সকল মেনু

সুরা আত-তাওবাহর শানে নুজুল

ধর্ম প্রতিবেদক, ৬ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) :

নামকরণ, শানে নুজুল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু

নামকরণ
এ সূরাটি দু’টি নামে পরিচিতঃ আত্ তাওবাহ ও আল বারাআতু। তাওবা নামকরণের কারণ, এ সূরার এক জায়গায় কতিপয় ঈমানদারের গোনাহ মাফ করার কথা বলা হয়েছে । আর এর শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করা হয়েছে বলে একে বারাআত (অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছেদ ) নামে অভিহিত করা হয়েছে।

বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ
এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লেখা হয় না। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মতভেদ ঘটেছে। তবে এ প্রসংগে ইমাম রাযীর বক্তব্যই সঠিক। তিনি লিখেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখাননি, কাজেই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তী লোকেরাও এ রীতির অনুসরণ অব্যাহত রেখেছেন। পবিত্র কুরআন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হুবহু ও সামান্যতম পরিবর্তন -পরিবর্ধন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেভাবে তিনি দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে সংরক্ষণ করার জন্য যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, এটি তার আর একটি প্রমাণ।

নাযিলের সময়কাল ও সূরার অংশসমূহ
এ সূরাটি তিনটি ভাষণের সমষ্টি । প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম রুকূর শেষ অবধি চলেছে। এর নাযিলের সময় হচ্ছে ৯ হিজরীর যিলকাদ মাস বা তার কাছাকাছি সময়। নবী (স) সে বছর হযরত আবু বকরকে (রা) আমীরুল হজ্জ নিযুক্ত করে মক্কায় রওয়ানা করে দিয়েছিলেন। এমন সময় এ ভাষণটি নাযিল হয়। তিনি সংগে সংগেই হযরত আলীকে (রা) তার পিছে পিছে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে হজ্জের সময় সারা আরবের প্রতিনিধিত্বশীল সমাবেশে তা শুনানো হয় এবং সে অনুযায়ী যে কর্মপদ্ধতি হয়েছিল তা ঘোষনা করা যায়। দ্বিতীয় ভাষণটি ৬ রুকূর শুরু থেকে ৯ রুকূর শেষ পর্যন্ত চলেছে। এটি ৯ হিজরীর রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাযিল হয়। সে সময় নবী (সা) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এখানে মুমিনদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । আর যারা মুনাফিকী বা দুর্বল ঈমান অথবা কুড়েমি ও অলসতার কারণে আল্লাহর পথে ধন-প্রাণের ক্ষতি বরদাশত করার ব্যাপারে টালবাহানা করছিল তাদেরকে কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করা হয়েছে। তৃতীয় ভাষণটি ১০ রুকু’ থেকে শুরু হয়ে সুরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর এ অংশটি নাযিল হয়। এর মধ্যে এমনও অনেকগুলো খণ্ডিত অংশ রয়েছে যেগুলো ঐ দিনগুলোতে বিভিন্ন পরিবেশে নাযিল হয় এবং পরে নবী (সা) আল্লাহর ইংগিতে সেগুলো সব একত্র করে একই ধারাবাহিক ভাষণের সাথে সংযুক্ত করে দেন। কিন্তু যেহেতু সেগুলো একই বিষয়বস্তু ও একই ঘটনাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট তাই ভাষণের ধারাবাহিকতা কোথাও ব্যাহত হতে দেখা যায় না। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। তাবুক যুদ্ধে যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করা হয়েছে। আর যে সাচ্চা ঈমানদার লোকেরা নিজেদের ঈমানের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ছিলেন ঠিকই কিন্তু আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন তিরস্কার করার সাথে সাথে তাদের ক্ষমার কথাও ঘোষনা করা হয়েছে। আয়াতগুলো যে পর্যায়ক্রমিক ধারায় নাযিল হয়েছে তার প্রোক্ষিতে প্রথম ভাষণটি সবশেষে বসানো উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়বস্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে সেটিই ছিল সবার আগে। এ জন্য কিতাব আকারে সাজাবার ক্ষেত্রে নবী (সা) তাকে প্রথমে রাখেন এবং অন্য ভাষণ দুটিকে তার পরে রাখেন।

ঐতিহাসিক পটভূমি
নাযিলের সময়-কাল নির্ধারিত হবার পর এ সূরার ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর একটু দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এ সুরার বিষয়বস্তুর সাথে যে ঘটনা পরম্পরার সম্পর্ক রয়েছে, তার সূত্রপাত ঘটেছে হোদাইবিয়ার সন্ধি থেকে। হোদাবিয়া পর্যন্ত ছ’ বছরের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফলে আরবের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকায় ইসলাম একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। হোদায়বিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এ ধর্ম বা দীন আরো বেশী নিরাপদ ও নির্ঝঞ্চাট পরিবেশে চারদিকে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে যায়। ১ এরপর ঘটনার গতিধারা দু’টি বড় বড় খাতে প্রবাহিত হয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে ঐ দু’টি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটির সম্পর্ক ছিল আরবের সাথে এবং অন্যটির রোম সাম্রাজ্যের সাথে।

আরব বিজয়
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর আরবে ইসলামের প্রচার, প্রসারের জন্য এবং ইসলামী শক্তি সুসংহত করার জন্য যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তার ফলে মাত্র দু’বছরের মধ্যেই ইসলামের প্রভাব বলয় এত বেড়ে যায় এবং তার শক্তি এতটা পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী হয়ে ওঠে যে, পুরাতন জাহেলিয়াত তার মোকাবিলায় অসহায় ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে কুরাইশদের অতি উৎসাহী লোকেরা নিজেদের পরাজয় আসন্ন দেখে আর সংযত থাকতে পারেনি। তারা হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে। এ সন্ধির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু এ চুক্তি ভংগের পর নবী (সা) তাদেরকে আর গুছিয়ে নেবার কোন সুযোগ দেননি। তিনি ৮ হিজরীর রমযান মাসে আকম্মিকভাবে মক্কা আক্রমণ করে তা দখল করে নেন। ১ এরপর প্রাচীন জাহেলী শক্তি, হোনায়েনের ময়দানে তাদের শেষ মরণকামড় দিতে চেষ্টা করে। সেখানে হাওয়াযিন , সাকীফ, নদর, জুসাম , এবং অন্যান্য কতিপয় জাহেলিয়াতপন্থী গোত্র তাদের পূর্ণ শক্তির সমাবেশ ঘটায়। এভাবে তারা মক্কা বিজয়ের পর যে সংস্কারমূলক বিপ্লবটি পূর্ণতার পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল তার পথ রোধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা ও ব্যর্থ হয়। হোনায়েন যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের সাথে সাথেই আরবের ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যায়। আর এ ফায়সালা হচ্ছে, আরবকে এখন দারুল ইসলাম হিসেবেই টিকে থাকতে হবে। এ ঘটনার পর পুরো এক বছর যেতে না যেতেই আরবের বেশীর ভাগ এলাকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে। এ অবস্থায় জাহেলী ব্যবস্থার শুধুমাত্র কতিপয় বিচ্ছিন্ন লোক দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। উত্তরে রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে সে সময় যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল তা ইসলামের এ সম্প্রসারণ ও বিজয়কে পূর্ণতায় পৌঁছুতে আরো বেশী করে সাহায্য করে। সেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দুঃসাহসিকতার সাথে ৩০ হাজারের বিরাট বাহিনী নিয়ে যান এবং রোমীয়রা যেভাবে তাঁর মুখোমুখি হবার ঝুকি না নিয়ে পিঠটান দিয়ে নিজেদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায় তাতে সারা আরবে তাঁর ও তাঁর দীনের অপ্রতিরোধ্য প্রতাপ ও অজেয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে তাবুক থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই তার কাছে একের পর এক প্রতিনিধি দল আসতে থাকে আরবের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাঁর বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকার করে। ২ এ অবস্থাটিকেই কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “যখন আল্লাহর সাহায্য এসে গেলো ও বিজয় লাভ হলো এবং তুমি দেখলে লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে।”

