সকল মেনু

রাজধানীর শতাধিক স্পটে তৎপর ব্লেড পার্টি

ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : রাজধানীর শতাধিক স্পটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্লেড পার্টি। রাজধানীর ৪৯ থানায় অঞ্চলভিত্তিক শতাধিক স্পটে এরা সক্রিয়। এদের প্রধান হাতিয়ার ব্লেড। কখনও আবার ব্যবহার করে ধারালো ছুরি। সন্ধ্যার পর ব্লেড পার্টি চক্রের সদস্যরা রাস্তায় নামে। উদ্দেশ্য ব্লেড  অথবা ধারালো ছুরি দিয়ে সিএনজি অটোরিকশার হুড কাটা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ট্রাফিক সিগন্যাল ও যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট গাড়ির পলিথিন কেটে অথবা গাড়ির জানালায় হাত ঢুকিয়ে যাত্রীর মানিব্যাগ, মোবাইলফোন, গলার চেইন, কানের দুল ছিনিয়ে নেয়া। ভুক্তভোগীরা জানান, দিনে একদল টানাপার্টি (ছিনতাই) এ কাজ করে। রাতে আবার এ চক্রের সদস্যরাই রাস্তায় নেমে ব্লেড পার্টির কাজ করে। অভিযোগ, ব্লেড পার্টির নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ঘটনার পর যাত্রীরা পুলিশের সাহায্য পায় না বলে ব্লেড পার্টি অপরাধ করে পুলিশের সামনে দিয়ে চলে যায়।

রমনা-মৎস্য ভবন এলাকার সিএনজি চালক হাসিবুর মোল্লা জানান, ছিনতাইকারী ব্লেড পার্টির শিকার হয়নি নগরীতে এমন গাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। লালবাগ থানাধীন কেল্লার মোড়ের সিএনজিচালক লোকমান আলী ফরমান জানান, ইদানীং রাতে রাস্তায় হিজড়া ছিনতাইকারীর উপদ্রব দেখা দিয়েছে। তারা রাতের বেলায় ব্লেড ও ছুরি দিয়ে সিএনজি যাত্রীর মালামাল হাতিয়ে নেয়। সদরঘাট এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী আকবর মিয়া জানান, গত ডিসেম্বরে তিনি ব্লেড পার্টির শিকার হন।

