সকল মেনু

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলিন হওয়ার পথে ৩শ’ বছরের ঐতিহ্য শিবমন্দির

রিপন হোসেন, যশোর থেকে: অযত্নে-অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলিন হয়ে যেতে বসেছে প্রায় ৩শ’ বছরের পুরনো যশোরের অভয়নগরে অবস্থিত ১১ শিবমন্দির। ভৈরব নদের পাড়ে মনোরম পরিবেশে অবস্থিত মন্দির এলাকার বেশ কিছু  জমি ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। চুরি আর লুটপাট হয়ে গেছে মন্দিরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন শিবলিঙ্গসহ মূল্যবান বহু মালামাল। ধ্বসে পড়ছে ইট-সুরকি। এক সময় যেখানে নিয়মিত পূজা অর্চনা হতো এখন সেটি শাপ-পোকামাকড় আর চামচিকার বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। সনাতন ধর্মের ভক্তরা কোন ক্রমে একটি মন্দিরে  এখনো জোড়া তালি দিয়ে নিত্য পুজা দিয়ে আসলেও সেটিও যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে বলে আশংকা  অভয়নগর গ্রামের মানুষের। তা থেকে ঘটতে পারে প্রাণহানিও। দেশের অনন্য স্থাপনা যশোরের অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির  রক্ষা করতে পারলে তা হবে এই অঞ্চলের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সনাতন ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্যপ্রেমী মানুষরা এখান থেকে জানতে পারবেন যশোরের রাজা-রানীদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য।
যশোর শহর থেকে খুলনার দিকে যেতে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দুরে  ভৈরব নদের  উত্তর পাড়ে অবস্থিত অভয়নগর গ্রাম। জে জে আই মিল ঘাট পার হয়ে ভৈরব নদের পাড়েই  অভয়নগর  গ্রামের মনোনরম পরিবেশে অবস্থিত ১১ শিবমন্দির। ইতিহাস অনুযায়ী ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে যশোরের চাঁচড়ার রাজা নীলকণ্ঠ রায় এই ১১ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হিসাবে মন্দিরগুলোর বয়স প্রায় ৩শ’ বছরের বেশী। চাঁচড়ায় রাজধানী হলেও খুলনাসহ সুন্দর বনের বিশাল একটি অংশ শাষণ করার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় বসবাসের জন্য অভয়নগরের ভৈরব পাড়ের মনোরম পরিবেশে আরো একটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোর –  খুলনার ইতিহাস নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের পরবর্তী প্রজন্মের রাজা নীলকণ্ঠের অতি আদরের এক মেয়ের নাম ছিল অভয়া। রাজা নীলকন্ঠ তার মেয়ে অভয়াকে নড়াইলের জমিদার পূত্র নীলাম্বর রায়ের সাথে বিয়ে দেন। মহা ধুমধামে অভয়নগরের রাজবাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয় অভয়া দেবীর বিয়ে ও বিয়ে উত্তর ভোজন। এই অঞ্চলের জমিদার ও তাদের পাইক বরগনদাজরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যে দূরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন স্বামী নীলাম্বর । ফলে অল্প বয়সেই বিধবা হন অভয়াদেবী। তখন হিন্দু ধর্মে দ্বিতীয় বিবাহের কোন বিধান না থাকায় রাজকন্যা বাকি জীবন শিবের পূজা অর্চনা করে কাটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে পিতা নীলকণ্ঠ রায় অভয়নগরের জমিদার বাড়ির পাশে মেয়ের জন্য ১১টি শিবমন্দির নির্মাণ করে দেন। আধুনিক শিল্প স্থাপত্যেও এক অপূর্ব নিদর্শন এই  ১১টি শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে রাজা নীলকন্ঠ রায় এখানে একটি নগরীও তৈরী করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেই নগরীর নাম দেওয়া হয় রাজকন্যা অভয়ার নামনুসারে অভয়নগর। রাজকন্যা আর ১১ শিব মন্দিরের নিরাপত্তা আর রক্ষানাবেক্ষনে এখানে জমিদার নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীও নিয়োগ করেন। ১১টি শিব মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন ১১টি কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ। এছাড়া বিভিন্ন প্রকারের দেব দেবীদের জন্য আলাদা আলাদা মন্দিরও স্থাপন করেন রাজা নীলকন্ঠ রায়। কথিত আছে কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের শ্বশুরালয় খুলনার ফুলতলার জমিদারদের সাথে এই অভয়নগরের অভয়া দেবী ও তার শ্বশুর কুলের আতœীয়তার সম্পর্ক ছিলো। এখানে পৃথিবীর বহু দেশের নামী দামী লোকের আনাগোনা ছিলো। ইতিহাস থেকে জানা যায় জোড়া সাকোর ঠাকুর পরিবারের সাথেও যশোরের জমিদার রাজা প্রতাপাদিত্যের যোগাযোগ ছিল।  