তাবুক অভিযান
মক্কা বিজয়ের আগেই রোম সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হোদাইবিয়ার সন্ধির পর নবী (সা) ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অংশে যেসব প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি দল গিয়েছিল উত্তর দিকে সিরিয়া সীমান্তের লাগোয়া গোত্রগুলোর মধ্য। তাদের বেশীর ভাগ ছিল খৃষ্টান এবং রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন। তারা “যাতুত তালাহ” (অথবা যাতু -আতলাহ) নামক স্থানে ১৫ জন মুসলমানকে হত্যা করে। কেবলমাত্র প্রতিনিধি দলের নেতা হযরত কাব ইবনে উমাইর গিফারী প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। একই সময়ে নবী (সা) বুসরার গবর্ণর শুরাহবিল ইবনে আমরের নামেও দাওয়াত নামা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেও তাঁর দূত হারেস ইবনে উমাইরকে হত্যা করে। এ সরদারও ছিল খৃষ্টান। এবং সরাসরি রোমের কাইসারের হুকুমের আনুগত। এসব কারণে নবী (সা) ৮ হিজরীর জমাদিউল উলা মাসে তিন হাজার মুজাহিদদের একটি সেনাবাহিনী সিরিয়া সীমান্তের দিকে পাঠান। ভবিষ্যতে এ এলাকাটি যাতে মুসলমানদের জন্য নিরাপদ হয়ে যায় এবং এখানকার লোকেরা মুসলমানদেরকে দুর্বল মনে করে তাদের ওপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করার সাহস না করে, এই ছিল তার উদ্দেশ্য । এ সেনাদলটি মা’আন নামক স্থানের কাছে পৌছার পর জানা যায় শুরাহবীল ইবনে আমর এক লাখ সেনার একটি বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের মোকাবিলায় আসছে। ওদিকে রোমের কাইসার হিমস নামক স্থানে সশরীরে উপস্থিত। তিনি নিজের ভাই থিয়েডরের নেতৃত্বে আরো এক লাখের একটি সেনাবাহিনী রওয়ানা করে দেন। কিন্তু এসব আতংকজনক খবরাখবর পাওয়ার পরও তিন হাজারের এ প্রাণোৎসর্গী ছোট্ট মুজাহিদ বাহিনীটি অগ্রসর হতেই থাকে। অবশেষে তারা মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখের বিরাট বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ অসম সাহসিকতা দেখানোর ফলে মুসলিম মুজাহিদদের পিষ্ট হয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সারা আরব দেশ এবং সমগ্র মধ্য প্রাচ্য বিষ্ময়ে স্বম্ভিত হয়ে দেখলো যে, এক ও তেত্রিশের এ মোকাবিলায়ও কাফেররা মুসলমানদের ওপর বিজয়ী হতে পারলো না। এ জিনিসটিই সিরিয়া ও তার সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী আধা স্বাধীন আরব গোত্রগুলোকে এমনকি ইরাকের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী পারস্য সম্রাটের প্রভাবাধিন নজদী গোত্রগুলোকেও ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে। তাদের হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করে। বনী সুলাইম (আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামী ছিলেন তাদের সরদার) আশজা, গাতফান, যুবইয়ান ও ফাযারাহ গোত্রের লোকেরা এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করে। এ সময়ই রোম সাম্রাজ্যের আরবীয় সৈন্য দলের একজন সেনাপতি ফারওয়া ইবনে আমর আলজুযামী মুসলমান হন। তিনি নিজের ঈমানের এমন অকাট্য প্রমাণ পেশ করেন , যা দেখে আশেপাশের সব এলাকার লোকেরা বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে পড়ে। ফারওয়ার ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে কাইসার তাকে গ্রেফতার করিয়ে নিজের দরবারে আনেন। তাঁকে দু’টি জিনিসের মধ্যে যে কোন একটি নির্বাচন করার ইখতিয়ার দেন। তাকে বলেন ইসলাম ত্যাগ করো। তাহলে তোমাকে শুধু মুক্তিই দেয়া হবে না বরং আগের পদমর্যাদাও বহাল করে দেয়া হবে। অথবা মুসলমান থোকো। কিন্তু এর ফলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তিনি ধীর স্থিরভাবে চিন্তা করে ইসালামকে নির্বাচিত করেন এবং সত্যের পথে প্রাণ বিসর্জন দেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কাইসার তার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে উদ্ভুত এক ভয়াবহ হুমকির স্বরূপ উপলব্ধি করেন, যা আরবের মাটিতে সৃষ্ট হয়ে তার সাম্রাজ্যের দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল।

