সকল মেনু

দিশাহারা ইসির বোধোদয়

ঢাকা, ১২ মার্চ  (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দিশাহারা অবস্থায় পড়েছে। ভোটে বেপরোয়াভাবে দলীয় প্রভাব খাটানো, আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সহিংসতা থামাতে গিয়ে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে ইসি। ব্যর্থ হয়ে তারা এখন বলছে, ‘কয়েক ধাপে এ নির্বাচন করার পরিকল্পনা আসলে ভুল ছিল। গতবারের মতো এক দিনে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা হলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না।’

নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের কাছে এসব মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে গতকাল ইসি যেমন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছে, সেই ধরনের ব্যবস্থা আরো কয়েকটি উপজেলার ক্ষেত্রেও নেওয়া হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার বন্ধ করার জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সম্পাদক বা মহাসচিবের কাছে ইসির পক্ষ থেকে লিখিত অনুরোধ জানানোর চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কাছে এ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধের অনুরোধ জানানো হতে পারে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ইসি সচিবালয়ে এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ওই বৈঠকে টাঙ্গাইল-৮ উপনির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইসি কর্মকর্তারা আলোচনা করবেন। বৈঠকে উপজেলা নির্বাচনের সাম্প্রতিক অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়েও কথা হবে বলে ইসি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

তবে ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, এ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ইসির গা-ছাড়া ভাব পরিস্থিতির অবনতির জন্য অনেকটাই দায়ী। এত বড় একটি নির্বাচন ফেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখন যুক্তরাষ্ট্রে সস্ত্রীক সফরে রয়েছেন। এ ছাড়া ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষক ছিল। নির্বাচন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ওই পর্যবেক্ষক দল গঠন করা হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ সেলও চালু ছিল। স্থানীয় প্রশাসন ও রিটার্নিং অফিসারদের প্রতিবেদনের ওপর ভরসা না করে নিজস্ব কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনের আলোকে সেই সময় ইসি ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু এবার মাঠপর্যায়ের প্রকৃত অবস্থার কথা অনেক ক্ষেত্রে ইসির অজানাই থেকে যাচ্ছে। এবার ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষক এবং কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ সেল নেই। সংবাদপত্রে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনও নির্বাচন কমিশনারদের কাছে সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না বা তাঁদের কাছে এসব প্রতিবেদন তেমন গুরুত্ব পায় না। রিটার্নিং অফিসারদের পাঠানো প্রতিবেদনের আলোকেই নির্বাচন কমিশনাররা বলে আসছিলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ইসি সচিবালয়ের প্রার্থীদের অভিযোগ-আবেদনও ছিল গুরুত্বহীন। কিন্তু নির্বাচনী সহিংসতার সাম্প্রতিক কিছু ব্যাপক আলোচিত ঘটনা এবং সরেজমিন নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শনের পর নির্বাচন কমিশনাররা এখন কিছু করার তাগিদ বোধ করছেন।

গত ৭ মার্চ কালের কণ্ঠে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় স্কুল বন্ধ করে শিক্ষক ও পোলিং অফিসারদের ‘নির্বাচনী বনভোজনে’ আওয়ামী লীগ সমর্থিত তিন প্রার্থীর সঙ্গে স্থানীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর অংশগ্রহণের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। জানা গেছে, সিইসির রুটিন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক সেই প্রতিবেদনটি পড়ে দেখার জন্য ইসির জনসংযোগ শাখা থেকে কপি সংগ্রহ করেন গতকাল মঙ্গলবার। শ্রীপুরের নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।

অভিযোগের স্তূপ : এদিকে উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পছন্দের প্রার্থীদের বিশেষ নির্বাচনী সুবিধা দেওয়া, আচরণবিধি লঙ্ঘন সত্ত্বেও ব্যবস্থা না নেওয়া, প্রতিপক্ষকে হয়রানি করাসহ নানা গুরুতর অভিযোগ এনেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এমনকি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। প্রার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক ধরপাকড় ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। এতে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছেন না অনেক প্রার্থী। প্রতিদিনই এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ ইসিতে পাঠাচ্ছেন প্রার্থীরা। তাঁরা কমিশনের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন।

