সকল মেনু

এক মার্চে পরিচয় আরেক মার্চে খুন

ঢাকা, ২৭ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : চট্টগ্রামে মা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত কথিত প্রেমিক রায়হান এই জোড়া খুনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। রায়হান সাংবাদিকদের জানিয়েছে, ‘১৯ মার্চ পরিকল্পনার পর ২৪ মার্চ ঠান্ডা মাথায় নিশু ও আন্টিকে খুন করেছি।’

তাদের দুজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর এখন কেমন লাগছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রায়হান বলেছেন,  ‘ঠান্ডা মাথায় খুন করেছি, আমার খারাপ লাগছে না। নিশু আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করায় আমি তাকে খুন করেছি।’

গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের ১২৯ নম্বর বাড়িতে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের স্ত্রী রিজিয়া খাতুন (৫০) এবং তাদের একমাত্র কন্যা এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী নিশাত নাজনিন সায়মাকে (১৭) দিনের বেলায় বাসায় ঢুকে খুন করেন নিশাতের কথিত প্রেমিক আবু রায়হান (২৪) এবং তার বন্ধু একটি গেস্টহাউসের গাড়িচালক শহীদ (২৬)।

স্বঘোষিত এই দুই ঘাতককে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় দুই আসামিকে। এই সময় আবু রায়হান ও শহীদ সাংবাদিকদের কাছে অকপটে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম দুই খুনিকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক, অর্থ, প্রশাসন) মো. শহীদুর রহমান, উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) কুসুম দেওয়ান, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) বাবুল আক্তার উপস্থিত ছিলেন।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড
মা-মেয়ের প্রধান ঘাতক রায়হান সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছে খুনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নিশাতকে খুন করব। সে আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ১৯ তারিখের পরিকল্পনা আমি ২৪ তারিখে সম্পন্ন করতে সক্ষম হই।’

ঘাতক রায়হান বলেন, ‘আমি ১৯ মার্চ ঢাকায় যাবার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। ওই দিন আমি ঢাকায় না গিয়ে নগরীর খুলশীতে ক্রাউন রেসিডেন্সিয়াল গেস্টহাউসে বন্ধু আতিকের কাছে যাই। সেখানেই গেস্টহাউসের ড্রাইভার শহীদের সাথে আমার পরিচয় হয়। শহীদকে পুরো বিষয়টা জানাই। নিশাতকে খুন করার সিদ্ধান্তের কথা জানাই শহীদকে। তাকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বললে সে রাজি হয়।’

এ সময় পাশেই উপস্থিত ড্রাইভার শহীদ রায়হানের কথার প্রতিবাদ করে বলে, ‘আমাকে খুন করার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে, নিশাতদের আলমিরায় বেশ দামি একটা জিনিস আছে। সেটা আনতে পারলে টাকা দেবে।’

রায়হান বলেন, ‘২২ মার্চ রাতে অলংকার মোড়ে আলিম হোটেলে আমি এবং শহীদ মিলে পরিকল্পনা করি- কীভাবে কখন নিশাতদের বাসায় যাব! কীভাবে নিশাতকে খুন করব ইত্যাদি বিষয়ে। ওই দিনই একটি কামারের দোকান থেকে টেঁটা ও ছোরা কিনে রাখি। শান্তিবাগ এলাকার অটোরিকশাচালক রুবেলকে ২৪ মার্চ সকালে তার সিএনজি অটোরিকশাটি আমাদের জন্য প্রস্তুত রাখার জন্য ভাড়ায় ঠিক করি। তবে সিএনজিচালককে খুনের পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।’

রায়হান বলেন, ‘২৪ মার্চ সকালে নগরীর ছোটপুল থেকে রুবেলের অটোরিকশা নিয়ে নিশাতের বাসার সামনে গিয়ে অটোরিকশাতে বসেই আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। পরিকল্পনা ছিল, নিশাত বের হলে ছুরি মেরে তাকে খুন করব। কিন্তু নিশাত বের হতে দেরি হওয়ায় দুজন বাসায় উঠে যাই। শহীদ কলিংবেল দিলে নিশাত ভেতর থেকে কে কে বলে জিজ্ঞেস করে। শহীদ বলে, স্কুল থেকে সালমা ম্যাডাম পাঠিয়েছে।’ তখন নিশাত দরজা খুলে দিলে রায়হান ভেতরে ঢুকতে যান। এ সময় নিশাত বাধা দিলে রায়হান তাকে ধাক্কা মেরে শহীদসহ বাসার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে নিশাতের মা চলে আসেন সামনের রুমে। শহীদ নিশাতের মাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে এবং রায়হান নিশাতকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যান।

