সকল মেনু

রহস্যময় চর্যাপদের কবিগণ

সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিবেদক, ঢাকা, ২২ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : বাংলা সাহিত্যের গর্বের ঝুলি চর্যাপদ। চর্যাপদের মোট কবি ২৪ জন। হাজার বছর আগে এই সাহিত্য যাদের হাত ধরে লেখা হয়েছে তাদের সম্বন্ধে অনেকেরই জানার আগ্রহ প্রবল। আজ তাদের সম্পর্কে আপনাদের জানাবার প্রয়াসে এই লেখা।

এই সন্যাসীদের অনেকেই রাজ বংশধর ছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন রাজা, আবার কেউবা রাজপুত্র। কারো তান্ত্রিক ক্ষমতা ছিল, ছিল নানা কারিশমা। এসব কবিদের মধ্যে আমাদের দেশে জন্ম নেওয়া কবি যেমন আছেন, তেমনি আবার আছেন সুদূর সিংহল এ জন্ম নেওয়া কবি। কারো কারো জন্ম মহাভারতে। চলুন তাহলে দেখি তাদের পরিচয়, জন্ম আর জীবন বৃত্তান্ত।

লুইপা :

চর্যাপদ : “কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”

আধুনিক বাংলায় : “দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।”

লুইপা বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তার মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জীবিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের লোক। ‘ব্স্তন্-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়’ নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে।

আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক।

কুক্কুরীপা

চর্যাপদ : “দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু জাই।।”

আধুনিক বাংলায় : “দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / রাত হলে কামরূপ না গেলে নয়।”

এটি চর্যাপদের দ্বিতীয় পদ, কুক্কুরীপা রচিত। ধারনা করা হয় তিনি ছিলেন তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা (কপিলসক্র) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন, কুক্কুরীপা আমাদের বাংলাদেশেরই লোক। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম।

ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপা নারীও হতে পারেন। চর্যাপদে কুক্কুরীপার তিনটি বৌদ্ধগান ছিল।একটি পাওয়া যায়নি। কুক্কুরীপার পদযুগল ছিল তুলনামূলক গ্রাম্য।

বিরুপা

চর্যাপদ : “এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই। চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ।।”

আধুনিক বাংলায় :  “এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায় / চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।”

বিরুপা রচনা করেছিলেন চর্যাপদের তৃতীয় পদটি। তিনি জন্মেছিলেন রাজা দেবপালের রাজ্য ত্রিপুরায়। অষ্টম শতকে তার জন্ম বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বিরুপা ছিলেন জালন্ধরীপার শিষ্য, বাংলার লোক। বিরুপা অন্যান্য কবিগণের তুলনায় সামান্য পৃথক ছিলেন।

বলা হয় বিরুপা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলন। মদ্যমাংস ভোজনের অপরাধে বিহার থেকে বিতাড়িত হন তিনি। পরে আশ্চর্য ক্ষমতা বলে গঙ্গা পার হয়ে উড়িষ্যার কনসতি নগরে যান। সেখানেও নানা বুজরুকি বিদ্যা দেখান বিরুপা।

গুণ্ডরীপা

চর্যাপদ : “জোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি। তো মুহ চুম্বী কমল রস পিব্মি ।।”

আধুনিক বাংলায় :  “রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না  / তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি।”

গুণ্ডরীপা চর্যাপদের চতুর্থ পদটি রচনা করেন। কার্দিয়ার ক্যাটালগে তার এই নাম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন গুণ্ডরীপা জাতিবাচক নাম। তিনি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের কবি ধরে নিলেও, ভিন্নমত তিনি বিহারের লোক। রাজা দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৯-৮৪১) সময়ের মধ্যে তিনি ছিলেন।

চাটিল্লপা

চর্যাপদ : “ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝে ন থাহী॥ ধ্রু॥
দামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পার্গামি লোঅ নিভর তরই॥ ধ্রু॥”

