর্গে বাস করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক সময় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার কিছু জায়গায় পুলিশের কথা বলে, নামসর্বস্ব শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে টোকেনের বিনিময়ে প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থেকে আদায় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিশাল এ অর্থ যাচ্ছে পুলিশের পাশাপাশি সন্ত্রাসীসহ শ্রমিক সংগঠনের কথিত নেতাদের পকেটে। নিরীহ চালকরা ট্রাফিক পুলিশের অযথা হয়রানির কবল থেকে বাঁচতে দৈনিক এবং মাসিক ভিত্তিতে এ টাকা পরিশোধ করছেন। অন্যদিকে স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও বেপরোয়াভাবে চাঁদা আদায় করছে যানবাহন থেকে। এসব সন্ত্রাসী গ্র“পগুলোকে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে চালকদের ওপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। অতর্কিতভাবে ভাংচুর করা হয় গাড়ি।
এ প্রতিবেদক যাত্রী সেজে একাধিক দিন বেশ কয়েকটি সড়কে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কে সিএনজি অটোরিকশা চালক মোঃ নাসের বলেন, গত ৪-৫ বছর ধরে এ সড়কে টোকেন প্রথা শুরু হয়েছে। গ্রামের সিএনজি অটোরিকশাগুলো নগরীতে প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও টোকেনের মাধ্যমে অনায়াসে নগরীতে আসা-যাওয়া করছে। এ সড়কে প্রায় ১৫০০ সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। প্রত্যেক গাড়িকে মাসিক ৩০০ টাকায় টোকেন নিতে হয়। অক্সিজেন এলাকার লেদু মিয়া, সজলসহ আতুরার ডিপু এলাকার আরও কয়েকজন এ টোকেন দিয়ে থাকে। গাড়ির সামনে টোকেন থাকলে ট্রাফিক পুলিশ মফস্বলের গাড়িগুলো আটকায় না। পুলিশের টার্গেটে থাকে যেসব গাড়িতে টোকেন থাকে না। ওই গাড়িগুলোকে পুলিশ মামলা দেয় অথবা মামলা দেয়ার কথা বলে গাড়ি প্রতি ৮০০ থেকে দেড় হাজার টাকা কিংবা আরও বেশি টাকা আদায় করে। মামলা-পরবর্তী ঝামেলার ভয়ে ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিয়ে চালকরাও সরে পড়ার চেষ্টা করে। মূলত ট্রাফিকের মামলাসহ অন্যসব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতেই ৩০০ টাকায় টোকেন নিতে হয়। টোকেন নেয়ার পরও মুরাদপুর থেকে (গ্রামগাড়ি) যাত্রী নিতে হলে প্রতিবারে পুলিশের নিয়োগ করা এক লাইনম্যানকে দিতে হয় সিএনজি অটোরিকশা ৩০ টাকা, কার ৩০ ও মাইক্রোবাস ৫০ টাকা করে। এর বাইরে মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত চলাচলকারী টেম্পোগুলোকে দিতে হয় ৮০০ টাকা করে। একইভাবে ট্রাক ও বাসসহ অন্যান্য যানবাহনকেও দিতে হয় নিয়মিত চাঁদা। অক্সিজেন থেকে ষোলশহর ২নং গেইট ও অক্সিজেন থেকে ওয়াসা মোড় পর্যন্ত টেম্পোগুলোকে দিতে হয় মাসিক ৮০০ টাকা করে। অক্সিজেন থেকে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকেও মাসিক ও দৈনিক হারে টাকা নেয়া হচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু মুরাদপুর ও অক্সিজেন এলাকার যানবাহনগুলোর কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হচ্ছে ২ কোটি টাকার বেশি।
অটোরিকশা চালক আবদুল মান্নান বলেন, ৩০০ টাকার টোকেনের মেয়াদ পার হওয়ার আগে আরেকটি নতুন টোকেন নিতে হয়। না নিলে ট্রাফিক মামলা দেয়। না হয় সন্ত্রাসীরা পুলিশকে ধরিয়ে দেয়। অক্সিজেন এলাকার কয়েকজন লোক ও মালিক শ্রমিক সমিতির অফিসগুলোতে এসব টোকেন পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, শুধু সিএনজি অটোরিকশা নয়, সড়কে চলাচলরত সব ধরনের যানবাহনের কাছ থেকে তারা চাঁদা আদায় করে। গত কয়েক দিন আগে অক্সিজেন থেকে ছেড়ে যাওয়া খাগড়াছড়ির এক চালক চাঁদা না দেয়ায় দীর্ঘ এক ঘণ্টা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে কোনো গাড়ি চলাচল করতে দেয়া হয়নি। পরে গাড়ির চালক-মালিকরা এলাকার সন্ত্রাসীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর গাড়ি চলতে দেয়া হয়। পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