রায়হান বলেন, ‘ডাইনিং রুমে নিয়ে শহীদ প্রথমে নিশাতের মাকে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় নিশাত জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু রায়হান তার মুখ চেপে ধরে। বাঁচার জন্য নিশাত রায়হানের আঙুলে জোরে কামড় দেয়। চিৎকার করে ওঠে রায়হান। এ সময় শহীদ গিয়ে নিশাতের পেটে ছুরি মারে।’

রায়হান জানান, ছুরিকাহত রক্তাক্ত অবস্থায় মা-মেয়ে দুজনই মেঝেতে পড়ে কাতরাতে থাকেন। এ সময় রায়হান তার প্যান্টের ওপর আরেকটি প্যান্ট পরে নেন। শহীদও তার রক্তমাখা প্যান্ট খুলে ওই বাসা থেকে একটি লুঙ্গি পরে নেন। রায়হান আগেই বের হয়ে অটোরিকশায় গিয়ে শহীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। দুই মিনিটের মাথায় শহীদও গিয়ে অটোরিকশায় উঠলে তারা খুলশীর কৈবল্যধাম এলাকায় চলে যান।

রায়হান জানান, নিশাত ও তার মায়ের রগ কে কেটেছে তিনি দেখেননি। তবে শহীদ এ কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা যখন বের হচ্ছিলাম তখনো দুজনের জ্ঞান ছিল। মা-মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করতে রায়হান আমাকে পায়ের রগ কেটে দিতে বললে আমি দুজনের পায়ের রগ কেটে দিই।’

কেন এই হত্যাকাণ্ড
সংবাদ সম্মেলনে ঘাতক রায়হান বলেন, ‘নিশাতের সাথে আমার এক বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত প্রায় এক মাস ধরে সে আমাকে ছেড়ে অন্য এক ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটা আমার সহ্য হয়নি। তাই আমি নিশাতকে খুন করেছি।’

নিশাতের মা রিজিয়া খাতুনকে কেন খুন করেছ- এমন প্রশ্নের জবাবে রায়হান বলেন, ‘আমি আন্টিকে (নিশাতের মা) খুন করতে চাইনি। কিন্তু নিশাতকে খুন করার সময় তিনি সামনে চলে এসেছিলেন এবং আমাকে চিনে ফেলেছেন। তাই নিজেদের আত্মরক্ষার্থে আন্টিকেও খুন করেছি।’

এক মার্চে পরিচয় আরেক মার্চে খুন
খুনি রায়হান বলেন, ‘২০১৩ সালের মার্চে এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয় ও নিশাতের বান্ধবী আনিকার কাছ থেকে নিশাতের মোবাইল নম্বর পেয়েছিলাম আমি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমি নিজেকে ইউএসটিসির বিবিএর ছাত্র পরিচয় দিয়ে নিশাতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। এক পর্যায়ে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়।’

রায়হান বলেন, ‘আমি নিশাতকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়েছি। নিশাতকে আমি একটি মোবাইল ফোন ও গ্রামীণের সিমকার্ড কিনে দিয়েছিলাম। সেই ফোনে আমাদের নিয়মিত কথা হতো।’

নিজেকে ইউএসটিসির ছাত্র পরিচয় দিলেও রায়হান পড়ালেখা করেন না বলে পুলিশ ও সাংবাদিকদের জানান। রায়হান বলেন, ‘আমরা দুজন নিশাতের স্কুলের সামনে প্রায়ই দেখা করতাম।’

এক বছর আগে এই মার্চ মাসে প্রতারণার মাধ্যমে যার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ঘাতক রায়হান, ঠিক এক বছর পর সেই মার্চ মাসেই প্রেমিকাকে নৃশংসভাবে হত্যা করলেন।

