সকল মেনু

পান্থ শাহরিয়ার পালাতে চান না

 আফিফা জামান, ঢাকা, ১০ মার্চ :  ধারাবাহিক নাটক বন্ধন-এর কথা কি মনে আছে? আফসানা মিমি পরিচালিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ছিল এটি। এতে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, জাহিদ হাসান, আজাদ আবুল কালাম, ইন্তেখাব দিনার প্রমুখ। নাটকটি সম্প্রচার হয়েছিল একুশে টেলিভিশনে। তবে যখন নাটকটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, গল্প মোড় নিচ্ছে নতুন ঠিকানায় ঠিক তখনই বন্ধ হয়ে যায় দেশের প্রথম সারির এই বেসরকারি চ্যানেলটি। তবে গল্পের গুণে নাটকটি সম্প্রচারের শুরু থেকেই বিশেষভাবে আলোচিত হতে থাকে বোদ্ধা মহলে। নাটকটি লিখেছিলেন সে সময়ের এক তরুণ। নাম তার পান্থ শাহরিয়ার।

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম নাটকটির পরিণতি সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘আমার লেখা প্রথম ধারাবাহিক ছিল বন্ধন।  সেটা ২০০০ সালের কথা । নাটকটির সঙ্গে ছিলেন আফসানা মিমি, বিপুলদা, আবুল হায়াত, আজাদ আবুল কালাম (পাভেল ভাই), শহিদুজ্জামান সেলিম প্রমুখ। নাটকটি ৩৫ পর্ব চলার পর চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এর ৪৫ পর্ব পর্যন্ত তৈরি করা ছিল। যেহেতু চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, তাই সে সময়ের জনপ্রিয় ধারাবাহিকটির সব সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।’

এই নাট্যকারের এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫টি ধারাবাহিক নাটক লিখেছেন। তার সবগুলো ধারাবাহিকই অ্যাকশনধর্মী। তার লেখা প্রথম টিভি নাটকটি ছিল এক ঘণ্টার- জনান্তিক। সেটা ১৯৯৫ সালের কথা।

তিনি পড়ালেখা করেছেন  ম্যানেজমেন্টে। বিষয়টিতে স্নাতকোত্তর করলেও নাটক ঘিরেই তার পেশা। তার ভাষায়, ‘তখন বাংলাদেশে কোনোভাবে নাটককে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু আমি ভাবলাম, নাটকই করব। সেই ভাবনা এখন বাস্তবতা। আমি জীবনে কখনো চাকরি করিনি। চাকরির জন্য কখনো ইন্টারভিউ দিইনি। আমার ভাবনা একটাই ছিল, নাটক করব। সেটা  লিখে হোক অথবা অভিনয় করে।’

পান্থর এই ইচ্ছাবৃক্ষের বীজ রোপিত হয় ১৯৯০ সালে। সে সময় তিনি ড্রামা সার্কেলে কাজ শুরু করেন। এরপর সেই দলের হয়ে পার করেন টানা পাঁচ বছর। নাটকে অনুরক্ত ছেলেটির মনে তখন স্বপ্নের রং আরো গাঢ় হয়। থিয়েটার নিয়ে তখন তার পরিকল্পনার শেষ নেই। নিজের মেধাকে আরো শানিত করার জন্য তিনি যোগ দিলেন নাগরিকে। সে সময় নাগরিক মানেই নাট্যকর্মীদের জন্য দারুণ একটি প্ল্যাটফর্ম। সেটিকে কাজে লাগাতে রাত-দিন নাটক করা শুরু করলেন তিনি।

রাইজিংবিডির অফিসে বসেই স্মৃতির আয়নায় নিজেকে দেখলেন। এরপর জানালেন, ‘১৯৯৫-এ নাগরিকে যোগ দিলাম। তখন আমরা ২৪ ঘণ্টা থিয়েটার করি। ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করি। এরপর বিরতিহীনভাবে রাত ২টা পর্যন্ত থিয়েটারের কাজ করতে লাগলাম।’

তার দাবি, আজকে তার যা কিছু নিজের তার পেছনে বিরাট অংশ থিয়েটারের। বিশেষ করে, নাগরিক তাকে ঋদ্ধ করেছে। এই দলটির হয়ে তিনি ১৪টি নাটকে কাজ করেছেন।

নাটকটি নিয়ে তিনি যে স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন তা এখনো চলছে সমানতালে। তিনি প্রতিটি কাজ করেন ধরে ধরে। প্রতিটি কাজ নিজের আয়ত্তে নিয়েই তবে তা চূড়ান্ত করেন। বর্তমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, ‘এই মুহূর্তে কাজ চলছে কালো মকমল  নামের একটি ধারাবাহিক নাটকের। এটি প্রচারিত হবে বাংলাভিশনে । নিয়াজ মাহবুব এটি পরিচালনা করছেন।’ পাশাপাশি তিনি কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই বলেন, ‘আমি নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি।’ এই নির্মাতা এর আগে ঈদে দুটি নাটক তৈরি করেছেন। গত ঈদে তার নির্মিত সন্ধিক্ষণ শিরোনামের নাটক সম্প্রচারিত হয় এনটিভিতে। তারও আগে নাকফুল  তৈরি করেছেন। এর পাশাপাশি পান্থ শাহরিয়ারের লেখা আরেকটি ধারাবাহিকের কাজ শুরু করেছেন রুলিন রহমান।

আর একটা সুখবর দিলেন তিনি। জনপ্রিয় নাট্যকার সাগর জাহান এর আগে এক ঘণ্টার নাটক বানালেও কোনো ধারাবাহিক তৈরি করেননি। তিনি নাকি এবার ধারাবাহিক বানাবেন। আর সেটির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন পান্থ শাহরিয়ার। ধারাবাহিকটির নাম রাসকেল।