ফেনীর রিটার্নিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দায়ের করেছেন ফুলগাজী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. কামাল উদ্দিন। তাঁর অভিযোগ, রিটার্নিং অফিসার বিশেষ প্রার্থীর প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করেছেন এবং বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর অনৈতিক ও অন্যায় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে তাঁকে সরিয়ে একজন সৎ কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দিতে ইসির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের বিরুদ্ধে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও সরকারি সুবিধা ব্যবহার, উন্নয়ন কাজের ফলক উন্মোচন, রঙিন পোস্টার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ফুলগাজী উপজেলায় আগামী ২৩ মার্চ ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনজন প্রার্থী। ইসিতে তাঁদের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, রিটার্নিং অফিসার প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। তাঁকে বদলির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। শাল্লা উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ২৩ মার্চ।

ওদিকে নাঙ্গলকোট থানার ওসি নজরুল ইসলামের অপসারণ চেয়ে ইসিতে আবেদন করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী নাজমুল হাছান বাছির ভূঁইয়া। তিনি বলেছেন, অতীতেও নানা ধরনের গুরুতর অপরাধের অভিযোগে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। পৌরসভা নির্বাচনের সময় তিনি এক প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করে সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি আবারও এ থানায় যোগদান করায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন এলাকার ভোটার ও প্রার্থীরা। এ ধরনের অনেক অভিযোগ প্রতিদিনই কমিশন সচিবালয়ে জমা হচ্ছে।

কমিশনার বলেন… : নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তেমন অভিযোগ ওঠেনি। দ্বিতীয় ধাপে কিছুটা সহিংসতা হয়েছে। পরবর্তী তিনটি ধাপের নির্বাচন নিয়ে কমিশনও উদ্বিগ্ন।

কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, ‘এবার একাধিক ধাপে নির্বাচন করার জন্যই সমস্যা বেশি হচ্ছে। প্রথম দুটি ধাপের নির্বাচনের ফল পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এক দল আগের দুই ধাপের ফলাফলে উজ্জ্বীবিত। আর অন্য দলের জন্য এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মর্যাদার লড়াই। দুই দলই এখন এ নির্বাচন নিয়ে মরিয়া। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও একাধিক ধাপে নির্বাচন হয়। কিন্তু ফল ঘোষণা হয় পরে। এতে সমস্যা হয় না। তা ছাড়া তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পার্থক্যও বিস্তর।’

কেন একাধিক ধাপে এ নির্বাচন করতে গেলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, ক্রিকেট খেলা, বাণিজ্য মেলা এসব কারণে আমাদের একাধিক ধাপে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করেই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তা ছাড়া উপজেলাগুলোর মেয়াদও এক নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩২৭টির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।’
নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের অবস্থা অনেকটা ভালো। কিন্তু বেশি সমস্যা নোয়াখালী ও দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে। নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসকরা সবাই সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সার্বিক নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আজকেও (গতকাল) আলোচনা করেছি। যেখানে সমস্যা দেখা দেবে, সেখানে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ নির্বাচনে এমপি, মন্ত্রীদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা টেলিফোনে সমাধানের চেষ্টা চালিয়েছি। এখন চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে এ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে বলা হতে পারে।

অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা নির্বাচনে দলভিত্তিক প্রার্থী মনোনয়ন বা সমর্থন প্রদান, চাপ সৃষ্টি করে কোনো প্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা বা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে দল থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নীরব। এ প্রসঙ্গে কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, বড় দুই দলই এটা করছে। এ ক্ষেত্রে দুই দলেরই সতর্ক হওয়া দরকার।

প্রসঙ্গত, এ মাসেই আরো তিনটি ধাপে উপজেলা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তৃতীয় ধাপে ৪২টি জেলার ৮৩টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে আগামী ১৫ মার্চ। চতুর্থ দফায় ৪৩টি জেলার ৯২ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ২৩ মার্চ। সবশেষে ৩১ মার্চ হবে পঞ্চম দফায় ৭৩ উপজেলায় ভোটগ্রহণ।(কালের কন্ঠ)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top