আধুনিক বাংলায় : “ভবনদী বয় বেগে গহিন গভীর, / মাঝগাঙে ঠাঁই নাই, পঙ্কিল দু’তীর– / চাটিল ধর্মের জন্য সাঁকো গড়ে তায়, / পারগামী লোক তাতে পার হ’য়ে যায়।”

চাটিল্লপা সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, পাঁচ নং পদটি তার শিষ্যের রচিত। তিনি ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছে দক্ষিণবঙ্গে জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়। তার পদে সহজ সাধনভজন তত্ত্বকথা ও নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন: নদী, কাদা, জলের বেগ, খনন, সাঁকো ইত্যাদি।

ভুসুকুপা

চর্যাপদ :“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ

অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।

আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,

নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।”

আধুনিক বাংলায় :  “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল।”

ভুসুকুপা বাঙালি ছিলেন। অনুমান করা হয় তিনি পূর্ব বাংলা কবি। তার আসল নাম শান্তিদেব। ভুসুকু অষ্টম থেকে এগার শতকের সৌরাষ্ট্রের রাজা কল্যাণবর্মার পুত্র ছিলেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম শান্তিবর্মা ছিল। তাকে শান্তিদেব নামেও ডাকা হয়। বৌদ্ধাচার্য জয়দেব ভুসুকুকে শিক্ষাসমুচ্চয়, সূত্রসমুচ্চয় ও বোধিচর্যাবতার নামক তিনটি বই দিয়েছিলেন। ভুসুকু একমনে লেখাপড়া করতেন বলে ভিক্ষুরা তাকে অলস মনে করত। এজন্য তারা তাকে উপহাস কোরে ভুসুকু নামে ডাকত।

কাহ্নপা

চর্যাপদ :“ভন কইসেঁ সহজ বোলবা জাই / কাআবাকিচঅ জসু ন সমাই ।। / আলেঁ গুরু উএসই সীস ।। / জেতই বোলী তেতবি টাল ।

গুরু বোব সে সীসা কাল ।।”

আধুনিক বাংলায় :  “বল কেমনে সহজ বলা যায়, যাহাতে কায়বাকিচত প্রবেশ করিতে পারে না ? গুরু শিষ্যকে বৃথা উপদেশ দেন। বাকপথাতীতকে কেমনে বলিবে ? যতই তিনি বলেন সে সবই টালবাহানা। গুরু বোবা, সে শিষ্য কালা।”

চর্যাপদের সমস্ত কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয় কাহ্নপাকে। কাহ্নপা তার সমকালে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। কাহ্নপা খ্রীঃ অষ্টম শতকে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্নপা উড়িষ্যার কবি। তিনি থাকতেন সোমপুরী বিহারে।

বর্তমানে পাহাড়পুরে যে বিহারটি আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটিই কাহ্নপার বসতভিটা বলে ধারণা করেন অনেকে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- কাহ্নপা, দেব পালের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন। সুতরাং তিনি ৮৪০ এর দিকে বর্তমান ছিলেন।

এ বিষয়য়ে সন্দেহ ওঠে যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাহ্নপা রচিত একটি বই ‘শ্রীহেবজ্রপঞ্জিকাযোগ-রত্নমালা’ পাওয়া যায়। কাহ্নপার গুরু ছিলেন জালন্ধরী। যার অন্যনাম হাড়িপা। জালন্ধরীর গুরু ছিলেন ইন্দ্রভূতি। ইন্দ্রভূতির সময়কাল আনুমানিক ৭০০ খ্রীঃ।

যেহেতু সোমপুরে কাহ্নপার একটি লিপি পাওয়া যায়, তাই বলা যায়- গোপীচাঁদের যুগের লেখক। যিনি ৭ম শতকের শেষভাগে ধর্মপাল দেবের রাজত্বকালে সোমপুর বিহারে অবস্থান করেছেন। তাই মোটামুটি সন্দেহাতীতভাবে ৭৬০-৭৭৫ এর মধ্যকার সময়কালে কাহ্নপা চর্যার পদ রচনা করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।

