সকল মেনু

ইসলামের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব-তাৎপর্য ও ভাষাশহীদদের মর্যাদা

ধর্ম প্রতিবেদক, ২১ ফেব্রুয়ারি  (হটনিউজ২৪বিডি.কম) :আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগনিত দান আর নিয়ামতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন-সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জীবনের শুরু থেকে বিদায় পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ মহানের দান-নিয়ামতের মুখাপেক্ষি আমরা। মহান আল্লাহর নিয়ামতভোগী মাখলুক আমরা মানুষ। ভাষা আল্লাহ তায়ালার অনন্য একটি দান।অন্যন্য একটি নিয়ামত। মানব জাতিকে প্রদান করা বিশেষ নিয়ামত। ভাষা জীবনের এমন একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; যা ছাড়া সুস্থ ও সম্পূর্ণ জীবন কল্পনা করা যায় না। ভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। পবিত্র কোরানের সুরা আর-রহমানের প্রথমদিকে আল্লাহ তায়ালা বলেছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছি বয়ান বা উপস্থাপনজ্ঞান’। আলোচ্য আয়াতের মাঝে মানুষকে উপস্থাপনজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা মানবকূলকে যত নিয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। মানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে। মনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি দু:খানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোন প্রানীকে দেননি। পশু-প্রানীরা কখনো তাদের মনের বেদনা কারে কাছে বলতে পারেনা; আনন্দ উল্লাস অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ তাঁদের সব অনুভুতি অন্যের সাথে আদান প্রদান করতে পারে। এ এক অপূর্ব নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শন আমাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে। এইসব নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে কথা বলা বা ভাষার নিদর্শনটিই আমরা অনুভব করি এবং ব্যবহার করি। পবিত্র কোরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হল- আসমান জমিন সৃষ্টি, তোমাদের বিভিন্ন রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা’। (সূরা রূম: ২২)

আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষ তৈরী করেছেন। তিনি নিপূণতার সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে তৈরী করেছেন। তাদের মধ্যে দিয়েছেন রংয়ের ভিন্নতা; ভাষার ভিন্নতা; দিয়েছেন রুচীর বৈচিত্র্য। কোটি কোটি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণ, রূপ-সৌন্দর্য্যে ও ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তায়ালার অপরূপ মহিমা ও কুদরতকে সাক্ষ্য দেয়। প্রমাণ করে আল্লাহ কতো সুনিপূণ কারিগর। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেন। সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি; আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) -কে সৃষ্টির পর তাঁকে সব ধরণের ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।

ইসলামের আলোকে ভাষার মর্যাদা : আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকে। তার কোনো নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভূক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ তাআলা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, ‘তার এক নিদর্শন হলো, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার ভিন্নতা। (সূরা রূম: ২২) ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত। সব প্রাণীরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্য।

প্রথম মানুষ হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে, ‘হজরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন। (সূরা বাকারা : ৩১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘মানব জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বর্ণনা করার জ্ঞান দিয়েছেন। (সূরা আর রহমান: ৪) মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবি-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবিদের মাতৃভাষায় করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে’। (সূরা ইবরাহিম: ৪ ) প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সাথে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানো। তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে; স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হব।

বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব : ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌছে দিতে বাঙ্গালী মুসলমানের বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আরবের অধিবাসী তাই কোরান অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়। পবিত্র কোরানের বাণীসমূহ ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে এবং এটাই সময়ের অনিবার্য দাবী। কারণ আমাদের ভাষা আরবি নয়। কোরান বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবিভাষী না হওয়ার কারণে সকলের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তাই কোরান, হাদিস ও ইসলামি ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে পৌছে দিতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ; কিন্তুশুধুমাত্র বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌছে দেয়ার অভাবে তাঁদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না। একসময় ফার্সি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হত। রুমি, জামি, শেখ শাদিরা সে ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফার্সি ভাষাকে জয় করে ফেলেন। এতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়। আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন; কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। ইসলামের সব বিষয়, সব দিক ও অধ্যায় নিয়ে রচিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ হলে, বাংলা ভাষী মুসলমানরা নিমিষেই ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলেঅচনা বুঝতে পারবে এবং আমল করতে পারবে। বাংলা ভাষায় ইসলামের এস গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনো বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে পারে না। বাংলঅ ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবশে করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা। প্রত্যেকজন নবি তার সময়ের ভাষায় ধর্ম প্রচার করেছে। আমাদের দেশে আমাদের এই সময় যদি কোনো নবির আগমন ঘটতো, অকশ্যই তিনি হতে বাংলা ভাষী। বাংলা হতো তাঁর ভাষা। যেহেতু নবি বা রাসুল আর আসবেন না, তাই নবি-রাসুলদের যারা উত্তরসূরি রয়েছেন তাদের উচিত বাংলণা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে এগিয়ে আসা।

ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মর্যাদা : ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। শহীদ দুই প্রকার। এক. ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যারা অথবা যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুই. কোনো মহামারীতে, পানিতে ডুবে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অথবা কোনো ভবন বা স্থাপনা ধসে তার নিচে চাপা পড়ে যদি কোনো মুসলমান প্রাণ হারায়; ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ বলে বিবেচিত হবেন তারা। এমনিভাবে সন্তান প্রসবের সময় কোনো স্ত্রীলোক যদি মৃত্যুবরণ করেন সেও শহীদ বলে গণ্য হবেন। বাংলাদেশের মুসলমানগণ ভাষার জন্য যে আÍত্যাগ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। ছালাম, জব্বার, রফিক, বরকতেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। অন্যের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তারা। ইসলামের আলোচনা অনুযায়ী ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা শহীদ। স¤পদের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ দেশে দেশে লড়াই করে কিন্তু মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশীরাই তৈরী করেছে।

শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন আলোচনা এসেছে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ কেননা শাহাদাত তথা অন্যান্য নেক আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর হক মাফ হয়। কিন্তু ঋণ তথা বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত হকদার ব্যক্তি ক্ষমা না করেন। জামে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘শহীদকে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই ক্ষমা করে দেন। এরপর জান্নাতে তার আবাসস্থল দেখানো হয়, কবরের ভয়াবহ আজাব থেকে হেফাজত রাখবেন। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে থাকবে। এবং তার মাথায় বিশেষ মুকুট পরিধান করানো হবে।’ মহান আল্লাহ তায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো না। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিজিকপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ভাষা শহীদ কিংবা যে কোনো ধরনের শহীদ হোক না কেন, আল্লাহ মহানের কাছে রয়েছে তার জন্য আলাদা মর্যাদা এবং ইসলাম তাকে প্রদান করেছে বিশেষ গুরুত্ব। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ মহানের কাছে দোয়া-প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভাষা শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মাওলানা মিরাজ রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top