সকল মেনু

ভোলার চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখির জলকেলী আর কলতান একদিন ফুরিয়ে যাবে

Pic--(2)--12--02--14 Tarua Pakhi

এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা, ১২ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : শীত আসার সাথে সাথে প্রতিবছরের মতো এবারো ভোলার চরাঞ্চলগুলিতে অতিথি পাখিরা এসে জড় হতে শুরু করেছে। সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ উত্তরের শীত প্রধান দেশ মঙ্গোলিয়া, নেপাল, জিনজিয়াং থেকে আসা হাজার হাজার অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে উঠে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে জেগে উঠা দ্বীপ জেলা ভোলার এসব চরাঞ্চলগুলি। এখন সেখানকার মানুষের ঘুম ভাঙে অতিথি পাখির কলকাকলিতে। আবার সারাদিন খেটে খাওয়া এসব মানুষরা কর্মব্যস্ততা শেষে অতিথি পাখির মধুময় সুরে ঘুমিয়ে পড়েন। শীতের সকাল-বিকেল জেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এসব চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখির কলকাকলি, কিচিরমিচির, উড়ে বেড়ানো আর জলকেলীতে একদিকে যেমন ছুয়ে যায় কঠিন হৃদয়ের মানুষের মন। অন্যদিকে নিছক সখ ও লালশার বশবর্তী হয়ে এক দল প্রভাবশালী শিকারী ভীর জমায় উপকূলের এসব চরাঞ্চলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৮০’র দশকে ভোলায় আসা অতিথি পাখির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩শ’ ৫০ প্রজাতির। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা নেমে ১শ’ ৩২ প্রজাতিতে চলে এসেছে। প্রতিবছরই শীতের শুরুতে হাজার পাখির কলকাকলীতে এ অঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে দিন দিন এর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমতে থাকলে একসময় ভোলার চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখির জলকেলী আর কলতান ফুরিয়ে যাবে।
২০১৩ সালের জানুয়ারীতে ঢাকা থেকে ভোলায় আসা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক জানান, গত বছর শীতে ভোলায় সর্বমোট ৩১ হাজার ৯শ’ ৬৫টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি গননা করেছেন। এর মধ্যে ১শ’ ৩২ প্রজাতির পাখির সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে জলচর পাখির ছিল ৬৫ প্রজাতির। সর্বমোট সৈকত পাখির সন্ধান মিলেছে ১২ হাজার ৯১টি। যার মধ্যে চেগা, জিরিয়া, বাটান ছিল উল্লেখ যোগ্য। বুন হাসের সন্ধান মিলেছে ৯ হাজার ৭শ’ ৫৩টির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিথি হাঁস, বেবী, চকাচকি, রাজ হাস। ৩১ হাজার ৯শ’ ৬৫টি পাখির মধ্যে পরিজাই (অতিথি) পাখির সংখ্যা ছিল ২২ হাজার। বাকি ১০ হাজার পাখি ছিল স্থায়ী বসবাস কারি। এসময় তিনি দিন দিন পাখি কমে যাওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেকে বড় কারণ বলে মনে করছেন। বাংলাদেশে ৩০ বছর আগে যেখানে ফসলে শুধু জৈব সার ব্যবহার করা হতো। এখন সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সার। যেটা পাখিদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। পাখিদের বসবাসস্থলগুলোতে এখন মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান। কিছু কিছু স্থানে এক শ্রেনীর অসাধু শিকারীরা বিষ দিয়ে পাখি নিধন করে বাজারে বিক্রি করছে। যার ফলে পাখিরা থাকা ও খাওয়ার জন্য অনেক স্থানকে এখন আর নিরাপদ মনে করছে না। অতিথি পাখি কমে যাওয়ার পেছনে মোবাই ফোনের টাওয়ারের রেডিয়েশন দায়ী কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের রেডিয়েশন জন্য ক্ষতিকর কিনা এটা জানতে ইতিমধ্যেই পরিবেশের বিজ্ঞানিরা কাজ শুরু করেছে।
কথা হয় পাখি-পর্যবেক্ষক ও পর্বত আরোহী এম.এ মুহিতের সাথে। তিনি জানান, ২০০০ সাল থেকে তিনি প্রতি বছর এ পাখি শুমারি করে আসছে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ভোলার যে সকল চরে জনবসতি ছিলোনা এখন সেখানে মানুষের গতাকম্য বেড়েছে। ফলে পাখিদের প্রজোনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেন, ঢালচরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চর শাহাজালালের কথা। যেখানে এক সময় পাখিদের স্বর্গরাজ্য ছিল। আর এখন সেখানে গরু-মহিষ ও জেলেদের অবাধ বিচরণ। আবার নিছক সখ ও লালশার বশবর্তী হয়ে এক দল প্রভাবশালী শিকারী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভীর জমায় ভোলার উপকূলের এসব চরাঞ্চলে। এছাড়াও মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী বেষ্টিত এসব চরাঞ্চলে গাছের সবুজ বেষ্টনী একের পর এক উজাড় হচ্ছে। কিছু অসৎ বনরক্ষীর সহযোগিতায় দিনের আলোতে প্রকাশ্যেই বনের গাছ লুট করছে দস্যুরা। যার ফলে পাখিরা এখন ওইসব চরগুলোকে তাদের নিরাপদ স্থান বলে মনে করছেনা। এছাড়াও নদীগুলোতে জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছে। যে কারণে একদিকে যেমন পাখিদের খাদ্যপযোগী মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে জালে জড়িয়ে অনেক পাখিও প্রাণ হারাচ্ছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা প্রতিহত না করা গেলে ওই সব মাছের বংশ এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কথা হয় প্রকৃতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড.এস.এম.এ রশিদের সাথে। যিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম পাখি শুমারি শুরু করেন। তিনি বলেন, ৮০’র দশকে ভোলায় আসা অতিথি পাখির সংখ্যা যেখানে ছিল প্রায় ৩শ’ ৫০ প্রজাতির তা এখন নেমে ১শ’ ৩২ প্রজাতিতে চলে এসেছে। তিনি আরো বলেন, পাখিদের আবাসস্থল এখন লোকালয়ে পরিণত হয়েছে। পাখিদের কোলাহল মুক্ত বিচরন ক্ষেত্রগুলো এখন প্রভাবশালীদের দখলে। দিন দিন মানুষ বাড়ছে। মাছের চাহিদা বাড়ছে। তাই এখন জেলেদের সংখ্যাও বেশি। জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছে। নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে নদীর প্রাণ-বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। এসময় তিনি নদীর প্রাণ-বৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে সকলকে এক যোগে কাজ করার আহবান জানান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top