কম্বলারম্বপা

চর্যাপদ :“সোনে ভরিতী করুণা নাবী । / রূপা থোই নাহিক ঠাবী ।। / বাহতু কাম্লি গঅন উবেসেঁ। / গেলী জাম বাহুড়ই কইসেঁ ।।”

আধুনিক বাংলায় : “আমার করুণা-নৌকা সোনায় ভর্তি রয়েছে; তাতে রূপা রাখার ঠাঁই নেই। অরে কম্বলি পা, গগনের (নির্বাণের) উদ্দেশ্যে তুমি বেয়ে চলো; যে জন্ম গেছে সে ফিরবে কি করে ?”

চর্যার আট নং বৌদ্ধগানটি কম্বলারম্বপার রচিত। তিনি ইন্দ্রভূতি ও জালন্ধরীপার গুরু ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার সময়কাল আনুমানিক ৭৫০-৮৪০ শতকে দেবপালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন।

ধারণা করা হয়, তিনি কানুপার পূর্ববর্তী এবং কুক্কুরীপা ও লুইপার সমকালীন কবি (কারণ তিনি লুইপার একটি গ্রন্থের টীকা লিখে দিয়ে ছিলেন) কম্বলারম্বপা কঙ্কারামের বা কঙ্করের রাজপুত্র ছিলেন। অনেকে মনে করেন- তিনি উড়িষ্যা কিংবা পূর্ব-ভারতবাসী ছিলেন।

ডোম্বীপা

চর্যাপদ :“গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ / তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই ।। / বাহ তু তোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা / সদ্গুরু পাও-পসাএঁ জাইব পুণু জিণউরা ।।”

আধুনিক বাংলায় : গঙ্গা যমুনা মাঝে রে বয় নৌকা, / তাউ চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অনায়াসে পার করে ।। / বা তুই ডুমনি ! বা লো ডুমনি ! পথে হইল সাঁঝ, / সদ্গুণ পায়ের প্রসাদে যাইব পুনরায় জিনপুর ।”

ডোম্বীপা চর্যার অষ্টম পদটি রচনা করেছেন। ডোম্বীপা ছিলেন হেরুক পূর্ব দিকের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা। ডোম্বী রাজার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, ডোম্বীপা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভ করায় তার প্রজারা তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এতে দেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী শুরু হয়। যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন তখন তা দূর হয়। এতে তান্ত্রিকরা রাজাকে ধর্মবান মনে করেন এবং দেশের প্রজারাও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভে অনুপ্রাণিত হয়।

এছাড়া রাঢ়দেশের হিন্দু রাজা বৌদ্ধধর্মের ক্ষতি সাধন করায় ডোম্বী সেখানে উপস্থিত হন এবং অলৌকিক বলে রাজা-প্রজা সকলকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি কর্ণাটকের সমুচ্চয় নামক রাজার তৈরি লিঙ্গাইত মথে ৮০০ টি স্তূপ আধ্যত্মিক শক্তি বলে মাটিতে মিশিয়ে দেন। সেখানে উল্লেখ হয়েছে, ডোম্বী মগধের রাজা।

বিরূপা তার গুরু। একটি অলৌকিক ঘটনা হল- প্রজাদের অনুরোধে যখন রাজা বন হতে দেশে ফিরে আসেন ও সঙ্গিনী ডুমনিসহ নিজেকে সাত দিন অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে রেখে নতুন দেহ নিয়ে বের হয়ে আসেন। তখন তার নাম হয় আচার্য ডোম্বী। তার সময়কাল মোটামুটি ৭৯০ থেকে ৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৬-৪৯ খ্রীঃ)।

১০শান্তিপা

চর্যাপদ : “সঅসম্বেঅণসরুঅবিআরেঁ অলক্খ লক্খণ ন জাই। / জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোই॥ ধ্রু॥ / কুলেঁ কুল মা হোই রে মূঢ়া উজূবাট সংসারা। / বাল ভিণ একু বাকু ণ্ ভূলহ রাজ পথ কন্ধারা॥ ধ্রু॥”

আধুনিক বাংলায় : “স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে / অলখ হয় না লক্ষণ; / সোজা পথে, আর হয় না রে / তাদের প্রত্যাবর্তন!”