নদী পদে কলকাতার সাথে খুলনার যোগাযোগ আর তার মাঝখানে অভয়া দেবীর ১১ শিব মন্দির। ফলে এ পথে যারাই যাতাযাত করতেন একবারের জন্য হলেও তারা এই শিব মন্দির গুলো পরিদর্শন করে নিজেদের তৃপ্ত করতেন। ফলে দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী আসার কারনে এটি অল্প দিইে একটি পরিচিত স্থানে পরিনত হয়।  এক পর্যায়ে অভয়াদেবীর মৃত্যু আর রাজপ্রথার বিলুপ্তির কারনে নির্জন শ্মশানে পরিনত হয় অভয়নগর। ব্রিটিশ শাষনামলের শেষ দিকে আবারো অভয়নগরকে জাগ্রত করতে এই ১১ শিব মন্দিরকে ঘিরে নেয়া হয় নান উদ্যোগ। দেশ বিভাগের পর এই অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করলে জৈলুস হারায় অভয়নগর আর ১১ শিব মন্দির। এক পর্যায়ে অভয়নগর থেকে সব কিছু স্থানান্তর করা হয় আজকের নওয়াপাড়া শহরে। ফলে পিছনে নদীর উত্তর প্রান্তে পড়ে থাকে অভয়াদেবীর স্মৃতি বিজড়িত ১১ শিব মন্দিরসহ বিশাল জমিদার বাড়ি। কালে কালে সেই জমিদার বাড়িটি বিলীন হয়েছে দখলদারিত্ব আর লুটপাটের স্রোতে। এখন পড়ে আছে তার ধ্বংসাবশেষ। এতো কিছুর পরও  ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ১১টি নান্দনিক নির্মান শৈলীর শিব মন্দিও গুলো। ১০ টি পরিত্যক্ত। আর একটিকে কোন ক্রমে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে স্থানীয়রা নিত্য পূজা অর্চনা করেন। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে এখনো বসে মেলা আর পূজা পার্বণ। দূর দূরান্ত থেকে এখনো হাজারো ভক্তবৃন্দের পদ চারনায় মুখরিত হয় অভয়দেবীর ১১ শিব মিন্দর প্রাঙ্গন। অতিথিরা কিছু সময়ের জন্যে হলেও হারিয়ে যান ইতিহাসেন অতল গহব্বরে। খুজে ফেরেন মন্দিরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। কিন্তু তা সবই তাদের দুঃখের কারন হয়ে দাঁড়ায়। কারন এটি রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে শাপ পোকা মাকড় আর চামচিকার বাস স্থানে পরিনত হয়েছে।
ইতিহাসের সূত্র ধরে একদিন জ্ঞান তৃষ্ণা মেটাতে বেরিয়ে পড়ি ১১ শিব মন্দিরেরর খোঁজে। খোঁজ খবর নিয়ে নওয়াপাড়া শহরের জেজেআই মিল ঘাট পার হতেই দেখা হলো স্থানীয়  সাংবাদিক ইমরান আর তার বন্ধু শোভনের সাথে। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরেই তারা জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছি। ১১ শিব মন্দিরের কথা বলতেই তারা হেঁসে উঠলেন। তারপর কথা বার্তা শেষে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন ভৈরব নদের অদূরে অবস্থিত ১১ শিব মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। ইতহাসের সাথে মিল থাকলেও তার কোন লেশ মাত্র আজ আর অবশিষ্ট নেই। মনে হচ্ছে কোন ধ্বংস নগরী অথবা বনজঙ্গলে প্রবেশ করেছি। ধীরে ধিরে বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলো। হঠাৎ করে একটি মন্দির থেকে কানে এলা শঙ্খ বাজানোর শব্দ। জানতে পারলাম ওই একটি মন্দিরে এখনো নিত্য পূজা অর্চনা করেন অভয়নগর গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বাকী ১০টি মন্দির ঝোপজঙ্গলে ভরা। সেগুলো থেকে পলেস্তরা আর ইট সুরকি খুলে পড়ছে। প্রশ্ন করতেই আশি বছরের বৃদ্ধ শিবপদ সরকার বললেন, “কি করবো বাবা বহু বার বহু জনকে এসব কথা বলেছি। কোন কাজ হয়নি। এই মন্দির গুলো শুধু আমাদের নয় গোটা বাংলাদেশের সম্পদ। এ গুলো রক্ষনাবেক্ষন করতে পারলে দেশের নতুন প্রজন্ম এগুলো দেখে আমাদের অতীত সম্পর্কে জানতে পারতো। সনাতন ধর্মের মানুষের কাছে এটি একটি তীর্থ স্থানে পরিণত হতো।” যুবক প্রদীপ কুমার রায় জানালেন তার ক্ষোভের কথা। তিনি বললেন, এসব শুনে কি করবেন। এই মন্দিরের বহু সম্পত্তি ছিলো। ছিলো জমিদার বাড়ি, পুলিশ ফাঁড়ি। সব দখল হয়ে গেছে। এই মন্দিরের জায়গা টুকু বাদে কোন জমি আর দখল হতে বাদ নেই। এই মন্দির গুলোও দখল করে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। না-জানি কে কবে বন্দোবস্ত নিয়ে আসে।”