অটোরিকশা চালক চাঁন মিয়া বলেন, শুধু অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কে নয় সব সড়কে পথে পথে দুর্নীতিবাজ পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ঠিক নেই বলে নানা অজুহাতে মামলা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, রাঙ্গামাটি সড়কের রাউজান উপজেলায় অবস্থিত হাইওয়ে থানাকে প্রতিমাসে টোকেনের মাধ্যমে ৩০০ টাকা দিতে হয়। টোকেন না নিলে কয়েক দিন পর পর রাঙ্গামাটি সড়কসহ অন্যান্য উপজেলার শাখা সড়কে চলাচলরত বিভিন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে অহেতুক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি থানাকে মাসিক হারে ১৫০ টাকা দিয়ে ডিউটি স্লিপ নিতে হয়। ডিউটি স্লিপ না থাকলে মাসে কয়েকবার করে থানা পুলিশের কাজ করতে হয়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থানা পুলিশ গাড়ি ব্যবহার করলেও খাবার ও গাড়ির গ্যাস বাবদ দেয়া হয় মাত্র ৫০ টাকা। নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে গাড়িতে গ্যাস নিয়ে পুলিশের কাজ করতে হয়। এর থেকে বাঁচার জন্য প্রতি মাসে ১৫০ টাকার টোকেন নিতে হয়। একইভাবে টেম্পো, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের চালকরা যুগান্তরের কাছে তাদের কষ্টের কথা বলেন। কিভাবে টোকেন বাণিজ্য চলছে, এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তা উঠে আসছে তাদের বক্তব্যে।
চট্টগ্রাম মহানগরী অটোটেম্পো মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী জানান, গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা যাতে নগরীতে প্রবেশ করতে দেয়া না হয় সে জন্য সদর ডিসি ট্রাফিককে একাধিকবার সমিতির পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। পুলিশের দেয়া এক ধরনের টোকেনের মাধ্যমে গাড়িগুলো শহরে চলাচল করে। শুনেছি এসব গাড়ি শহরে চলতে দেয়ার জন্য মাসিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় টোকেন নিতে হয়। পাশাপাশি বিআরটিএর নিবন্ধনবিহীন এএফআর লেখা সিএনজি অটোরিকশা চলছে আড়াই হাজারের মতো। এসব গাড়ি থেকে টোকেনের মাধ্যমে ট্রাফিক পুলিশ প্রাতিমাসে আড়াই হাজার টাকা করে নিচ্ছে। তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, গত কয়েক দিন আগে কোতোয়ালি মোড়ে এক সার্জেন্ট ২০০১ সালের কয়েকটি অটোরিকশা আটক করে স্ক্র্যাপ করার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করেছে। যেসব অটোরিকশার ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে সেসব গাড়ির কাগজপত্র নবায়ন করছে না বিআরটিএ। অন্যদিকে বাস, টেম্পোর কোনো ধরনের কাগজপত্র না থাকলেও এসব গাড়ি পুলিশকে ম্যানেজ করে ৩০-৪০ বছর ধরে সড়কে চলছে।
চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্র“পের মহাসচিব আবুল কালাম জানান, পুলিশকে টাকা দিতে হয় না, তারাই নিয়ে ফেলে। গাড়ির কিছু কাগজপত্রের অভাবের সুযোগ নিয়ে পুলিশ যানবাহনের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন জানান, পরিবহন সেক্টর অনেক সমস্যারই শিকার হচ্ছে। তবে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।