শান্তিপা চর্যার পনের এবং ছাব্বিশ নং পদ রচনা করেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের গুরু ছিলেন তিনি; তার প্রকৃত নাম ছিল রত্নাকর শান্তি। খ্রিষ্টীয় এগার শতকের প্রথম দিকে জীবিত ছিলেন। বিহারের বিক্রমশীলায় বাস করতেন তিনি। বিক্রমশীল বিহারের দ্বার পণ্ডিত চিলেন।

একাদশ শতকে সজহযান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহল যাত্রা করেন। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার করে তিনি পদ রচনা করেছেন ।

১১মহীধরপা

চর্যাপদ : “তিনিএঁ পাটেঁ লাগেলি রে অণহ কসণ গাজই। / তা সুনি মার ভয়ঙ্কর রে বিসঅমণ্ডল ভাজই॥ ধ্রু॥ / মাতেল চীঅগএন্দা ধাবই। / নিরন্তর গঅণন্ত তুসেঁ ঘোলই॥ ধ্রু॥”

আধুনিক বাংলায় : “তিনটি পাটে কৃষ্ণ হাতির অশান্ত বৃংহণ, / শুনে, বিষয়-সমেত ভীষণ ‘মার’-এর আন্দোলন; / মত্ত গজেশ ছুটে গিয়ে শেষটায়
গগন-প্রান্ত ঘুলিয়ে ফ্যালে তেষ্টায়।”

মহীধরপা চর্যার ষোল নং পদ রচনা করেন। তার অন্য নাম মহিল। বিগ্রহ পাল-নারায়ন পালের রাজত্বকালে খ্রিষ্টীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন বলেন ধরা হয়। এবং তার জীবৎকালের নিম্নসীমা ৮৭৫ সাল।

তিনি ত্রিপুরাতে ছিলেন সে সময়ে ত্রিপুরা মগধ অন্ধলের মধ্যে ছিল। তাই বলা যায় মগধ অঞ্চলে বাস করতেন। চর্যার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কবি কাহ্নপার শিষ্য ছিলেন তিনি। কারও মতে তিনি দারিক পার শিষ্য। কাহ্নপার সাথে তিনি চটিগাঁয়ে ভ্রমণে করেন। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার করেছেন তার পদে।

১২বীণাপা

চর্যাপদ : “সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী। / অণহা দাণ্ডী একি কিঅত অবধূতী॥ ধ্রু॥ / বাজই অলো সহি হেরুঅবীণা। / সুনতান্তিধনি বিলসই রুণা॥ ধ্রু॥”

আধুনিক বাংলায় : “সূর্য হ’ল লাউ আর তার হ’ল চন্দ্র, / অবধূতি চাকি হ’ল, অনাহত দণ্ড; / হেরুক-বীণাটি বেজে ওঠে, সখী ও লো, / করুণায় শূন্য-তন্ত্রী বিলসিত হ’ল।”

বীণাপা চর্যার সতের তম পদটি রচনা করেন। তিনি গহুর (গৌড়) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দোম্বীপাদের সমকালীন বলে মনে করা হয়। বীণা তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র হওয়ার কারণে তার নাম বীণা ছিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে সর্বজন গৃহীত। তার গুরু ভাদ্রপা। অন্য ভাষাবিদের মতে, তিনি বুদ্ধপার শিষ্য ছিলেন। তার শিষ্য ছিলেন বিলস্যবজ্র এবং প্রাচীন বাংলা ভাষা ব্যবহার করে চর্যার পাশাপাশি তিনি একটি গ্রন্থ ‘ব্র্তডাকিনীনিষ্পন্নক্রম’ রচনা করেন।

১৩সরহপা

চর্যাপদ : “হিঅ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই। / সূণ নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই ।।”