নাটক লেখা এখন পান্থ শাহরিয়ারের পেশা। তবে মঞ্চের ঘোর কাটেনি এখনো। তিনি সর্বশেষ নাগরিকের হয়ে বিজয় টেন্ডুলকারের নাটক ঘাসিরাম কোতয়াল-এ কাজ করেছেন। এ ছাড়া দলটির নিয়মিত প্রযোজনাগুলোতেও কাজ করছেন। তবে সদাচঞ্চল মানুষটি সব সময়ই বুঁদ হয়ে থাকতে চান নতুন কিছু করার আনন্দে। আর সেই নেশার টানে এবারে বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেছেন স্বাধীন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার কাজ। তার ভাষাতেই জেনে নিন, কী করতে চান তিনি :

‘এখন আমরা একটি কাজ করছি। আমরা সমসাময়িক কয়েকজন মিলে এটি করছি। এতে আছেন ত্রপা  মজুমদার, তাহনিনা ইসলাম, প্রাচ্যনাটের জাহাঙ্গীর আলম, ফয়েজ  জহির, অম্লান বিশ্বাস, সাজু খাদেম, তুষার। আমরা সবাই কাছাকাছি বয়সের। একটা প্ল্যাটফর্মের মতো তৈরি করেছি, যার নাম দিয়েছি “আগন্তুক”। নতুন এই প্ল্যাটফর্মের প্রথম প্রযোজনা অন্ধকার ও মিথেন গ্যাস।’

এখন পান্থ শাহরিয়ারের বাসার বসার ঘরে চলছে প্রযোজনাটির অনুশীলন। এটি লিখেছেন ও নির্দেশনা দিচ্ছেন পান্থ শাহরিয়ার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা যুদ্ধ শুরু করলাম। দেখা যাক কী হয়।’

চলতি মাসে ২৯ তারিখ অন্ধকার ও মিথেন গ্যাসের প্রথম প্রদর্শনী। এর আগে ২৫ মার্চ প্রযোজনাটির টেকনিক্যাল শো হবে শিল্পকলা একাডেমিতে। এর গল্প গড়ে উঠেছে ইডিপাস-এর কনটেস্ট নিয়ে। সম্পূর্ণ নাটকের শেষটা ছাড়া কোথাও ইডিপাসকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই নাটকে আমরা ইডিপাসকে দেখাতে চাইনি। আমরা বলতে চেয়েছি তার মায়ের কথা। একটা কয়লাখনিকে উপজীব্য করে গল্পটি গড়ে উঠেছে। আসলে মানুষের অন্ধকারের যে জীবন সেটাই বলার চেষ্টা করেছি। আর তাই নাটকটির নাম দিয়েছি অন্ধকার ও মিথেন গ্যাস।

নাটকটির বিষয়বস্তুকে আরো পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়লাখনির মানুষ আমাদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করে না। তাদের জীবনে অন্ধকার অনেক বেশি।’

এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কী দরকার? এর উত্তরে তার অভিমত, ‘২০১৪-তে এসেও যদি এক্সপেরিমেন্ট না করি, তাহলে এত দিন কাজ করে লাভ কী?’ তবে তার কাছে এই এক্সপেরিমেন্টের মানে হলো, ‘সবাই ভালো শার্ট পরে আর আমি ছেঁড়া শার্ট পরব, এমনটা নয়। আমি কেন শার্টটি ছিঁড়লাম তা জেনে-বুঝে তারপর সেটা করি।’

এই নাটকে অভিনয় করছেন ত্রপা মজুমদার, মোস্তাফিজ শাহিন, ঝুমা, জাহাঙ্গীর। সংগীত করছেন তুষার, মঞ্চ পরিকল্পনা করছেন ফয়েজ জহির। এবং অম্লান বিশ্বাস আছেন আলোক-পরিকল্পনায়।

তারা শুধু প্রযোজনা তৈরির মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছেন না। এখন তারা অনেক বেশি দর্শককে নাটকটি দেখাতে চান। এজন্য রীতিমতো প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন। বিশেষ করে, মঞ্চের দর্শকদের আবারও মঞ্চমুখী করতে পান্থর রয়েছে নানা পরিকল্পনা।

এ বিষয়ে তার অভিমত, ‘অনেকে বলেন থিয়েটারকে মেরে ফেলেছে টেলিভিশন। কিন্তু আমি বলব টেলিভিশন থিয়েটারের দর্শক নেয়নি। আসলে থিয়েটারই আগ্রহ বাড়াতে পারছে না । আগ্রহ তৈরি করার জন্য ক্যাম্পেইনের দরকার। আগে তো লোকজনকে জানাতে হবে।’

টিভি নাটক সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আগে চ্যানেল ছিল একটি-দুটি। আমরা সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম নাটকের জন্য । এখন দেশি চ্যানেল ২৪টি। তারপর বিদেশি চ্যানেলের চাপ তো আছেই। এর বাইরে, এখন যে-কেউ টিভি অভিনেতা। তবে তারা বেশি দিন থাকেও না। আসলে আমরা আস্তে আস্তে পচে যাচ্ছি। এই পচন রোধ করতে না পারলে একসময় টেলিভিশনের আর কোনো দর্শক থাকবে না। সেটা নিয়ে কেউ ভাবছে না । আমরা ভাবছি মাসে কত টাকা আয় করছি।’

এই সমস্যার সমাধান সম্পর্কেও তিনি বলেন, ‘এখান থেকে বের হওয়ার দায়িত্ব আমার একার নয়। তাই বলে পালিয়ে যেতেও পারব না।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top