সকল মেনু

ভারতে শান্তিতে নেই দেশত্যাগী হিন্দুরা

ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম), ভারত থেকে ফিরে: দেশে সন্ত্রাসীদের হামলা, হুমকি-ধামকি, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ থেকে রক্ষা পেতে ভিন দেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম একটু শান্তির আশায়। কিন্তু প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে এসেও শান্তিতে নেই। এখানে আমাদের কোনো মানসম্মান নেই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন নব্বই দশকে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া পঞ্চাশোর্ধ সাধুচরণ সরকার।

তিনি বলেন, ‘মান-সম্মানের ভয়ে অঢেল ধন-সম্পদ ফেলে ভারতে এসেও শেষ সম্মানটুকু ধরে রাখতে পারলাম না। দু’বেলা দু’মুটো ভাতের জন্য জন দিয়ে (কামলা খেটে) চলতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অসম্মান আর কী হতে পারে? অভাবের কষাঘাতে আমাদের সংসার থেকে সুখ-দূরে সরে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসা অনেক প্রিয়জন আমাদের সঙ্গে দেখা করেন না। ভিন্ন পথ দিয়ে চলে যান। এর চেয়ে আমাদের মরে যাওয়া অনেক ভালো।’

ভারতের উত্তর দিনাজপুর জেলার কুশমণ্ডি থানার সুকান্ত পল্লীতে স্ত্রী ইতি রানী সরকার, বড় ছেলে মানিকচাঁদ সরকার ও ছোট ছেলে সুজন সরকারকে নিয়ে বাস করছেন সাধুচরণ। তাদের ঠিকানা এখন ১০ বাই ১৬ ফুটের একটি ঘর। চার জনে গাদাগাদি করে থাকেন। ওই ঘরে যাওয়া-আসার জন্য কোনো রাস্তা নেই। অন্যের জায়গার ওপর দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এ নিয়েও পড়শীদের গালমন্দ শুনতে হয় নিয়মিত।

বাংলাদেশের দক্ষিণ মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত কানাইলাল সরকারের ছাট ছেলে তিনি। গোলা ভরা ধান আর সব সময় গোয়ালে থাকতো দুগ্ধবতী গাভী। সবকিছু মিলে তাদের সংসার সুখেরই ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে তাদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।

মামলা-হামলা পর্যন্ত করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। এর পরেও  নানা যন্ত্রনা-গঞ্জনা সহ্য করে থাকতে হয় তাদের। পরবর্তী সময়ে এমন অত্যাচার করা হয় যার ফলে ৯০ দশকের শেষ দিকে বাধ্য হয়ে তারা ভাবতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

নামমাত্র দামে পৈতৃক বাড়ি ও জমি বিক্রি করে প্রথমে উত্তর বঙ্গের নদীয়া জেলা শহরঘেঁষা একটি পল্লীতে বাড়ি করেন সাধুচরণ। প্রথম দিকে ভালোই ছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে বাধ্য হয় বাড়িটি বিক্রি করে দিতে হয়।

কিন্তু বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে তাৎক্ষণিক অন্যখানে জায়গা-জমি কিনতে সময় লেগে যায়। এর মধ্যে গচ্ছিত টাকা থেকে সংসার চালাতে গিয়ে রিক্তহস্ত হওয়ার অবস্থায় চলে যান। পরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমণ্ডি থানার সুকান্ত পল্লীতে মাত্র ১৭ শতাংশ জায়গা কেনেন। এ জায়গা কিনতেই গচ্ছিত টাকা শেষ হয়ে যায়। মাথা গোঁজার মত ১০ ফুট বাই ১৬ ফুট সাইজের একটি খড়ের ঘর তোলেন। এক সময়ের অর্থ বিত্তশালী পরিবারটি হয়ে যায় ছিন্নমূল।

গত ৯ ফেব্রয়ারি দুপুর ১২টায় ছিন্নমূল এ পরিবারের সঙ্গে আলাপকালে সাধুচরণ সরকার বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সোনার সংসার ফেলে এখন হয়েছি কাঙাল। ছেলে দু’টোকে লেখাপড়া করাতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছি। আর আমরা স্বামী-স্ত্রী কেরালা, আন্দামান প্রদেশ, মধ্য প্রদেশে চলে যাই কাজের সন্ধানে। এভাবে চলছে আমাদের সংসার।’

