সকল মেনু

তিস্তার আরও পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত

ঢাকা, ১৩ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা তো দূর অস্ত, আগে যেটুকু পানি পেত বাংলাদেশ এবার সেটিও বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন যে নামমাত্র পানি দেয়া হয়, তা থেকে আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে দেশটি। আর এতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ন্যূনতম সম্ভাবনাও ধুলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে। এমনি দুঃসংবাদ মিলেছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের ৫৭তম বৈঠকে। মঙ্গল ও বুধবার ভারতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

অথচ এ মুহূর্তে তিস্তায় যেখানে ৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা, তখন মাত্র ৫০০ কিউসেক অর্থাৎ ১০ ভাগের মাত্র এক ভাগ পানি পাচ্ছে বাংলাদেশ, যা ইতিহাসের সর্বনিু। তা থেকে আরও পানি কমে গেলে বাংলাদেশ অংশে ধুঁকতে থাকা এ নদীটির মৃত্যুই ঘটবে। নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়ার সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। চরম বিপর্যয় ঘটবে এখানকার কৃষিতে। কয়েক লাখ মৎস্যজীবীসহ কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসবে অন্ধকার।
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক নিয়ে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার তথ্য-উপাত্ত। ‘তিস্তা অ্যা থর্ন ইন ইন্দো-বাংলা টাইস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বুধবার টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন পরিকল্পনার কারণে শিগগির তিস্তার ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশের পাওয়ার আশা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কেবল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতাই করেনি, দুই দেশের অভিন্ন এ নদী থেকে আরও বেশি পানি টেনে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গের (ভারতের) কৃষকদের কাছে সেচের পানি পৌঁছে দিতে তারা তিস্তার পানি ব্যবহার করবে। আর এমনটি হলে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসবে, কমবে অন্তত ১০ শতাংশ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। বরং মিয়ানমারে বিমসটেক সম্মেলনে ৪ মার্চ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আপাতত’ তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না।
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে মঙ্গলবার গঙ্গার (বাংলাদেশে পদ্মা) পানি বণ্টন ছাড়াও তিস্তা চুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় দুই দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে। ঢাকার পক্ষে প্রতিনিধি দলের প্রধান সাজ্জাদ হোসেন ভারতীয় দৈনিকটিকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কৃষকরা সেচের পানি সংকটে ভুগছেন। কৃষকদের ক্ষোভের মুখে প্রশাসনিক কাজকর্মও স্থবির হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, রংপুরে তিস্তার পানি প্রবাহের স্বাভাবিক হার ছিল পাঁচ হাজার কিউসেক। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের রংপুর অংশে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫০০ কিউসেক।
কমিশনের বৈঠকের দ্বিতীয় দিন বুধবারও অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিস্তার পানি বণ্টনের প্রসঙ্গও উঠে আসে। তবে এদিনও আগের দিনের মতোই নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ প্রতিমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, তিস্তা দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয়, তাতে আমাদের সেচের চাহিদাই পূরণ করতে পারি না। আবাদ বাড়াতে হলে আমাদের জমিতে সেচ আরও বাড়াতে হবে।
পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমাদের দেড় লাখ একর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আগামী বছর এ লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো হবে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সেচের চাহিদা মেটাতে আমাদের আরও পানি প্রয়োজন, যা আসবে তিস্তা থেকে। তিনি প্রশ্ন করেন, নিজেদের চাহিদা না মিটিয়ে আমরা কিভাবে বাংলাদেশকে পানি দিই? রাজীব বলেন, সেজন্যই আমরা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে আসছি। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের কৃষকদের ভোগান্তিতে রাখতে পারি না।

বিপরীতে সাজ্জাদ হোসেন বলছেন, পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া কোনোভাবেই তিস্তা থেকে সমপরিমাণ পানি পাবে না বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ অনুযায়ীও ভাটির দেশেরও সমপরিমাণ পানি পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে মনে করিয়ে দেন বাংলাদেশের এ প্রতিনিধি।

ভারতের প্রতিনিধি দলে থাকা একজন কর্মকর্তার নজরে বিষয়টি আনলে তার মুখেও প্রতিধ্বনি বাজে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি স্বীকার করেন, ‘তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রসহ যেসব নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেসব নদীর সমপরিমাণ পানির অধিকার রয়েছে দেশটির।’ ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা এও স্বীকার করেন, পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে তিস্তার পানি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে তা অন্যায়, অসঙ্গত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত তিস্তা চুক্তি করতে রাজি হওয়া।

