সকল মেনু

ভাষাশহীদের ছবির একমাত্র কারিগর আমানুল হক

সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিবেদক, ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : প্রতিবছরই নিয়ম করে ফেব্রুয়ারিতে একুশ আসবে, একুশ যাবে। তবে আর কোনোদিন দেখা মিলবে না তাঁর। যার ক্যামেরায় বন্দী ছবি কথা বলেছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামী ইতিহাসের, চলমান জীবনের। তিনি আমানুল হক। বাংলাদেশের কিংবদন্তী এক চিত্রগ্রাহক।

৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক, গুরুত্ববহ, অনন্য অসাধারণ মুহূর্ত। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মিছিলে ভাষা শহীদ রফিকের খুলি উড়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত ছবিটিও তাঁর। এই ছবিটিই ভাষা শহীদের একমাত্র ছবি। বলা চলে এই একটি ছবি দিয়েই তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে। এছাড়া তিনি নিজেও ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক।

প্রাথমিক জীবন

সিরাজগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম শাহজাদপুরে ১৯২৫ সালে আমানুল হকের জন্ম। বাবার অনুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করতেন তিনি। বড় হয়ে কিছুদিন আর্ট কলেজে লেখাপড়াও করেছেন। কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর্টিস্ট কাম ফটোগ্রাফার পদে যোগ দিয়ে। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তিনি এঁকে দিতেন মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য। ১৯৫২ সালে চাকরিতে থাকাকালীন আমানুল হক জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে।

ফটোগ্রাফি জীবনের শুরু

আমানুল হক ফটোগ্রাফি শুরু করেন অনেক আগে থেকেই। তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছেন উনিশ শ তেতাল্লিশ সালে। যখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন থেকেই মোটামুটি ফটোগ্রাফি করতেন। কলকাতার কাগজে, সাময়িক পত্রিকায় তার ছবিও ছাপা হয়। আমানুল হকের এলাকায় ওইসময় শাহজাদপুরে বর্ধিষ্ণু ছিল সাহা পরিবার। ওখানে দুজন সাহা ছিলেন, যারা ওই পুরো অঞ্চলে স্টুডিও ফটোগ্রাফির কাজ করতেন। একজন বীরেন সাহা। আরেকজনের নাম অতুল সাহা। অতুল সাহা ছিলেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, বিগ ফরম্যাটের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। আমানুল হকের বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল বীরেন সাহার সঙ্গে। তিনি একটু অ্যামেচার ধরনের কাজ করতেন, সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে। অতুল সাহা ছবি তোলার জন্য ঘোরাঘুরি করতেন না। তিনি বিশেষ কিছু দেখলেই বীরেনদাকে গিয়ে ধরতেন ছবি তোলার জন্য। আর এভাবেই আমানুল হকের ফটোগ্রাফি জীবনের শুরু।

ঐতিহাসিক ছবির গল্প

পথ চলতে চলতে মুগ্ধ হওযার মতো কিছু দেখলেই আমানুল হক ছবি তুলে রাখতেন। সর্বক্ষণই কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন ক্যামেরা। ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা ঘটতে পারে, এটা তিনি আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। সে আন্দাজ থেকেই নিজের ক্যামেরাটি পকেটে লুকিয়ে রেখে নেমেছিলেন রাস্তায়।

সেদিন গাজীউল হক, আব্দুল মতিন, অলি আহমেদ, গোলাম মওলাসহ আরো কয়েকজনের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছোট ছোট মিছিল বের হয়েছিল। মিছিল বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ এবং মিছিলে গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অনেক মানুষ। আমানুল হক তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। দেখছিলেন কয়েকজন ধরাধরি করে রক্তমাখা একজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসছে। গুলিবিদ্ধ সেই মানুষটি ছিলেন ভাষা শহীদ বরকত। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে হাসপাতালে ভর্তির পর সেদিন রাতেই মারা যান তিনি।

তবে এখানে নয়, আমানুল হক জীবনের সেরা ছবিটি তুলেছিলেন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সির পাশে আলাদা একটা অন্ধকার ঘরে। গুলিবিদ্ধ রফিকের। দেশের আরেক প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির যেসব ছবি আমরা দেখে থাকি, তার অধিকাংশই তুলেছেন তিনি। একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, আমানুল হকের বিখ্যাত সেই ছবি তোলার গল্প। তিনি বলেন, ‘এটা আমার জীবনের বড় দুর্ভাগ্য। ৫২’ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যখন গুলি চলল তখন আমার হাতে ক্যামেরা কিন্তু কোনো ফিল্ম নেই। আমানুল হক আর আমি ছাড়া আর কাউকে ছবি তুলতে দেখিনি। প্রথম গুলিবিদ্ধ হন রফিকউদ্দিন আহমদ। বুলেটে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। মেডিকেল কলেজ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসে। মেডিকেল কলেজে ঢোকার মাঝখানের দরজায় তাঁকে স্ট্রেচারে করে নামানোর সময় আমি আর আমানুল হক ছিলাম। আর ছিলেন দুই ছাত্রনেতা_কাজী গোলাম মাহবুব ও কামরুদ্দীন। যখন রফিককে নামানো হয়, দেখি মাথার ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে। এটা দেখে কাজী গোলাম মাহবুব আর কামরুদ্দীন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। আমি আমানুল হককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকি।