আধুনিক বাংলায় : “হৃদয়-তাম্বুলে মহাসুখে কর্পূর খায়, / শূন্য-নৈরাত্মাকে কণ্ঠে লইয়া মহাসুখে রাত্রি পোহায় ।।”

চর্যায় আরেকজন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হলেন সরহপা। তখন কামরূপের রাজা ছিলেন রত্নপাল। তার সময়কাল ১০০০ থেকে ১৩০০ খ্রীঃ অঃ। সরহের শিষ্য ছিলেন এই রাজা। সরহ তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে রাজাকে দীক্ষা দেন।

সরহের নিজ জাতি ছিল বাহ্মণ। অনেকে মনে করেন, নাগার্জুনের গুরু হলেন সরহপা। পূর্ববঙ্গের রাজ্ঞীদেশের উত্তরবঙ্গ-কামরূপে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। চর্যায় রচিত তার চারটি পদাবলির ভাষা ছিল বঙ্গকামরূপী।

১৪. শবরপা

চর্যাপদ : “উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী। / মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।। / উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। / ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।। / ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী। / একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।”

আধুনিক বাংলায় : “উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। / তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। /  নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। /  শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। /  কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। / শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।”

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, শবরপা’র জীবনকাল ৬৮০ থেকে ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, শবরপা চর্যার কবিদের মধ্যে প্রাচীন কবি এবং তিনি বাংলাদেশের লোক। শবরপা লুইপা’র গুরু এবং নাগার্জুনের শিষ্য ছিলেন। সংস্কৃত ও অপভ্রংশ মিলে তিনি মোট ১৬টি গ্রন্থ লিখেছেন। চর্যাপদে ২৮ ও ৫০ নং পদ দুটি তার রচনা।

১৫তন্ত্রীপা (পাওয়াযায়নি)

চর্যাপদ গীতিকায় তন্ত্রীপার পদ খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।

১৬আর্যদেবপা

আর্যদেবপা চর্যার একত্রিশ নং পদটি রচনা করেন। সিংহল দ্বীপে তার জন্ম হয়। আর্যদেব মূলত মেবারের রাজা রাজা ছিলেন। তার আসল নাম হল আজদেব। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের প্রথমার্ধের কবি ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি কম্বলারপার সমকালীন ছিলেন। পরে গোরক্ষনাথের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে পদলাভ করেন। তার রচিত পদের ভাষা বাংলা ও উড়িয়া মিশ্রিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “তাঁহার ভাষা অনেকটা বাঙ্গালা বটে, কিন্তু উড়িয়া ভাষা বলাই সঙ্গত।”

১৭ঢেণ্ডণপা

চর্যাপদ : “টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী”

আধুনিক বাংলায় : “লোক শূণ্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি / হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।”

ঢেণ্ডণপা চর্যার (তেত্রিশ নং) রচনা করেন। তার জন্মস্থান অবন্তিনগরের উজ্জয়িনীতে। তার জীবৎকাল ৮৪৫ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তার আসল নাম হল ঢেণ্ঢস। খ্রিষ্ট্রীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি দেবপাল-বিগ্রহপালের সমকালে ছিলেন। ঢেণ্ডণপা মূলত তাঁতি এবং সিদ্ধা ছিলেন। তার পদে বাঙালি জীবনের চিরায়ত দারিদ্রের চিত্র পাওয়া যায়।

১৮দারিকপা

দারিকপা চর্যার চৌত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন। সালিপুত্র নামক স্থানের রাজা ছিলেন তিনি। জন্মস্থান উড়িষ্যার শালীপুত্রে। তার আসল নাম ইন্দ্রপাল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষভাগে ও নবম শতকের শুরুতে তার সময়কাল ছিল বলে ধারণা করা যায়। সিদ্ধা পদলাভের পরে তিনি দারিক নাম ধারণ করেন। লুইপার কাছ থেকে তিনি সিদ্ধ লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে মর্যাদা পান।

১৯. ভাদেপার

চর্যাপদ : “এতকাল হঁউ আচ্ছিলোঁ স্বমোহেঁ / এবেঁ মই বুঝিল সদ্ গুরু বোহেঁ ।।”