অনুসন্ধানে জানা গেল রক্ষনাবেক্ষণ আর তদারকির অভাবে মন্দিরগুলো থেকে চুরি হয়েগেছে শিবলিঙ্গসহ সব মূল্যবান মালামাল। নেই জানালা দরজা গুলোও। মন্দিরের নামে প্রায় ১২শ’ বিঘা জমি ছিল। তার অনেক আগেই বেহাত হয়ে গেছে। শুধু  প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে ১১টি মন্দির দাঁড়িয়ে থাকলেও তার শুধু কাঠামো ছাড়া আর কিছু নেই। ধবসে পড়ছে গাথুনি।
তারপরো প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসেন প্রাচীন এ ঐহিত্য দেখতে। কিন্তু মন্দিরের দৈন্যদশা দেখে তারা ব্যথিত হন।
বছর কয়েক আগে প্রত্নতাত্বিক বিভাগ মন্দিরগুলোর সংস্কারের উদ্যোগ নিলে খুশি হন এলাকার মানুষ। তারা মনে করেছিনে এবার হয়তো মন্দিরগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু সে উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেনি।
স্থানীয় শিবভক্তরা কোন ক্রমে একটি মন্দিরে নিত্যপুজা করে আসছেন। কিন্তু সেটির অবস্থাও করুন। স্থানীয়দের আশংকা মন্দিরগুলো যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে। সেই সাথে হারিয়ে যেতে পারে ৩শ’ বছরেরও বেশী সময়কার ইতিহাস আর  ঐহিত্য। এজন্য তাদের দাবি- দ্রুত এগুলো সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হক মোল্যা বাঘা বলেন, বহু বার এটি সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এই মন্দির সংস্কারে একটি প্রকল্প তৈরী করে তা উচ্চ মহলের অনুমোদনের জন্য পাঠান। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তিনি মনে করেন এই মন্দির গুলো সংস্কার করে যদি দেশের পর্যটন কর্পোরেশন একপি প্রকল্প হাতে নেয় তাহলে এটি রক্ষা করা সম্ভব। এই মন্দিরকে অবলম্বন করে অভয়নগরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারলে তা হবে দেশ ও দশের জন্য একটি বড় কাজ।  উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুষমা সুলতানা বলেন, এই বিষয়টি তার জানা ছিলো না। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে ইতিমধ্যে তিনি ওই মন্দির প্রাঙ্গন পরিদর্শন করে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে ও ইতিহাস পড়ে সব কিছু জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন আসলে এইট একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই ১১ শিব মন্দির রক্ষা করতে সরকারী উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। এগুলো রক্ষা করতে পারলে এটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিনত হবে। তিনি বলেন, তার জানা মতে দেশের আর কোথাও একই স্থানে এভাবে নানন্দনিকতা পূর্ণ ১১টি শিব মন্দির নেই। দেশের শিব ভক্তদের কাছে এটি তুলে ধরতে পারলে তা হভে একটি নজির বিহীন উদ্যোগ। সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে। দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে অভয়নগর এক ধর্মীয় স্থানের মর্যাদা পাবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি ইউএনও কে দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরী করে ইতিমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করেছেন। এটি এখন সরকারের বিবেচ্য বিষয়। তবে তিনি এই মন্দির গুলো সংস্কারে  যথাসম্ভব দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন এগুলো সংস্কার করতে পারলে দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবে। অভয়নগর তথা যশোর গোটা অঞ্চলের মধ্যে একটি বিশেষ স্থানে পরিণত হবে।
যথাযথ তদারকি ও সংস্কার না করলে হারিয়ে যাবে অভয়নগরের ১১ শিবমন্দিরের ঐতিহ্য। একমাত্র সরকারি হস্তক্ষেপেই বন্ধ হতে পারে এর ধংসযজ্ঞ। এ অবস্থায় প্রায় ৩শ’ বছরের পুরনো মন্দিরগুলো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদেক্ষপ নেবে-এমনটাই প্রত্যাশা অভয়নগরসহ এই অঞ্চলের কোটি মানুষের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top