সকল মেনু

আধুনিকতার জাঁকজমকে সৌন্দর্য হারাচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন?

লাইফস্টাইল প্রতিবেদক, ২১ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) :  ভাষা আন্দোলনের এক বছর পর ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি পালিত হয়েছিল ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে। এই দিনটিই ছিল মাতৃভাষা দিবসের প্রথম উদযাপন। শুধুমাত্র ভাষা শহীদদের প্রতি শোক প্রকাশ নয়, রাজনৈতিক প্রতিবাদের অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে উদযাপিত হত একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিকেল ছাত্রাবাস প্রাঙ্গনের শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলেছিল তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী। শহীদ মিনার ভাঙ্গার পরবর্তী তিন চার বছর প্রভাতফেরী শুরু করা হতো ঢাকা মেডিকেল ছাত্রাবাস প্রাঙ্গন থেকে। ১৯৫৬ এর সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও এ উদযাপনের ধারা ব্যাহত হয়নি।

‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ কিংবা ‘ভুলবো না একুশে ফেব্রুয়ারি’ এই গানগুলো গাইতে গাইতে আজিমপুরে শহীদদের কবরের দিকে ফুল হাতে এগিয়ে যেত বাংলার মানুষজন। তাদের কন্ঠে ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। পরের বছর থেকে চালু হয়েছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর পুরাতন ঢাকা ও নতুন ঢাকা হয়ে পড়তো এক বিশাল জনারণ্য। সবাই একসাথে ছুটতো আর্মানিটোলায় জনসভার দিকে। প্রত্যেক মানুষের মনে ছিল ভাষিক চেতনা। একই জাতীয়তাবোধের বন্ধনে সব মানুষ ছিল আবদ্ধ।

একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ভোরে খালি পায়ে সবাই প্রভাতফেরীতে যোগদান করত। কিন্তু এখন আর প্রভাতফেরীর প্রচলন নেই। এখন রাত বারটার পর থেকেই শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন শুরু হয়ে যায়। প্রভাতফেরী যতটা আবেদনময়ী হয়ে বাংলার মানুষকে ছুঁয়ে যেত, এখনের উদযাপনের মধ্যে আর সেই আবেদনময়তা নেই।

জাতিসংঘের অনুমোদনক্রমে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো ২১শে ফেব্রুয়ারির সেই মর্ম এখন আর নেই। এখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ব্যবহার করছে স্বার্থপর কিছু রাজনীতিবিদ। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন পরিণত হয়েছে নিছক আনুষ্ঠিকতায়। এই মহিমান্বিত দিনটিতেও যদি নিজের স্বার্থে আমরা মিথ্যা চেতনাকে লালন করি তবে তা হতাশাজনক।

বর্তমান সময়ের তরুণদের মধ্যে আগেকার সেই চেতনা কি আছে? নাকি একুশের চেতনা এখন টি-শার্টে লেখা ‘একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ? লক্ষণীয় যে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এখন অনেক স্থানেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আয়োজন হয় না, বিপ্লবী গানে এখন আর মেতে উঠে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পিকনিক বা হিন্দি নাচগানে আনন্দময় পরিবেশ!

ফ্যাশন হাউসগুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে নানা ধরণের বাহারি পোশাক তৈরি করা হয়। সেই পোশাকের বাহারি বিজ্ঞাপনে ঝিকমিক করে উঠে সংবাদপত্রের পাতা। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে সুন্দর পোশাক কিনতে বিপনিবিতানে ভিড় জমায় অসংখ্য লোকজন। কে কত বেশি দামী ও চাকচিক্যময় পোশাক পরতে পারে গোপনে ও প্রকাশ্যে সেই প্রতিযোগিতাই চলে।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের তরুণ সমাজ মেতে উঠে আনন্দময় প্রেমলীলায়। মানবজীবনে প্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম, এ বিষয়ে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মত তাৎপর্যময় দিনটিকেও আমরা যদি সচরাচর একটি দিনের মত অপচয় করে ফেলি তবে তা আমাদের সমাজের জন্য বিরাট এক লোকসান বয়ে নিয়ে আসবে।

স্কুল কলেজগুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে আয়জন করা হয় দৌড়-লাফ-ঝাপ প্রতিযোগিতা। দৌড়-লাফ-ঝাপ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কিভাবে ভাষা আন্দোলন তথা আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাকে কিভাবে বিকশিত করা যায় এ বিষয়টি আমার জানা নেই।

ভাষা আন্দোলনের এ দিনটিতে আমরা যদি আমাদের ভাষাকে আরো বেশি শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা গ্রহন করি তবেই সম্ভবত এ দিনটি স্বার্থক হবে। তার পাশাপাশি আমরা যদি আমাদের চৈতন্যকে জাগ্রত করে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারাকে আরো বেশি বেগবান করার জন্য সচেষ্ট হই তবেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top