এই দৃশ্যের ছবি তোলা ফরজ কিন্তু ক্যামেরায় ফিল্ম নেই। আমানুল হক সাহেবের কাছে একটা-দুটো ফিল্ম ছিল, তিনি ছবি তুলেছেন।’ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রফিকের লাশ ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। ভেতরে গিয়ে আমরা লাশ খুঁজি, পাই না। এমন সময় সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসকে দেখলাম। তিনি সম্ভবত সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। তিনি আমাদের তার সঙ্গে যেতে বললেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। রফিকউদ্দিনের লাশটা গুম করার জন্য ইমার্জেন্সিতে না নিয়ে ইমার্জেন্সির পাশে একটা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছিল। ইদ্রিস সাহেব আমাদের সেখানে নিয়ে বললেন, ছবি তুলতে চাইলে এক্ষুণি তুলুন। আমানুল হককে বললাম, আমার তো ফিল্ম নেই। আপনিই তোলেন। তিনি ছবি তুললেন। সেই ছবিটাই কিন্তু শহীদদের একমাত্র ছবি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অন্য কোনো শহীদের ছবি নেই। এটা একটা ঐতিহাসিক ছবি। এর কোনো তুলনা নেই। গুলিবিদ্ধ শহীদের একমাত্র ছবি আমানুল হক তুলতে পেরেছেন। আমরা কেউ পারিনি।’

জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আমানুল হক নিজেও বলে গেছেন শহীদ রফিকের লাশের ছবি তোলার গল্প। তিনি বলেছেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেদিন রফিকের ছবি তুলতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। অন্ধকার একটি ঘরে রাখা ছিল রফিকের লাশ। আমি কয়েকজনের সহায়তায় সেদিন তার ক্ষতবিক্ষত লাশের ছবিটি তুলতে পেরেছিলাম। ছবিটির তিনটি কপি করা হয়। একটি দেওয়া হয় এ.এস.এম মোহসিনকে, আরেকটি মাজেদ খানকে (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং শেষ কপিটি দেওয়া হয় দৈনিক আজাদে প্রকাশের জন্য। কিন্তু মওলানা আকরাম খাঁর নির্দেশে ছবিটি ছাপানো যায় নি। ছাত্ররা ছবিটি ব্যবহার করে লিফলেট ছাপিয়েছিলো। দুর্ভাগ্যবশত পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। অনেক পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচ্ছদে ছবিটি পুনঃপ্রকাশিত হয়।’

পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় আমানুল হকের তোলা শহীদ রফিকের ছবিটি পোস্টার করে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচার হয়েছিল। প্রায়ই পুলিশ হয়রানি করত তাঁকে। এ কারণে আমানুল হক কলকাতায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য পুলিশী হয়রানিও এড়ানোও যাবে পাশাপাশি সিনেমার কাজ শেখা যাবে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে যান সত্যজিত রায়ের কাছে ৩ নম্বর লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে ১৯৫৯ সালে। আমানুল হক সেদিন একটা ছবি তুলেছিলেন। এরপর থেকে প্রায়ই নানাকাজে যেতেন ওই বাড়িতে। আর এভাবেই দিনে দিনে সত্যজিত রায়ের পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার।

একাকীত্বের দিনগুলো

চিরকুমার প্রখ্যাত এই চিত্রগ্রাহক সারাজীবন মানুষের মাঝে থেকেও ব্যাক্তিগতভাবে ভেতরে ভেতরে ছিলেন একাকীত্বে বন্দী। অবশ্য সে নিয়ে কখনই তার কোন আক্ষেপ বা অভিযোগ ছিলো না। জীবনের শেষ দিনগুলোও তিনি রজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ৫ম তলাতে কাটিয়েছেন নিভৃতচারীর মতো। আমার দেশ চিত্রমালা নামে ছবির একটা সংকলন করার জন্য আমানুল হক ৫০ বছর ধরে ছবি তুলেছেন। সেই ছবিগুলো নিয়ে বই করার চেষ্টা করেছিলেন, যা আমেরিকা থেকে প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু বার্ধক্যের কাছে পরাজিত হয়ে সেই চেষ্টা আর সফলতার মুখ দেখেনি। গেল বছর ৩ এপ্রিল তিনি পাড়ি জমান আর না ফেরার দেশে। তখন বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

সন্মাননা

আমানুল হক তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সম্মানিত হয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ২০১১ সালে রাষ্ট্র তাকে সর্বোচ্চ সম্মান জানায় ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।

শেষকথা

কিছু মানুষ মরে গিয়েও বেঁচে থাকেন। আমানুল হক তাদের একজন। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন শত শত বছর। নতুন প্রজন্মের কাছে এই গুণী মানুষটির জীবন ও কর্ম তুলে ধরতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, যতোকাল এ দেশে ভাষা আন্দোলনের অহংকার থাকবে, ইতিহাস থাকবে ততোকাল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমানুল হক।

(ইন্টারনেট অবলম্বনে)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top