সূত্র জানায়, গাবতলি, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদ গেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট পুলিশ বক্স, আনন্দ সিনেমা হল, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, নিউ মার্কেট, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, টিকাতুলী, সায়েদাবাদ, জুড়াইন, পোস্তগোলা, লালবাগ, সদরঘাট, কাকরাইল রাজমণি সিনেমা হল, ফকিরাপুল, কমলাপুর, মালিবাগ, শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন রাস্তা, সাতরাস্তা মোড়, মহাখালী, চেয়ারম্যান বাড়ি, বিজয় সরণি, গুলশান মোড়, বাড্ডা, উত্তরা মাস্কাট প্লাজা, আজমপুর হাউজ বিল্ডিং ও বিমানবন্দর এলাকায় দিনে রাতে টানা পার্টির পাশাপাশি ওত পেতে থাকে ব্লেড পার্টি। পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রের সমন্বয়ে চলছে এদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সদস্যরা বেশির ভাগ বস্তির উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবক। তাদের টার্গেট রাতের সিগন্যাল বাতির নিচের ছোট ছোট যানবাহন। এদের কাজের স্টাইল পেশাদার ছিনতাইকারী থেকে ব্যতিক্রম। তারা অভিনব কায়দায় রাস্তায় দাঁড়ানো অথবা চলন্ত সিএনজি গাড়ির পিছনের বাম্পারে চড়ে যানবাহনের চলমান শব্দের তালে তালে ব্লেড দিয়ে কাটতে থাকে সিএনজি গাড়ির পিছনের পলিথিন। কাটা পলিথিনে হাত ঢুকিয়ে ছিনিয়ে নেয় যাত্রীর মালামাল। যাত্রীর চিৎকার শুনে গাড়ি থামান চালক। ততক্ষণে পালিয়ে যায় ব্লেড পার্টির সদস্য। উত্তরার সিএনজি  চালক হালিম বয়াতি জানান, ছোট গাড়ির রাতের যাত্রীরা রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন। এর ফলে অনেক সময় সিএনজি গাড়ির চালকদের বিপদে পড়তে হয়। তিনি বলেন, যাত্রীরা সন্দেহ করেন ওই অপরাধীদের সঙ্গে চালকদের যোগাযোগ আছে। তার মতে এ ধারণা অনেকটাই ভুল। ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে পুলিশের গোপন রফাদফা থাকতে পারে, চালকদের নয়। নাখাল পাড়ার রিকশাচালক তমাল মোল্লা জানান, রাস্তায় ব্লেড পার্টি ধরা পড়লে জনগণ উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেন। যাত্রাবাড়ীর ভুক্তভোগী জয়নাল আবেদীন জানান, ক’মাস আগে স্ত্রী পরিজন নিয়ে মিরপুরে যাওয়ার সময় তিনি গুলিস্তান স্টেডিয়ামের সামনে যানজটে পড়েছিলেন। ওই সময় ব্লেড পার্টির শিকার হন। সিএনজির পিছনের পলিথিন কেটে তার স্ত্রীর গলার চেইন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী এক কিশোর। গাড়ি থামাতেই বঙ্গবাজার পার্কে ওই যুবক পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে যাত্রাবাড়ী  থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, তার জানা মতে, যাত্রাবাড়ী এলাকায় এ ধরনের কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে তার জানা নেই।

সূত্র জানায়, তেজগাঁও এলাকার টানা পার্টি-ব্লেড পার্টি সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করছে ছিনতাইকারী কামরুল, বাচ্চু, রফিকুল ও সুমনসহ এক মাদক সম্রাজ্ঞীর গ্রুপ। কাওরানবাজার রেললাইন বস্তি, রেলস্টেশন বস্তি ও নাখালপাড়া বস্তির উঠতি অনেক যুবক এফডিসি গেট, সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর ও ফার্মগেট পার্ক বস্তি এলাকায় ব্লেড পার্টির সঙ্গে  জড়িত। এ ব্যাপারে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, বস্তির বসতি নেশাখোর ইয়াবা-গাঁজা-হেরোইন আসক্ত কিশোর-যুবকরা এসব কাজ করে। কাওরানবাজার থেকে বিজয় সরণির রাস্তায় এ ধরনের অপরাধ মাঝে মধ্যে সংঘটিত হতে পারে। এদের ধরার জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু  নেশায় আসক্ত ওই সব যুবকের শারীরিক অবস্থা এতটা নাজুক ও বেহাল এদেরকে ধরে থানায় আনার পর পুলিশকে বিপাকে পড়তে হয়। তাদের অনেকের নেশা চালিয়ে ওঠে। এ সময় নেশা করতে না পারলে তারা শারীরিকভাবে নেতিয়ে পড়ে। বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কায় পুলিশ বিভিন্ন সময় তাদের ধরার পর ছাড়তে বাধ্য হয়। পল্টন এলাকায় টানা পার্টির নেপথ্যে রয়েছে ছিনতাইকারী সুজন, নিপু, চোর আসলাম, শাখাওয়াত, পরান ও সৌরভ হোসেন চক্রের সদস্যরা। রমনা থানার মগবাজার মোড় সিগন্যালসহ বিভিন্ন স্থানে ব্লেড পার্টির নিয়ন্ত্রণে  শিশু ছিনতাইকারী সজীবের একটি দল এলাকা চষে বেড়াচ্ছে। পুলিশের হাতে বিভিন্ন সময় এ চক্রের সদস্য ধরা পড়লেও তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। গ্রিলকাটা চোর নিয়াজ মোর্শেদ ও ফয়সাল গ্রুপ সজীবের শেল্টার বলে জানা গেছে। শাহবাগ থানার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টোকাই কাশেমের দুটি দল, নিউ মার্কেট থানাধীন নিলক্ষেত টোকাই আলী, লাবলু ও খোকন তিন কিশোর ব্লেড পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিউ মার্কেটের বই বিক্রেতা সরোয়ার হোসেন জানান, প্রায়ই শুনি রিকশা, অটো রিকশা, সিএনজি যাত্রীর চিৎকার। এগিয়ে গেলে জানা যায় চেইন, কানের দুল, মানিব্যাগ কিংবা মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা।