পরের বছর কাইসার মুসলমানদের মুতা যুদ্ধের শাস্তি দেবার জন্য সিরিয়া সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দেন। তার অধীনে গাসসানী ও অন্যন্য আরব সরদাররা সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে । নবী (সা) এ ব্যাপারে বেখবর ছিলেন না। একেবারেই নগণ্য ও তুচ্ছ যেসব ব্যাপার ইসলামী আন্দোলনের ওপর সামন্যমতও অনুকূল বা প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে থাকে , তার প্রত্যেকেটি সম্পর্কে তিনি সর্বক্ষণ সচেতন ও সতর্ক থাকতেন। এ প্রস্তুতিগুলোর অর্থ তিনি সংগে সংগেই বুঝে ফেলেন। কোন প্রকার ইতস্তত না করেই কাইসারের বিশাল বিপুল শক্তির সাথে তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ফায়সালা করে ফেলেন। এ সময় সামান্যতম ও দুর্বলতা দেখানো হলে এতদিনকার সমস্ত মেহনত ও কাজ বরবাদ হয়ে যেতো। একদিকে হোনায়েনে আরবের যে ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষ জাহেলিয়াতের বুকে সর্বশেষ আঘাত হানা হয়েছিল তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো এবং অন্যদিকে মদীনার যে মুনাফীকরা আবু আমের রাহেবের মধ্যস্থতায় গাসসানের খ্রীস্টান বাদশাহ এবং স্বয়ং কাইসারের সাথে গোপন যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছিল। উপরন্তু যারা নিজেদের দুস্কর্মের ওপর দীনদারীর প্রলেপ লাগাবার জন্য মদীনার সংলগ্ন এলাকায় “মসজিদে দ্বিরার” ( ইসলামী মিল্লাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে তৈরী মসজিদ) নির্মাণ করেছিল, তারা পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতো। সামনের দিক থেকে কাইসার আক্রমণ করতে আসছিল। ইরানীদের পরাজিত করার পর দূরের ও কাছের সব এলাকায় তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও দাপট ছড়িয়ে পড়েছিল। এ তিনটি ভয়ংকর বিপদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইসলামের অর্জিত বিজয় অকস্মাত পরাজয়ে রূপান্তিত হয়ে যেতে পারতো। তাই, যদিও দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল, আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম, ফসল পাকার সময় কাছে এসে গিয়েছিল, সওয়ারী ও সাজ , সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল। অর্থের অভাব ছিল প্রকট এবং দুনিয়ার দু’টি বৃহত্তম শক্তির একটির মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তবুও আল্লাহর নবী এটাকে সত্যের দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা করার সময় মনে করে এ অবস্থায়ই যুদ্ধ প্রস্তুতির সাধারণ ঘোষণা জারি করে দেন। এর আগের সমস্ত যুদ্ধে নবী (সা) এর নিয়ম ছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কাউকে বলতেন না কোনদিকে যাবেন এবং কার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। বরং তিনি মদীনা থেকে বের হবার পরও অভীষ্ট মনযিলের দিকে যাবার সোজা পথ না ধরে তিনি অন্য বাঁকা পথ ধরতেন। কিন্তু এবার তিনি এ আবরণটুকু ও রাখলেন না। এবার পরিস্কার বলে দিলেন যে, রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং সিরিয়ার দিকে যেতে হবে।

এ সময়টি যে অত্যন্ত নাজুক ছিল তা আরবের সবাই অনুভব করছিল। প্রাচীন জাহেলিয়াতের প্রেমিকদের মধ্যে যারা তখনো বেঁচে ছিল তাদের জন্য এটি ছিল শেষ আশার আলো। রোম ও ইসলামের এ সংঘাতের ফলাফল কি দাঁড়ায় সে দিকেই তারা অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছিল। কারণ তারা নিজেরাও জানতো, এরপর আর কোথাও কোন দিক থেকেই আশার সমান্যতম ঝলকও দেখা দেবার কোন সম্ভবনা নেই। মুনাফিকেরাও এরি পেছনে তাদের শেষ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল । তারা নিজেদের মসজিদে দ্বিরার বানিয়ে নিয়েছিল। এরপর অপেক্ষা করছিল সিরিয়ার যুদ্ধে ইসলামের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটা মাত্রই তারা দেশের ভেতরে গোমরাহী ও অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এখানেই শেষ নয়, বরং তারা তাবুকের এ অভিযানকে ব্যর্থ করার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের কৌশলও অবলম্বন করে। এদিকে নিষ্ঠাবান মুসলমানরাও পুরোপুরি অনুভব করতে পেরেছিলেন, যে আন্দোলনের জন্য বিগত ২২বছর ধরে তারা প্রাণপাত করে এসেছেন বর্তমানে তার ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হবার সময় এসে পড়েছে। এ সময় সাহস দেখাবার অর্থ দাঁড়ায়, সারা দুনিয়ার ওপর এ আন্দোলনের দরজা খুলে যাবে অন্যদিকে এ সময় দুবর্লতা দেখাবার অর্থ দাড়ায় খোদ আরব দেশেও একে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হবে। কাজেই এ অনুভূতি সহকারে সত্যের নিবেদিত প্রাণ সিপাহীরা চরম উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম যোগাড় করার ব্যাপারে প্রত্যেকেই নিজের সামর্থের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে অংশগ্রহণ করেন। হযরত উসমান (রা) ও হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) বিপুল অর্থ দান করেন। হযরত উমর (রা) তার সারা জীবনের উপার্জনের অর্ধেক এনে রেখে দেন। হযরত আবু বকর (রা) তার সঞ্চিত সম্পদের সবটাই নবী (সা) এর সামনে পেশ করেন। গরীব সাহাবীরা মেহনত মজদুরী করে যা কামাই করতে পেরেছিলেন তার সবটুকু উৎসর্গ করেন। মেয়েরা নিজেদের গহনা খুলে নযরানা পেশ করেন। চারদিক থেকে দলে দলে আসতে থাকে প্রাণ উৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবকদের বাহিনী। তারা আবেদন জানান, বাহন ও অস্ত্র শস্ত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যারা সওয়ারী পেতেন না তারা কাঁদতে থাকতেন। তারা এমনভাবে নিজেদের আন্তরিকতা মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকতেন যার ফলে রাসূলে পাকের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো ,এ ঘটনাটি কার্যত মুমিন ও মুনাফিক চিহ্নিতকরার একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছিল । এমনকি এ সময় কোন ব্যক্তি পেছনে থেকে যাওয়ার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, ইসলামের তার সম্পর্কের দাবী সত্য কিনা সেটাই সন্দেহজনক হয়ে পড়তো। কাজেই তাবুকের পথে যাওয়ার সময় সফরের মধ্যে যেসব ব্যক্তি পেছনে থেকে যেতো সহাবায়ে কেরাম নবী (সা) এর নিকট তাদের খবর পৌছিয়ে দিতেন। এর জবাবে তিনি সংগে সংগেই স্বতস্ফূর্তভাবে বলে ফেলতেন, “যেতে দাও ,যদি তার মধ্যে ভালো কিছু থেকে থাকে,তাহলে আল্লাহ তাকে আবার তোমাদের সাথে মিলিয়ে দেবেন। আর যদি অন্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকে,তাহলে শোকর করো যে,আল্লাহ তার ভণ্ডামীপূর্ণ সাহচর্য থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন”।