শেষ দেখা ১২ মার্চ
রায়হান জানিয়েছেন, নিশাতের এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়। গত ১২ মার্চ তাদের মধ্যে শেষ দেখা হয়। ওই দিন বিকেলে নিশাত ও তার দুই বান্ধবী মিলে আগ্রাবাদের আক্তারুজ্জামান সেন্টারে বেড়াতে যায়। খবর পেয়ে রায়হানও সেই মার্কেটে গিয়ে নিশাতের সঙ্গে দেখা করেন।

রায়হান বলেন, ‘ওই দিন নিশাত আমাকে একটি স্যান্ডউইচ খেতে দিয়েছিল এবং একটি পারফিউম গিফট করে। স্যান্ডউইচ দিয়ে সে আমাকে বলে, আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া এটাই শেষ খাবার। এর পর থেকে নিশাত আমার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। পরে আমি জানতে পারি, নিশাতের সাথে অপর একটি ছেলের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটা নিশ্চিত হয়েই আমি নিশাতকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেই।’

কেন নিশাতের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক ভেঙেছিল
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিশাতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার কারণ ব্যাখ্যা করে রায়হান জানিয়েছে, নিশাতের ঘনিষ্ঠ এবং তার চেয়ে বয়সে কমপক্ষে ২৫ বছরের বড় এক মহিলার সঙ্গে রায়হানের নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়। এই বিষয়টা জেনে যায় নিশাত। ফলে রায়হানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিশাত মির্জা নামের অপর একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি বাবুল আক্তার বলেন, নিজের কাছের মানুষের সঙ্গে রায়হানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, নৈতিকতাহীনতা মানতে পারেনি নিশাত। সেও মির্জা নামের আরেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। অসম সম্পর্ক এক পর্যায়ে করুণ পরিণতি তৈরি করে।

যেভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রায়হান-শহীদ
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আক্তার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পরপরই নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে রায়হানের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়। এতে মূলত আমরা খুনি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে যাই। এ ছাড়া বাসার সামনে একজন বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও একটি বাসার কাজের বুয় দুই যুবককে বের হয়ে যেতে দেখেছিল। এতে অনেকটা নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম, খুনি ছিল দুজন।

‘বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে রায়হানের ছবি দেখানো হলে সে রায়হানকে শনাক্ত করে। এরপর রায়হানের বাবা, মা, তিনজন বন্ধু ও নিশাতের বন্ধু মির্জাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে সামগ্রিক তথ্য পেয়ে আমরা রায়হানকে গ্রেফতারের অভিযানে নেমে পড়ি।

‘এরপর রায়হান এবং তার বন্ধুদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তায় ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেল থেকে আমরা রায়হানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। এরপর খুলশি থেকে গ্রেফতার করা হয় ভাড়াটে খুনি গেস্টহাউসের ড্রাইভার শহীদকে। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তমাখা প্যান্ট, লুঙ্গি, শার্ট, ছুরি ও হত্যার অন্যান্য আলামত উদ্ধার করা হয়।’

ঘাতকের প্রতিক্রিয়া
মা-মেয়েকে দিনদুপুরে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরও অনেকটা নির্বিকার এবং অনুতাপহীন ঘাতক রায়হান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘চিন্তাভাবনা করে পরিকল্পনামতো খুন করেছি। আমার খারাপ লাগছে না। আদালতে যা হওয়ার তাই হবে।’ রায়হান বলেন, ‘নিশাতের মা আন্টিকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু তিনি সামনে চলে আসাতে খুন করতে বাধ্য হয়েছি।’

দুই ঘাতকের পরিচয়
মা মেয়ের মূল ঘাতক আবু রায়হান প্রকাশ রায়হান (২৪), পিতা-আবুল বশর, মহিষাদি থানা, চাঁদপুর। বর্তমান ঠিকানা-শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, থানা ডবলমুরিং, চট্টগ্রাম। ভাড়াটে খুনি ড্রাইভার শহীদ (২৬), পিতা-বাবুল মিয়া, সাং-সন্দ্বীপ। বর্তমান ঠিকানা-মাস্টার লেইন, খুলশী, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top