এ ব্যাপারে নিউ মার্কেট থানার ওসি তদন্ত মনিরুজ্জামান বলেন, গত ছয় মাসে ব্লেড পার্টি বা টানা পার্টি সিএনজি গাড়ি, রিকশা যাত্রীর কোন মালামাল ছিনিয়ে নিয়েছে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে কেউ আসেনি। গুলশান এলাকায় ব্লেড পার্টিও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তিন মাদক ব্যবসায়ী আবুল কালাম, মাদক সম্রাজ্ঞী পারভীন ও সাজা। ভাটারা কুড়িল বিশ্বরোডে এলাকায় টানা পার্টি ও ব্লেড পার্টি নিয়ন্ত্রণ করছে সন্ত্রাসী উজ্জ্বল ও রাজীব গ্রুপ। পাতা বাবু, মামুন ও পারভেজ পেশাদার তিন ছিনতাইকারী কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা আবুল হোটেল পর্যন্ত ব্লেড পার্টির নিয়ন্ত্রণ করছে। রামপুরা থানার ওসি কৃপাসিন্ধু বালা জানান, ব্লেড পার্টি কর্তৃক যাত্রীর মালামাল ছিনতাইকারীর তৎপরতা আগের মতো নেই। তিনি থানায় আসার পর এদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান পরিচালনায় অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছে।

শ্যামলী এলাকায় ব্লেড পার্টি নিয়ন্ত্রণ করছে সন্ত্রাসী বিল্লাল গ্রুপ। হত্যা মামলায় আসামি হওয়ায় বিল্লাল পলাতক রয়েছে। শ্যামলী থেকে আসাদ গেট ব্লেড পার্টি ও টানা পার্টি পরিচালনা করছে সাগরেদ কমল ও মনির। শ্যামলী, আসাদ গেট, কল্যাণপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ছিনতাইকারী হাসান ও সাব্বির। মিরপুর গোল চত্বর এলাকায় বাবু ও ইউসুফ গ্রুপের সদস্য আলী, কামাল, সাইদ, গেণ্ডারিয়া এলাকায় পিচ্চি  রনির গ্রুপ, জুরাইন রেলগেট ছোট ব্রিজ-কালভার্ট এলাকার মাদক ব্যবসায়ী ইয়াকুবের সাগরেদ পিচ্চি বাবুল, বাইট্টা কমল ব্লেড পার্টি ও টানা পার্টি নিয়ন্ত্রণ করছে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায় ছিনতাইকারী শাহজালাল গ্রুপ গুলিস্তান ও বঙ্গবাজার এলাকার ব্লেড পার্টি নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরান ঢাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঘরজামাই রাজীবের ব্লেড পার্টির সদস্যরা। এ ব্যাপারে ডিএমপির মিডিয়া শাখার এসি আবু ইউসুফ জানান, ব্লেড পার্টি বা টানা পার্টি ছিনতাইকারী অপরাধচক্রের সদস্যদের বিশেষ কোন তৎপরতা রাজধানীতে নেই। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের কাছে অভিযোগ বা মামলা থাকার কোন তথ্য তার  জানা নেই। রাজধানীতে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান পরিচালনার ফলে তারা অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের অপরাধী চক্রের সঙ্গে পুলিশের অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পর্কের কথাও তিনি অস্বীকার করেন। (মানবজমিন)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top