৯ হিজরীর রজব মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩০ হাজারের মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার পথে রওয়ানা হন। তাঁর সাথে ছিল দশ হাজার সওয়ার। উটের সংখ্যা এত কম ছিল যে, এক একটি উটের পিঠে কয়েক জন পালাক্রমে সওয়ার হতেন। এর ওপর ছিল আবার গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা। পানির স্বল্পতা সৃষ্টি করেছিল আরো এক বাড়তি সমস্যা। কিন্তু এ নাজুক সময়ে মুসলমানরা যে সাচ্চা ও দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেন তার ফল তারা তাবুকে পৌছে পেয়ে যান। সেখানে পৌছে তারা জানতে পারেন, কাইসার ও তার অধিনস্থ সম্মুখ যুদ্ধ অবতীর্ণ হবার পরিবর্তে নিজেদের সেনা বাহিনী সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এখন এ সীমান্তে আর কোন দুশমন নেই। কাজেই এখানে যুদ্ধেরও প্রয়োজন নেই। সীরাত রচয়িতারা এ ঘটনাটিকে সাধারণত এমনভাবে লিখে গেছেন যাতে মনে হবে যেন সিরিয়া সীমান্তে রোমীয় সৈন্যদের সমাবেশ সম্পর্কে যে খবর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছে তা আদতে ভুলই ছিল। অথচ আসল ঘটনা এই যে, কাইসার সৈন্য সমাবেশ ঠিকই শুরু করেছিল। কিন্তু তার প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই যখন রসূলুল্লাহ (সা) মোকাবিলা করার জন্য পৌছে যান তখন সে সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন পথ দেখেনি। মুতার যুদ্ধে এক লাখের সাথে ৩ হাজারের মোকাবিলার যে দৃশ্য সে দেখেছিল তারপর খোদ নবী করীমের (সা) নেতৃত্বে ৩০ হাজারের যে বাহিনী এগিয়ে আসছিল সেখানে লাখ দুলাখ সৈন্য মাঠে নামিয়ে তার সাথে মোকাবিলা করার হিম্মাত তার ছিল না। কাইসারের এভাবে পিছু হটে যাওয়ার ফলে যে নৈতিক বিজয় লাভ হলো, এ পর্যায়ে নবী (সা) তাকে যথেষ্ট মনে করেন। তিনি তাবুক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সিরিয়া সীমান্তে প্রবেশ করার পরিবর্তে এ বিজয় থেকে যত দুর সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক ফায়দা হাসিল করাকেই অগ্রাধিকার দেন্ সে জন্যেই তিনি তাবুকে ২০ দিন অব্স্থান করে রোম সাম্রাজ্য ও দারুল ইসলামের মধ্যবর্তী এলাকায় যে বহু সংখ্যক ছোট ছোট রাজ্য এতদিন রোমানদের প্রভাবাধীনে ছিল । সামরিক চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যের অনুগত করদ রাজ্যে পরিণত করেন। এভাবে দুমাতুল জানদালের খৃষ্টান শাসক উকাইদির ইবনে আবদুল মালিক কিনদী,আইলার খৃষ্টান শাসক ইউহান্না ইবনে রুবাহ এবং অনুরূপ মাকনা, জারবা , ও আযরূহের খৃষ্টান শাসকরাও জিযিয়া দিয়ে মদীনার বশ্যতা স্বীকার করে। এর ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা সরাসরি রোম সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। রোম সম্রাটরা যেসব আরব গোত্রকে এ পর্যন্ত আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছিল এখন বেশীর ভাগই রোমানদের মোকাবিলায় মুসলমানদের সহযোগী হয়ে গেল। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সাথে একটি দীর্ঘ মেয়াদী সংঘর্ষে লিপ্ত হবার আগে ইসলাম সমগ্র আরবের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন ও বাঁধন মজবুত করে নেবার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়।এটাই হয় এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় লাভ। এতদিন পর্যন্ত যারা প্রকাশ্যে মুশরিকদের দলভুক্ত থেকে অথবা মুসলমানদের দলে যোগদান করে পরদার অন্তরালে মুনাফিক হিসেবে অবস্থান করে প্রাচীন জাহেলিয়াতের পুনর্বহালের আশায় দিন গুণছিল তাবুকের এ বিনা যুদ্ধে বিজয় লাভের ঘটনা তাদের কোমর ভেংগে দেয়। এ সর্বশেষ ও চুড়ান্ত হতাশার ফলে তাদের অধিকাংশের জন্য ইসলামের কোলে আশ্রয় নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর যদি বা তাদের নিজেদের ইসলামের নিয়ামতলাভের সুযোগ নাও থেকে থাকে, তবে কমপক্ষে তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য সম্পর্ণরূপে ইসলামের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। এরপর একটি নামমাত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তাদের শিরক ও জাহেলী কার্যক্রমে অবিচল থাকে । কিন্তু তারা এত বেশী হীনবল হয়ে পড়ে যে, ইসলামের যে সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য আল্লাহ তাঁর নবীকে পাঠিয়েছিলেন তার পূর্ণতা সাধনের পথে তারা সামান্যতমও বাধা সৃষ্টি করতে সমর্থ ছিল না।

আলোচ্য বিষয় ও সমস্যাবলী
এ পটভূমি সামনে রেখে আমরা সে সময় যেসব বড় বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং সূরা তাওবায় যেগুলো আলোচিত হয়েছে, সেগুলো সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে।

১। এখন যেহেতূ সমগ্র আরবের শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে মুমিনেদের হাতে এসে গিয়েছিল এবং সমস্ত প্রতিবন্ধক শক্তি নির্জীব ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল , তাই আরবদেশকে পূর্নাঙ্গ দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য যে নীতি অবলম্বন করা অপরিহার্য ছিল তা সুষ্পষ্টভাবে বিবৃত করতে আর বিলম্ব করা চলে না ।তাই নিম্নোক্ত আকারে তা পেশ করা হয় :

(ক) আরব থেকে শিরককে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে হবে। প্রাচীন মুশরিকী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি খতম করে ফেলতে হবে। ইসলামের কেন্দ্র যেন চিরকালের জন্য নির্ভেজাল ইসলামী কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য কোন অনৈসলামী উপাদান যেন সেখানকার ইসলামী মেজায ও প্রকৃতিতে অনুপ্রবেশ করতে এবং কোন বিপদের সময় আভ্যন্তরীন ফিতনার কারণ হতে না পারে। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকদের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাতিল করার কথা ঘোষণা করা হয়।

(খ)কাবা ঘরের ব্যবস্থাপনা মুমিনদের হাতে এসে যাবার পর, একান্তভাবে আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য উৎসর্গীত সেই ঘরটিতে আবারো আগের মত মূর্তিপূজা হতে থাকবে এবং তার পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষতার দায়িত্ব এখনো মুশরিকদের হাতে বহাল থাকবে এটা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। তাই হুকুম দেয়া হয়ঃ আগামীতে কাবা ঘরের পরিচালনা ও অভিভাবকত্বের দায়িত্বেও তাওহীদদের হাতেই ন্যস্ত থাকা চাই।আর এ সংগে বায়তুল্লাহর চতুসীমানর মধ্যে শিরক ও জাহেলিয়াতের যাবতীয় রসম-রেওয়াজ বল প্রয়োগে বন্ধ করে দিতে হবে। বরং এখন থেকে মুশরিকরা আর এ ঘরের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে পারবে না। তাওহীদদের মহান অগ্রনী পুরুষ ইবরাহীমের হাতে গড়া এ গৃহটি আর শিরক দ্বারা কলুষিত হতে না পারে তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।