আধুনিক বাংলায় : “এতকাল আমি স্বমোহে ছিলাম / এখন সদগুরু বুঝলাম।”

ভাদেপার চর্যায় ভদ্রপাদ নামে পরিচিত। পঁয়ত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি তিনি রচনা করেছেন। তার জন্ম হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে। ভাদেপা বিগ্রহ ও নারায়ন পালের রাজত্বকালের সময়ে বর্তমান ছিলেন। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র মতে তার জন্ম মণিভদ্র। কিন্তু অন্য অনেকে মনে করেন শ্রাবন্তী এলাকায়। তিনি কাহ্নপা, মতান্তরে জালন্ধরীপার শিষ্য ছিলেন। তিনি পেশায় চিত্রকর ছিলেন।

২০তাড়কপা

Albert Gruenwedel যে ৮৪ জন মহাসিদ্ধের নাম প্রকাশ করেন, তার মধ্যে তাড়কপা উল্লেখ নেই। ফলে তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

২১কঙ্কণপা

কঙ্কণপা চর্যার চুয়াল্লিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন। তিনি বিষ্ণুনগরের রাজা ছিলেন। তার ভাষা ছিল বাঙলা এবং অপভ্রংশ মিশ্রিত। তিনি খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শেষভাগের কবি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

তবে অনেক গবেষক এ মত প্রকাশ করেন- কঙ্কণপা ৯৮০ থেকে ১১২০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। প্রথম জীবনে পরবর্তিতে তার গুরু কম্বলাম্বরের কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষা লাভ করে সিদ্ধ হন। তবে অনেক ভাষাবিদ এ মতও প্রকাশ করেন যে, তিনি কম্বলাম্বরের বংশধর ছিলেন এবং দারিকপাদের শিষ্য ছিলেন।

২২জয়নন্দীপা

জয়নন্দীপা-এর আসল নাম জয়ানন্দ। জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কোনো এক রাজার মন্ত্রী ছিলেন বলেও জানা যায়। চর্যার ছেচল্লিশ নং পদটি তিনি রচনা করেন। তার জন্ম বাংলাদেশে। তার ভাষা ছিল গৌড় অপভ্রংশের পরবর্তী আধুনিক আর্যভাষার প্রাচীন রূপ। যা মিথিলা প্রদেশের মৈথীলা, উড়িষ্যার ওড়িয়া, বাংলা ও আসামের ভাষার সংমিশ্রণ।

২৩ধর্মপা

চর্যার সর্বশেষ কবি হলেন ধর্মপা। তিনি চর্যার সাতচল্লিশ নং পদটি রচনা করেন। ধর্মপা বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শুরুর দিকে তার জন্ম হয় এবং প্রায় ৮৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। গোত্র ছিল ব্রাহ্মণ। এ থেকে বোঝা যায় বিগ্রহ নারায়ণ পালের রাজত্বকালে তিনি জীবিত ছিলেন এব এবং ঢেণ্ডণপার সমকালীন ছিলেন। ধর্মপা কাহ্নপার শিষ্য। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভের পর তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। চর্যায় তার রচিত পদটির ভাষা বাংলা।

২৪. লাড়ীডোম্বীপা (পাওয়া যায় নি)

চর্যাপদ গীতিকায় তন্ত্রীপার মতো লাড়ীডোম্বীপার পদও খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তার সম্পর্কেও বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

চর্যাপদ মূলত গানের বই, এতে অনেকগুলো পদ বা গান বা চর্যা আছে। পণ্ডিতরা বলেন, এই গানগুলো হলো বৌদ্ধ সহজিয়া বা সহজযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকদের সাধন সঙ্গীত। মানে গানগুলোতে সাধকরা তাদের মন্ত্র গোপনে লুকিয়ে রেখেছেন। যে সহজযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা করে, কেবল সে-ই ওই গোপন অর্থ বুঝতে পারবে।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলা সাহিত্যের কথা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

২ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top