শুধু সাধুচরণ নয়। তার মতো যারা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের শতকরা ৯০ ভাগই শান্তিতে নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই হিন্দুরা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে অন্তত খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু বিধি বাম।

বিশেষ করে ভারতের উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদা, নদীয়াসহ জেলাগুলোতে দেশত্যাগী যে হিন্দুরা বাস করছেন তাদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

রায়গঞ্জ শহড়ঘেঁষা রুপহারের বাসিন্দা কিরণ চন্দ্র মণ্ডল জানান, উত্তরবঙ্গের পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ প্রকাশ্যে মদ্য পান করে। প্রকাশ্যে বসে মদের হাট। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার মোড়ে বসে জুয়ার আসর। সব মিলিয়ে আমরা মান-সম্মান বজায় রেখে সামনের দিনগুলো ভালোভাবে চলতে পারবো কি না এ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছি।

গাজোল শহরের নেতাজী সুভাষ পল্লীতে কথা হয় প্রবীণ শিক্ষক জ্ঞানরঞ্জন রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে একজন প্রবীণ ব্যক্তির সম্মান নেই। একজন ভালো শিক্ষকের সম্মান নেই। মাতৃভূমির প্রতি যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল, সেটা এখানে আর পাওয়া যাবে না। শুধু মান-সম্মানের ভয়ে গত ৩০ বছর হয় বাংলাদেশের পাবনা থেকে এসেছি। পাবনায় আমাদের বেশ প্রভাব ছিল। সে প্রভাবটা এখানে এসে দেখাতে পারছি না। সামনের দিনগুলো ভালোভাবে কাটিয়ে যেতে পারলেই শান্তি।’

গাজোলের অপর বাসিন্দা দুলাল মণ্ডল বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অনেকেই এখানে কিছু করতে না পেরে আবার বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন। মানিকগঞ্জের খাবারপুর গ্রাম থেকে আসা ক্ষেত্রমাস্টার এখানে কিছু করতে না পেরে বর্তমানে মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন।’

গাজোলে বাড়ি করেছিলেন মানিকগঞ্জের বালিরটেক গ্রামের নিতাই চন্দ্র রায়। তিনি কোনো অবস্থান তৈরি করতে না পারায় গাজোলের বাড়ি বিক্রি করে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। তার মতো অনেকেই বিক্রি করতে চাচ্ছেন। তবে ভোটার আইডি, রেশন কার্ডসহ নানা আইনি জটিলতার কারণে ঠিকঠাকমত বাড়িও বিক্রি করতে পারছেন না বলে সরজমিনে জানা গেছে।

রায়গঞ্জের রুপহার এলাকার বাসিন্দা দুলাল সরকার। অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে তার ছেলেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। ডাকাতি, চুরিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে তার ছেলে। অতিসম্প্রতি রায়গঞ্জ শহরে ডাকাতি করতে গিয়ে জনতার হাতের গণপিটুনিতে সে মারা যায়।

দক্ষিণ-দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুর থানার নকশাল হাট এলাকার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর বারারচর গ্রামে। ৫টা পুকুর ছিল। সারাবছর পুকুরে মাছ খেয়েও বিক্রি করে প্রচুর আয় করা যেতো। এখানে এসে একটা পুকুরও করতে পারি নাই। মন কাঁদে জন্মভূমির জন্য।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা যখন বাংলাদেশ থেকে আসি। তখন ওই দেশের ভিন্ন ধর্মের মানুষরা এদেশে আসতে সহযোগিতা করেছে। তাদের জন্য মন এখনও কাঁদে।’

বুনিয়াদপুর এলাকার তৃণমূল নেতা ভক্ত মণ্ডল বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা এখানে এসে তেমন কিছুই করতে পারেনি। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। দেশপ্রেম নেই কারও মনে। যার যার মত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সবাই।’

তবে ভারত সরকার ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সারাবছর রেশনিং ব্যবস্থা করেছে। বেকার ভাতা, হাউস লোনসহ নানা উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিবেকবান ও সুস্থ চিন্তার সাধারণ মানুষ যেভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। ভারতে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের মধ্যে সেভাবে অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হতে দেখা যায়নি বলে সরজমিনে জানা গেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top