(গ)আরবের সাংস্কৃতিক জীবনে জাহেলী রসম-রেওয়াজের যেসব চিহ্ন এখনো অক্ষুন্ন ছিল নতুন ইসলামী যুগে সেগুলোর প্রচলন থাকা কোনক্রমেই সমিচীন ছিল না। তাই সেগুলো নিশ্চিহ্ন করার প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে। নাসী (ইচ্ছাকৃতভাবে হারাম মাসকে হালাল ও হালাল মাসকে হারাম নির্দিষ্ট করে নেয়া)র নিয়মটা ছিল সবচেয়ে খারাপ প্রথা। তাই তার ওপরে সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। এ আঘাতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের অন্যান্য নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে মুসলমানদের করনীয় কী। তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

২।আরবের ইসলাম প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম পূর্ণতায় পৌছে যাবার পর সামনে যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টি ছিল সেটি হলো, আরবের বাইরে আল্লাহর সত্য দীনের প্রভাব -বলয় বিস্তৃত করা। এ পথে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক শক্তি ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আরবের কার্যক্রম শেষ হবার পরই তার সাথে সংঘর্ষ বাধা ছিল অনিবার্য। তাছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাগুলোর সাথেও এমনি ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক । তাই মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়, আরবের বাইরে যারা সত্য দীনের অনুসারী নয়, তারা ইসলামী কর্তৃত্বের প্রতি বশ্যত ও আনুগত্যের স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত শক্তি প্রয়োগ করে তাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসন কর্তৃত্ব খতম করে দাও। অবশ্য আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপরটি তাদের ইচ্ছাধীন। তারা চাইলে ইমান আনতে পারে, চাইলে নাও আনতে পারে। কিন্তু আল্লাহর যমীনে নিজেদের হুকুম জারি করার এবং মানব সমাজের কর্তৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থা নিজেদের হাতে রেখে মানুষের ওপর এবং তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের ওপর নিজেদের গোমরাহীসমূহ জোরপূর্বক চাপিলে দেবার কোন অধিকার তাদের নেই। বড় জোর তাদের কে একটুকু স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে যে, তারা নিজেরা চাইলে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু সে জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদের জিযিয়া আদায় করে ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের অধীন থাকতে হবে।

৩।মুনাফিক সংক্রন্ত বিষয়টি ছিল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয়। সাময়িক বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তাদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত উপেক্ষাও এড়িয়ে যাবার নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। এখন যেহেতু বাইরের বিপদের চাপ কম গিয়েছিল বরং একেবারে ছিলই না বললে চলে, তাই হুকুম দেয়া হয়, আগামীতে তাদের সাথে আর নরম ব্যবহার করা যাবে না। প্রকাশ্য সত্য অস্বীকারকারীদের সাথে যেমন কঠোর ব্যাবহার করা হয় তেমনি কঠোর ব্যবহার গোপন সত্য অস্বীকারকারীদের সাথেও করা হবে।এ নীতি অনুযায়ী নবী (সা) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পূর্বে সুওয়াইলিমের গৃহে আগুন লাগান্ সেখানে মুনাফিকদের একটি দল মুসলমানদেরকে যুদ্ধে যোগদান করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে প্রচারাভিযান চালাবার জন্য জামায়েত হতো। আবার এ নীতি অনুযায়ী নবী (সা) তাবুক থেকে ফিরে আসার পর সর্বপ্রথম মসজিদে দ্বিরার ভেংগে ফেলার ও জ্বালীয়ে দেবার হুকুম দেন।

৪।নিষ্ঠাবান মুমিনদের কতকের মধ্যে এখনো পর্যন্ত যে সামান্য কিছু সংকল্পের দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল তার চিকিৎসারও প্রয়োজন ছিল। কারণ ইসলাম এখন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চলেছে। যে ক্ষেত্রে মুসলিম আরবেকে একাকী সারা অমুসলিম দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে সে ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনের জন্য ঈমানের দুর্বলতার চাইতে বড় কোন আভ্যন্তরীণ বিপদ থাকতে পারে না। তাই তাবুক যুদ্ধের সময় যারা অলসতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিল অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের তিরস্কার ও নিন্দা করা হয়। যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের ন্যায়সংগত ওযর ছাড়াই পিছনে থেকে যাওয়াটাকে একটা মুনাফেকসূলভ আচরণ এবং সাচ্চা ঈমানদার না হওয়ার সুষ্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভবিষ্যতের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেয়াহয়, আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার সংগ্রাম এবং কুফর ও ইসলামের সংঘাতই হচ্ছে মুমিনদের ঈমানদের দাবী যাচাই আসল মানদণ্ড । এ সংঘর্ষে যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য ধন-প্রাণ সময় ও শ্রম ব্যয় করতে ইতস্তত করবে তার ঈমান নির্ভরযোগ্য হবে না। অন্য কোন ধর্মীয় কাজের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রের কোন অভাব পূরণ করা যাবে না। এসব বিষয়ের প্রতি নজর রেখে সূরা তওবা অধ্যয়ন করলে এর যাবতীয় বিষয় সহজে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।

আয়াতভিত্তিক শানে নুজুল 
এ সূরা সর্বশেষ নাযিলকৃত সূরাগুলোর অন্যতম। এ সূরায় রাসূলুল্লাহ কাতিবে অহীকেও বিস্মিল্লাহ লিখবার নির্দেশ দেন নি। হযরত ওসমান (রা.) স্বীয় শাসনামলে কোরআনকে যখন গ্রন্থের রূপ দেন তখন এটা তাঁর নযরে পড়ে। কাজেই তিনি এইখানে বিসমিল্লাহ লিখতে নিষেধ করেন। (মারেফুল কোরান)

আয়াত-১ : রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কার বিভিন্ন মুশরিক গোত্রের সাথে নির্ধারিত মেয়াদে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে বনূ নযীর ও বনূ কেনানা ব্যতীত অন্য সকলেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই চুক্তি ভঙ্গ করে বসে। এই সময় নির্দেশ আসল যে, ১০ই যিলহজ্জ হতে ১০ই রবিউল আখের পর্যন্ত চার মাস নিরাপত্তার সাথে চলাফেরা কর। এর পর আর নিরাপত্তা থাকবে না। (মুঃ কোঃ)

আযাত-১১ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এ আয়াত সকল কেবলানুসারী মুসলমানের রক্তকে হারাম করে দিয়েছে। অর্থাৎ যারা নিয়মিত ছলাত ও যাকাত আদায় করে এবং তাদের নিকট থেকে ইসলামের পরিপন্থি কথা ও কুর্মের প্রমান পাওয়া যায় না, সর্বক্ষেত্রে তারা মুসলমান হিসাবে গণ্য হবে। তাদের অন্তরে সত্যিকার ঈমান বা কুফুরী যাই থাকুক না কেন। (মারেফুল কোরান)