বৈঠকে ফারাক্কা বাঁধ ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজে গঙ্গার পানিপ্রবাহ পর্যালোচনা করা হয়। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের মহাব্যবস্থাপক সৌমিত্র কুমার হালদার জানান, গঙ্গার পানিপ্রবাহ নিয়ে এবার তেমন কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশ সঠিক পরিমাণে পানি পাচ্ছে। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এ সময় খরা মৌসুমে, বিশেষ করে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার পক্ষে জোর দেয়। সাজ্জাদ বলেন, নেপালের সপ্তখুশিতে তৈরি হতে যাওয়া ইন্দো-নেপাল বাঁধে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ।

নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিস্তায় বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৮০ হাজার কিউসেক এবং শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিু ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর চিত্র ভিন্ন। তিস্তা থেকে ভারত পানি সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই তা কমতে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী অর্ধেক পানি পেলেও এ মুহূর্তে অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।

১৯৯০ সালে নীলফামারী ও লালমনিরহাটসহ ৬ জেলার ৬ দশমিক ৩২ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে তিস্তা সেচ প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এখানে দেড় লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে এ প্রকল্পে সাড়ে ৩ হাজার কিউসেকের বেশি পানি প্রয়োজন। এছাড়া নদী বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন আরও দেড় থেকে দু’হাজার কিউসেক পানি। অথচ সঙ্কটের কারণে গত বছর এ সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহের পরিমাণ মাত্র ৪৫০ কিউসেকে নেমে এসেছিল। তিস্তার পানি সরিয়ে ভারত বর্তমানে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদা জেলায় ৯ দশমিক ২২ হেক্টর জমিতে সেচ দিচ্ছে। এছাড়া পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে আরও দুটি নদীতে।

সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ তিস্তা ব্যারাজে : আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি একেএম মঈনুল হক ও হাতীবান্ধা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান দুলাল জানান, ধু-ধু বালুচরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ডালিয়া-দোয়ানীতে অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ। মূল ব্যারাজের ৫৪টি গেট খোলা থাকলেও পানি নেই ক্যানেলে। এ কারণে ব্যারাজ কমান্ড এলাকার দেড় লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া যাচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, বছরের এ সময়ে তিস্তায় সাড়ে ৫ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা। অথচ এখন মাত্র ৫শ’ কিউসেকের কিছু বেশি পানি আছে, যা চাহিদার ১০ ভাগ মাত্র। ফলে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো আবাদ কেবল সেচের অভাবে মরতে বসেছে। কৃষকরা কষ্ট করা ফসল রক্ষায় ধরনা দিয়ে আসছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। ওই সব এলাকায় আঞ্চলিক সড়ক, মহাসড়কে কৃষকরা বিক্ষোভ করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, তিস্তার বুকজুড়ে এখন শুধু চর আর চর। কোথাও একটু পানি থাকলেও সে াতের বালাই নেই। তিস্তা ব্যারাজের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে জেআরসির বৈঠকে তুলে ধরা হলেও আজও এর কূলকিনারা করা যায়নি। এখানকার সহকারী প্রকৌশলী মইন উদ্দিন মণ্ডল জানান, বর্তমানে তিস্তা ব্যারাজে সর্বনিম্ন পানির প্রবাহ রয়েছে, তবে তিনি সঠিক পরিমাণ না জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

ব্যারাজ এলাকার কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে পানির অভাবে এ অঞ্চলে আবাদ মার খাচ্ছিল। পানির অভাবে এসব এলাকায় মরুকরণ শুরু হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। তিস্তার সঙ্গে সংযুক্ত শাখা নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাবে বলে পরিবেশবিদরা আশংকা করছেন।

তিস্তা ব্যারাজ সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীর উৎসমুখে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। শুধু তাই নয়, ভারত দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের মাধ্যমে এক হাজার ৫শ’ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ভারত-বাংলাদেশ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। সেই মোতাবেক তিস্তার পানি শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত ও বাকি ২৫ ভাগ সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু কাজীর গরু কেতাবে আছে বাস্তবে নেই। এরপর তিস্তার পানি নিয়ে আরেক দফা চুক্তি কেবল আশ্বাসেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিপরীতে পানি না পাওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে।(যুগান্তর)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top