সকল মেনু

টেলিটকে ৮ বছরেও নিয়োগ জটিলতা কাটেনি: হঠাৎ বেতন বাড়ল ২০%

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিবেদক, ২২ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : দীর্ঘ ৮ বছর ধরে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার সুরাহা হয়নি। অথচ হঠাৎ করে কর্মীদের বেতন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, টেলিটকের চেয়ারম্যান টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। মূলত তাদের আর্থিক সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করে বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবর রহমান বলছেন, মহার্ঘ্য ভাতার এই সিদ্ধান্ত অন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। তাই আমরা আমাদের কর্মীদের প্রাপ্ত নিশ্চিত করেছি।

সার্ভিস রেগুলেশন বা নিয়োগবিধি না থাকায় অনুমোদিত পদের কত শতাংশ সরাসরি নিয়োগ ও কত শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে, তা সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। একই পদে কত বছর চাকরি করলে পরবর্তী উচ্চ পদে পদোন্নতি প্রদান করা যাবে তা-ও নির্ধারিত হয়নি। এ ছাড়া কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, কল্যাণ তহবিল, গ্রুপ বীমাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে কোন নীতিমালাও হয়নি। পাশাপাশি চাকরি-পরবর্তী অবসর সুবিধার বিষয়েও কোন নীতিমালা হয়নি। এ সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। টেলিটকের বোর্ড অনুমোদিত ২৫৬ জনবলের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪৮৮ জন। নিয়োগের সময় কোটা পদ্ধতিও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া টেলিটক রাজস্ব খাতভুক্ত সরকারি কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও ডেপুটেশনের বদলে লিয়েন দেখিয়ে বিটিসিএলের ৭৬ জন কর্মকর্তাকে উচ্চ হারে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়।

এদিকে অর্গানোগ্রাম-বহির্ভূত নিয়োগ, ডেপুটেশনের বদলে লিয়েন দেখানো এবং সরকারি অন্য সংস্থায় লোক নিয়োগে উচ্চ হারে বেতন-ভাতা বাবদ কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বিষয়টি অডিট প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল উচ্চ বেতন-ভাতার মাধ্যমেই ৩৯ কোটি ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ১২৩ টাকা অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোন অনুমোদনও নেই। ডেপুটেশনের বদলে লিয়েন দেখানোর মাধ্যমে টেলিটকের বাড়তি খরচ হয়েছে ৮ কোটি ৪০ লাখ ৫৯ হাজার ৮৫৪ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে টেলিটকে অর্গানোগ্রাম এবং সার্ভিস রেগুলেশন তৈরি হলেও ইতিমধ্যে ইচ্ছামাফিক গোঁজামিলের মাধ্যমে লোক নিয়োগ করা হয়েছে কোম্পানিটিতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টেলিটকের অর্গানোগ্রামে পদ না থাকলেও অ্যাসোসিয়েট, মার্কেট কো-অর্ডিনেটর, মার্কেট প্রমোটর, অপারেটর/অ্যাসিস্ট্যান্ট, ড্রাইভার পদে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক নিয়োগ করা হয়েছে। অর্গানোগ্রাম-বহির্ভূত এসব কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ ৬ কোটি ৩৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের পূর্বানুমতি ছাড়াই প্রতি বছর প্রতিটি পদে জনবল বৃদ্ধি করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে সরকারি বিধি অনুসরণ ছাড়াই গঠিত নিয়োগ কমিটি দ্বারা ৫টি পদে ১৩০ জনবল নিয়োগ করা হয়। টেলিটক থেকে উদ্ধারকৃত চাকরিপ্রত্যাশীদের টেবুলেশন শিটসহ প্রয়োজনীয় নথির বরাত দিয়ে অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, লিখিত পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়েছে। আবার লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে ওই প্রার্থীকে সিলেকশন করা হয়েছে। এ ছাড়া অর্গানোগ্রাম-বহির্ভূত ওই নিয়োগে সরকারের কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি নিয়োগপ্রাপ্তদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রদান করার ক্ষেত্রেও কোনো মান বজায় রাখা হয়নি। তবে টেলিটক দাবি করেছে, পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক কয়েকজন পরিচালক নিয়ে নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়। ওই নিয়োগে টেলিটক বোর্ডের কোনো নির্দেশনা ছিল না। এ কারণে সরকারি কোটা অনুসরণ করা হয়নি।

গত ৮ বছর ধরে নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতার অবসান না হলেও সর্বশেষ অতিসম্প্রতি টেলিটকের কর্মীদের বেতন আরেক দফা বেড়েছে। সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ২০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা বাস্তবায়ন করেছে টেলিটক কর্তৃপক্ষ। যদিও সরকারী বেতন স্কেলে নয়, স্বাধীন বেতন কাঠামোতে চলে টেলিটক। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ি গত বছরের ১ জুলাই থেকে এই মহার্ঘ্য ভাতা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনের সঙ্গে বকেয়া ৮ মাসের এরিয়ার বিলও পরিশোধ করেছে টেলিটক কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষনা করে টেলিটক। সেই থেকে ওই বেতন কাঠামোতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন টেলিটকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জানা গেছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই ২০ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ওই মাসেই বেতনের সঙ্গে বর্ধিত বেতন ও মহার্ঘ্য ভাতার ৮ মাসের এরিয়ারের টাকা পরিশোধ করে কর্তৃপক্ষ। পরিচালনা পর্ষদের ওই বৈঠকে মহার্ঘ্য ভাতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

একজন সদস্য মহার্ঘ্য ভাতা বাস্তবায়নের বিরোধীতা করে বলেন, টেলিটক স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মহার্ঘ্য ভাতা দিতে বাধ্য নয়। তারা না দিলেও কোন ক্ষতি নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, টেলিটক চলে নিজস্ব বেতন কাঠামোতে। এটা সরকারী বেতন কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বৈঠক সূত্র জানায়, অধিকাংশ সদস্য মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার পক্ষে মত দেন। কারণ হিসেবে তারা যুক্তি দেখান, স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে মহার্ঘ্য ভাতা বাস্তবায়নের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, কোন কর্মী যদি পরে কোন দিন আদালতে মামলা করেন এবং আদালত মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার পক্ষে রায় দেন তাহলে টেলিটককে এককালীন বিপুল পরিমান টাকা পরিশোধ করতে হবে। তার চেয়ে আগেই এটি বাস্তবায়ন করা উচিৎ।

এ ব্যাপারে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবর রহমান বলেন, বর্তমানে টেলিটক একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর মহার্ঘ্য ভাতার এই সিদ্ধান্ত অন্য রাষ্ট্রীয় মালিকনাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। তাই আমরা আমাদের কর্মীদের প্রাপ্ত নিশ্চিত করেছি। এতে করে কর্মীরা কাজে আরো বেশী মনোযোগী হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। মুজিবর রহমান বলেন, বোর্ডের বৈঠকে অধিকাংশ সদস্যই মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার পক্ষে মত দেন। ফলে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, টেলিটকের নীরিক্ষা প্র্তিবেদন অনুসারে, ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে টেলিটক বাংলাদেশ লিঃ এর রাজস্ব ছিল ৩৫৭ কোটি টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে এই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬০ কোটি টাকায়। এছাড়াও ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে কর পূর্ব মুনাফা ২৭ কোটি টাকা থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে দুই দশমিক ৭৫ গুণ বেড়েছে। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে নেট মুনাফা হয়েছে ৪৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top