আয়াত-১২ : একদল মুফাস্সিরের মতে এখানে কাফের প্রধান বলতে মক্কায় সেই সব কোরাইশ প্রধানকে বুঝানো হয়েছে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লোকদেরকে উস্কানি প্রদানে ও রণ প্রস্তুতিতে নিয়োজিত ছিল। বিশেষতঃ এদের সাথে যুদ্ধ করবার আদেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, মক্কার উৎস ছিল এরাই। তাছাড়া এদের সাথে অনেক মুসলমানের আত্মীয়তা ছিল, যার ফলে এরা হয়ত প্রশ্রয় পেয়ে বসত। (তাফসিরে মাজহারি)

আয়াত-১৭ : হযরত আব্বাস (রা.)- কে বদর যুদ্ধের যুদ্ধ বন্দী হিসাবে আনয়ন করা হলে সাহাবায়ে কিরামরা (রা.) কুফুরী, শিরক ও সম্পর্কচ্ছেদের উপর যখন তাঁকে তিরস্কার করতে লাগলেন তখন তিনি বললেন, “আমাদের দোষের সাথে গুণের কথাও বর্ণনা কর।” ” হযরত আলী (রা.) বললেন, হে আব্বাস! র্শিক করা অবস্থায় কোন পূণ্যময় কাজ কি করেছে? তখন হযরত আব্বাস বললেন, কেন করব না? অনেক করেছি, মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করেছি, হাজীদের পানি পান করায়ে থাকি, আল্লাহ্র ঘরের সম্মান করি, বন্দীদের মুক্তি দিয়ে থাকি। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয় এবং বলা হয় কুফুরী অবস্থায় সমস্ত কর্মই পণ্ডু হয়ে গিয়েছে।

আয়াত-১৮ : একদা হযরত তাল্হা গর্ব করে বললেন যে, তার নিকট কা’বা গৃহের চাবি থাকে এবং তিনি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হযরত আব্বাস উঠে বললেন, “আমি বারিধারক, হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করাই “হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি সর্ব প্রথম ঈমান এনেছি, সর্ব প্রথম নামায পড়েছি এবং রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। তখন আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়।

আয়াত-১৯ : মক্কার অনেক মুশরিক মুসলমানদের মোকাবেলায় গর্ব সহকারে বলত মসজিদুল হারামের আবাদ ও হাজীদের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আমরাই করে থাকি। এর উপর অন্য কারো আ’মল শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হতে পারে না। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আব্বাস (রা.) যখন বদর যুদ্ধে বন্দী হন এবং তাঁর মুসলিম আত্মীয়রা তাঁকে বাতিল ধর্মে বহাল থাকায় বিদ্রƒপের সঙ্গে বলেন, আপনি এখনও ঈমানের দৌলত হতে বঞ্চিত রয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা ঈমান ও হিজরতকে বড় শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করেছ। কিন্তু আমরাও তো মসজিদুল হারামের হেফাজত ও হাজীদের পানি সরবরাহের কাজ করে থাকি, তাই আমাদের সমান অন্য কারো আ’মল হতে পারে না। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হয়।

আয়াত-২৯ : কুফর ও র্শিক হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আল্লাহ নিজের অসীম রহমত গুণে শাস্তির এ কঠোরতা হ্রাস করে ঘোষণা করেন যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজারূপে ইসলামী আইন-কানুনকে মেনে থাকতে চাইলে তাদের হতে সামান্য জিযিয়া কর নিয়ে মৃত্যুদণ্ড হতে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদের জান-মালের নিরাপত্তার বিধান থাকবে। শরীয়তের পরিভাষায় এটা হল জিযিয়া কর। শরীয়ত মূলতঃ এর কোন হার নির্দিষ্ট করে দেয় নি, বরং তা ইসলামী শাসকের সুবিবেচনার উপর নির্ভরশীল। তিনি অমুসলিমদের অবস্থা পর্যালোচনা করে যা সঙ্গত মনে হয় তাই ধার্য করবেন। অধিকাংশ ইমামের মতে জিযিয়া দিতে স্বীকার করলে সকল অমুসলিমের সাথেই যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে হবে। (মারেফুল কোরান)

আয়াত-৩৪ : অনেকের মতে এই আয়াত ইহুদী-খৃষ্টানদের উদ্দেশে নযিল হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আয়াতটি মুসলমানদের মধ্যে যারা যাকাত এবং অন্যান্য আর্থিক দেনা পাওনাসমূহ আদায় করে না তাদের উদ্দেশে নাযিল হয়েছে। হযরত আবু যর (রা.) বলেন, আয়াতটি যারা যাকাত আদায় করে না তাদের সম্বন্ধে নাযিল হয়েছে , চাই তারা হউক মুসলমান অথবা অমুসলমান আহ্লে কিতাবী । বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু যর (রা.) ও হযরত মু’আবিয়া (রা.)-এর মধ্যে এ আয়াতটি সম্বন্ধে বিতর্ক হয়েছিল। হযরত মু’আবিয়া (রা.) এর মতে, আয়াতটি আহ্লে কিতাব সম্বন্ধে নাযিল হয়েছে, আর হযরত আবু যর (রা.)-এর মতে মুসলমান ও আহ্লে কিতাব উভয়ের সম্বন্ধেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আয়াত-৩৭ : চন্দ্র মাসসমূহ সাধারণত ঃ মৌসুম হিসাবে পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে মাসগুলো ছয় ঋতুতে ঘুরে ঘুরে আসত। কোন সময় এমনও হয়, নিরাপত্তা ও সম্মানিত মর্যাদাবান চারি মাসের কোন মাসে তাদের পারস্পরিক যুদ্ধের সময় তদানীন্তন মুশরিকরা আপন খেয়াল-খুশী মত ঐসব মাসকে অগ্রপশ্চাত করেদিত, মুর্হরম মাসকে সফর মাস বানিয়ে দিত এবং ঘোষণা করে দিত যে, এ বছর সফর মুর্হরমের আগে হবে। এরূপ টালবাহানা করে বরাবরই হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ করে যেত। এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়।

আয়াত-৩৮ : নবম হিজরীতে আরবের খৃষ্টানেরা রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের নিকট এই মর্মে পত্র লিখল যে, “নবুওয়তের দাবীদার মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যু ঘটেছে, তাঁর অনুচরবৃন্দকে অভাবে দুর্বল করে রেখেছে।” এই গুজবের উপর ভিত্তি করে রোম সম্রাটের আরব রাষ্ট্র করায়ত্ব করার সাধ হল এবং নিজের বিশেষ অন্তরঙ্গদের নেতৃত্বে চল্লিশ হাজার সৈন্য আরবের দিকে রওয়ানা করল। রাসূল (সা.) এই সংবাদ পেয়ে হযরত আলী (রা.)- কে আহ্লে বাইতের অর্থাৎ আপন পরিবার পরিজনদের উপর তত্ত্বাবধায়ক এবং হযরত ইবনে উম্মে মক্তুমকে ইমাম মনোনীত করে তদভিমুখে যাত্রা করলেন। তখন তাপমাত্রা এত উষ্ণ হয়েছিল, যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হচিছল এবং যাত্রাও ছিল অতি দূর-পাল্লার, আর শত্র“ও ছিল শক্তিশালী, জীবিকার উপাদান অর্থাৎ খেজুর ইত্যাদি ফসল কাটার সময়ও সমাগত। তদুপরি মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধের অবসানও হয়েছিল সবেমাত্র। এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফিকরা নানা টাল-বাহানা আরম্ভ করে দিল এবং কতিপয় মুসলমানও ভীত-সন্ত্রস্ত হল। তখন মুসলমানদেরকে উদ্যোগী ও উৎসাহিত করে তোলার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন।

আয়াত-৪৭ : বদর প্রান্তে যুদ্ধ করার জন্য মক্কার কোরাইশরা ও কাফেররা যখন মক্কা হতে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করল, তখন কুচকাওয়াজ ও রং বেরঙ্গের নাটকের সাজ সরঞ্জামও সঙ্গে নিয়েছিল। পথে আবু সুফিয়ানের সংবাদ বাহকের সাক্ষাত হল; সে বলল, যে কাফেলার সাহায্যের জন্য তোমাদের এ অভিযান, তারা অক্ষত অবস্থায় রাস্তা এড়িয়ে চলে এসেছে, তোমরা ফিরে চল, আবু জেহেল বলল; না, যে পর্যন্ত বদর রণাঙ্গনে জয়যুক্ত হয়ে নাট্যোৎসব পালন এবং উট জবাই করে ভোজের আয়োজন না করব ততক্ষণ ফিরব না।” সুতরাং মুসলমানদের দম্ভ করা হতে বিরত রাখার জন্য এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।

আয়াত-৫৬ : অত্র আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কাফেরদের অন্যান্য কতিপয় বদভ্যাসের বিবরণ দিচ্ছেন। তন্মধ্যে প্রথম হল, তাদের মিথ্যা শপথ করা যে, “আমরা তোমাদের দলভুক্ত।” অথচ তাদের এ শপথ ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর দ্বিতীয় হল, তারা অন্যত্র কোন আশ্রয় স্থল পেলে তথায় চলে যাবে।

আয়াত-৫৮ : এ আয়াতটি মুনাফিক আবুল জওয়ায সম্বন্ধে নাযিল হয়। একদা সে বলেছিল “তোমাদের নবীকে দেখ, তিনি তোমাদের সদকার মালপত্রসমূহ ছাগল-মেষ চালক রাখালদেরকে ভাগ করে দিচ্ছেন, আরও দাবী করছেন যে, তিনি ন্যায় করছেন।” আর কেউ বলল, হুনাইন যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মাল রাসূল (সা.) ভাগ-বন্টনের সময় মক্কাবাসী নব-মুসলিমদের হৃদয় জয়ের লক্ষ্যে তাদেরকে অধিক পরিমাণে দিচ্ছিলেন। তখন খারেজীদের নেতা আবুল খুওয়াইসরা এসে বলল, “হে মুহাম্মদ (সা.)! ইনসাফ কর।” রাসূল (সা.) তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, হে হতভাগ্য! আমি যদি ইন্সাফ না করি তবে কে করবে? এতে আয়াতটি নাযিল হয়।

আয়াত-৬৪ : কতিপয় মুনাফেক ইসলাম সম্পর্কে বিদ্রƒপাÍক উক্তি করেছিল, সাথে সাথে তাদের এ আশঙ্কাও হচ্ছিল যে, মুহাম্মদ (সা.) ওহীর মারফত তা জানতে পারলে বড় বিপদ হবে। কার্যতঃ তাই হল। রাসূলুল্লাহ (সা.) ওহীর মারফত তা জানতে পেরে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, আমরা কেবলমাত্র হাসি-তামাশা করছিলাম। (বয়ানুল কোরান)

আয়াত-৬৫ : আলোচ্য আয়াত থেকে জানা যায় যে, ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাপূর্বক কৌতুক বা বিদ্রƒপ করা কুফুরীর মধ্যে গণ্য। আরও জানা আবশ্যক আল্লাহর প্রতি, রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং কোরআন ও তার আয়াতসমূহ নিয়ে উপহাস-এই ত্রিবিদ উপহাসই পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং এর যে কোন একটির সাথে উপহাস করলে তিনটির সঙ্গেই উপহাস করা হয় এবং তা কুফর। (বয়ানুল কোরান)

আযাত-৬৯ : ইতোপূর্বে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াবী ভোগ-বিলাস এবং আখেরাতের প্রতি উপেক্ষা জ্ঞাপনের মধ্যে মুনাফেকদেরকে কাফেরদের সাদৃশ্য বলে উল্লেখ করেন। এখানে তাদের উভয় দলকেই নবীদের অবিশ্বাস করার মধ্যে এবং ধোকাবাজীকে একদল অপরদলের সমপর্যায়ের বলে ঘোষণা করা হয়।

আয়াত-৭০ : অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা কাফেরদেরকে ধ্বংস করে তাদের উপর কোন জুুলুম করেন নি। অধিকন্তু, তিনি যদি কোন অপরাধহীন কাউকেও ধ্বংস করতেন তার অবিচার হত না। কারণ, অবিচার হয় তখন, যখন কেউ অন্যের অধিকারে বিনা অনুমতিতে হস্তক্ষেপ করে। আর এইদিকে তো সর্বত্রই আল্লাহর অধিকার, ওতে কারও কোন শরীক নেই, তিনিই একচ্ছত্রভাবে সর্বাধিনায়ক। সুতরাং এটা আল্লাহ তাআলার একমাত্র করুণা ও অনুগ্রহ যে, তিনি বিনা দোষে কাকেও শাস্তি দেন না। আর শরীয়তের অনুশাসন হিসাবে পরকালে কাকেও বিনা দোষে শাস্তি দেয়া আল্লাহর পক্ষে শোভনীয় নয় যদিও যুক্তিসম্মত বৈধ।

আয়াত-৭২ : মু’মিন নর-নারীরা স্বীয় ঈমান ও আ’মলের বিনিময়ে অনন্য নেয়ামত বিশিষ্ট জান্নাত লাভ করবেন। আর জান্নাতের অপরিসীম নেয়ামত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নেয়ামত যা তারা প্রাপ্ত হবে তা হল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। এর তুলনায় অন্যান্য যাবতীয় নেয়া’মতই অতি নগণ্য। (মুঃ কোঃ)

আয়াত-৭৩ : এ আয়াতে কাফের ও মুনাফিক উভয় সম্প্রদায়ের সাথে জেহাদ করতে এবং তাদের ব্যাপারে কঠোর হতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যভাবে যারা কাফের তাদের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়টি তো সুস্পষ্ট, কিন্তু মুনাফিকদের সাথে জেহাদ করার অর্থ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মধারায় প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে যেন তারা ইসলামের দাবীতে নিষ্ঠাবান হয়ে যেতে পারে। (তাফসিরে মাজহারি, মারেফুল কোরান)

আয়াত-৮০ : মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই যখন পীড়িত হয় তখন তার পুত্র, আবদুল্লাহ্, যে সত্যিকার মুসলমান ছিল, বলল, হে আল্লাহর রাসূল! অনুগ্রহ পূর্বক আপনি আমার পিতার মাগফিরাতের জন্য দো’আ করুন, যেন তাকে আল্লাহ ক্ষমা করেন। হুযূর (সা.) দো’আ করেন তখন এ আয়াত নাযিল হয়।

আয়াত- ৮১ : তবুক যুদ্ধে যখন মুসলমানরা রওয়ানা হতে লাগল, তখন মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট কাকুতি-মিনতি করে অব্যাহতির অনুমতি নিয়ে সরে পড়তে লাগল, অত্যন্ত গরম পড়ছে, এমন উত্তপ্ত খরায় কেমন করে যাবে? তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়।

আয়াত-৮৪ : মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার ছেলে হযরত আবদুল্লাহ্ রাসূল (সা.)-এর নিকট তাঁর পবিত্র জামা তার পিতার কাফনের জন্য চাইলেন এবং জানাযার নামায পড়াবার আবেদন জানালেন। রাহ্মাতুল্লিল আলামীন ‘দয়াল নবী’ আপন জামা দিয়ে দিলেন এবং জানাযার সময় নামায পড়াতে দণ্ডায়মান হলেন তখন ওমর (রা.) জোরালো ভাষায় আবেদন জানালেন, ইয়া রসূলুল্লাহ্! মুনাফিকদের জানাযার নামায না পড়াই উত্তম হবে। হুযূর (সা.) বললেন, হে ওমর! আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকদের সম্বন্ধে সত্তরবার পর্যন্ত দোয়া কবুল না করার কথা বলেছেন। আমি ততোদিকবার দো’আ করব, হয়তো কবূল হবে। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়। তৎপর থেকে রাসূল (সা.) কোন মুনাফিকদের জানাযায় নামায পড়ান নি।

আয়াত-৯৩ : এখানে যে সাতজন রোদনকারী ছাহাবীর কথা বলা হয়েছে, যারা তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে মহানবী (সা.)-এর নিকট এসে বলল, আমরা জেহাদে অংশ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, তবে আমাদের কোন বাহন নেই। বাহন পেলে আমরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নবী করীম (সা.) বললেন, তোমাদেরকে দেয়ার মত আমার নিকটও কোন বাহন নেই। এটা শুনে তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় মহানবী (সা.)-এর দরবার হতে বের হয়ে গেল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.), আব্বাস (রা.) ও ওসমান (রা.) তাদেরকে বাহন ও পথের সম্বল প্রদান করে সাথে নিয়ে গেলেন। তাঁদের ব্যাপারে আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। ২। উপরোক্ত আয়াতসমূহে সেই সকল নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা প্রকৃতপক্ষেই অপারগতার কারণে জেহাদে অংশ গ্রহণে অক্ষম ছিল। (মারেফুল কোরান, তাফসিরে মাজহারি)

আয়াত-৯৪ : মুনাফিক জুদ ইবনে কাইছ, মা’তাব ইবনে কুশাইর এবং তাদের সঙ্গীদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা ছিল সংখ্যায় আশি জন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর আদেশ দিয়েছিলেন, কেউই যেন তাদের সাথে উঠা বসা না করে এবং কথাবার্তা না বলে। অপর বর্ণনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই যখন রাসূল (সা.) কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট শপথ করেছিল, এখন হতে কোন যুদ্ধে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করবে না। আলোচ্য আয়াতটি তখন নাযিল হয়।

আয়াত-১০৩ : ক্ষমা পাওয়ার পর তাঁরা তিন জনই তাদের সমস্ত মালপত্র নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, হে রাসূলুল্লাহ (সা.)! এ সম্পদই আমাদেরকে জিহাদে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত রেখেছে। সুতরাং আপনি এগুলো নিয়ে খয়রাত করে দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সম্পদ নিবার জন্য আমি আদিষ্ট হই নি; তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়, অবশিস্ট তিনজন সম্বন্ধে পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত আদেশ মূলতবী ছিল। পরে তাদের তওবাও গৃহীত হওয়ার ব্যাপারে আদেশ নাযিল হয়।

আয়াত-১১১ : বাইয়াতে ওকবায় সত্তর জন মহোদয় ব্যক্তিবর্গ বাইয়াত গ্রহণ করলেন তন্মধ্যে হয়রত আবদুল্লাহ্ ইবনে রওয়াহা বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ্। আমাদের নিকট হতে আল্লাহ্র জন্য এবং আপনার জন্য কতক প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহর জন্য প্রতিশ্র“তি হল , তাঁর ইবাদত করতে থাক এবং তাঁর সাথে কাউকেও শরীক সাব্যস্ত করবে না। আর আমার জন্য শর্ত হল, তোমরা আমাকে আপন জান মালের ন্যায় সংরক্ষণ করবে বরং ততোধিক। তখন তাঁরা এই প্রতিশ্র“তি পালন করলে, বিনিময়ে কি মিলবে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘জান্নাত’। তখন তাঁরা বললেন, কি সুন্দর সওদা এবং কেমন লাভজনক ব্যবসা। আমরা এই বিনিময় চুক্তি কখনও ভঙ্গ করব না। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে সুখবর প্রদানার্থে এ আয়াতটি নাযিল করেন।

আয়াত-১২৩ : আলোচ্য আয়াতে মুসলমানদেরকে যুদ্ধ হতে পশ্চাদপদ থাকার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান পূর্বক সার্বিকরূপে যুদ্ধের আদেশ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, প্রথমে আশে পাশের কাফিরদের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ কর, তারপর তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তীদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক। এটার বিপরীতে যে সকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বেচ্ছায় যে সকল যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর পরে ছাহাবীরাও ঠিক এ পদ্ধতিতেই যুদ্ধ করেছেন। অনন্তর রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম আপন গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, তারপর আরবের অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে, তৎপর সেখানকার কিতাবী-ইহুদী, খৃষ্টানদের সঙ্গে এরপর রোম ও সিরিয়াবাসীদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ছাহাবীরা প্রথমে ইরাকীদের সঙ্গে , তারপর অন্যান্য রাষ্ট্র ও নগরবাসীদের সঙ্গে উক্ত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেছেন।

গ্রন্থনা : মাওলানা মিরাজ রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top