সকল মেনু

চাঁদপুরের জয়িতা রহিমা বেগম জীবনযুদ্ধে বিজয়ী

  শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার পাথৈর গ্রামের রহিমা বেগম। যাঁর বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের কোটায় পড়েছে। তিনি ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে সফল জননী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। এ সংগ্রামী নারীর এখন প্রতীকী নাম ‘জয়িতা’। এখন তাঁর স্বপ্ন দেশ সেরা সফল জননীর মুকুট পরা। বিয়ের ১২ বছরের মাথায় স্বামীহারা হয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাঁচ সন্তানকে আগলে রেখে রহিমা বেগম জীবন যুদ্ধ শুরু করেছেন। তখন হয়তো তাঁর স্বপ্ন বা লক্ষ্য ছিলো পাঁচ সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন, মানুষের মতো মানুষ করবেন, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। তাঁর সে স্বপ্ন বা লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। কিন্তু তিনি  হয়তো তখন এটা ভাবেননি যে, তিনি একদিন সফল জননী হিসেবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাবেন, বাংলা মায়ের গর্বিত জননী হবেন। তাঁর উদ্দেশ্যও তখন সেটা ছিলো না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সন্তানদের মানুষ করা। হয়েছেও তাই। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে ২ ছেলে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা, ২ মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা ও ১ মেয়ে এমএসএস অধ্যয়নরত।  বর্তমান সরকার সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনকারী নারীদের খুঁজে এনে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কৃত করার কর্মসূচি হাতে নেয়। আর এটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে চালু হলো। এ প্রতিযোগিতা চাঁদপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে চাঁদপুর জেলায়ও হয়। জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মিসেস জেবুন্নেছার কাছ থেকে জানা যায়, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শিরোনামে পাঁচটি ক্যাটাগরীতে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। সে অনুযায়ী চাঁদপুর জেলায় প্রথমে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে পাঁচ ক্যাটাগরীতে পাঁচজন করে ৮ উপজেলায় ৪০ জনকে নির্বাচিত করা হয়। পাঁচ ক্যাটাগরী হচ্ছে : অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, সফল জননী, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নূতন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী এবং সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন যে নারী। এ পাঁচ ক্যাটাগরীতে চাঁদপুরের আট উপজেলা থেকে নির্বাচিত ৪০ জনের মধ্য থেকে জেলায় পাঁচ জনকে নির্বাচিত করা হয়। এ পাঁচ জনকে জেলায় সেরা হওয়ার পুরস্কৃত করা হয়। জেলার সেরা পাঁচ নারীকে নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলা থেকে ৫৬ জন। এ ৫৬ জনের মধ্যে উল্লেখিত পাঁচ ক্যাটাগরীতে যে পাঁচজন জয়ী হয়েছেন তাঁদের একজন হচ্ছেন চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার রহিমা বেগম। তিনি বিভাগীয় পর্যায়ে সফল জননী নির্বাচিত হয়েছেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে এক  আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রহিমা বেগমসহ পাঁচজন বিজয়ী নারীকে পুরস্কৃত করেন। এরপর প্রত্যেক বিভাগ থেকে বিজয়ী পাঁচ জনকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পাঁচ জনকে বিজয়ী করা হবে।  সফল জননী রহিমা বেগম সম্পর্কে জানা গেছে, তাঁর গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ স্বামীর বাড়ি শাহরাস্তি উপজেলার পাথৈর গ্রামে। বাড়ির নাম ‘ইব্রাহীম হাজী বাড়ি’। তিনি পড়াশোনা করেছেন মাত্র প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত। তাঁর বাবা মরহুম মোজাফফর আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবার বাড়ি চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের দৈয়ারা গ্রামে। রহিমা বেগমের বিয়ে হয় ১৯৭৫ সালে। স্বামী মোঃ নজরুল হক সার্ভে অব বাংলাদেশ-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। বিয়ের ১২ বছর পর ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল পাঁচ সন্তান রেখে রহিমা বেগমের স্বামী নজরুল হক মারা যান। রহিমা বেগমের বয়স তখন ২৬ বছর। তখন তাঁদের বড় সন্তানের বয়স মাত্র ৯ বছর ৪ মাস। আর সর্ব কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স ছিলো মাত্র ৩ মাস। স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ সন্তান নিয়ে রহিমা বেগম গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। এ সময় তাঁকে আগলে রাখেন তাঁর পিতা মোজাফফর আহমদ। রহিমা বেগমের ভাইয়েরা স্বামীহারা  বোনকে আরেকটি বিয়ে করার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি  করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতা কোনোভাবেই তা হতে দেননি। মোজাফফর আহমদ নিজেই তার বিধবা মেয়ে ও পিতাহারা নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করতেন। রহিমা বেগম তাঁর স্বামীর পেনশনের সামান্য টাকা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন এবং ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যান। এ সামান্য টাকা দিয়ে তাঁর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তখন তিনি তাঁর যে সামান্য কিছু জমি ছিলো তাতে চাষাবাদ করে সে আয় দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যান। এ ছাড়া তিনি তাঁর  বসতবাড়িতে শাক সবজি, নারিকেল ও সুপারি গাছ লাগান  এবং উৎপাদিত শাক সবজি ও ফল বিক্রি করে কোনোমতে  ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও ভরণপোষণ চালিয়ে যান। তিনি  তখন তাঁর ছেলে-মেয়েদের ভালো খাবার ও ভালো পোশাক দিতে পারেননি। কিন্তু মাতৃস্নেহে অনেক কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। আজ তাঁরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।  যৌবনে তিনি সুখের পেছনে দৌড়াননি বলেই আজ সে সুখ পাখি তাঁর পেছনে দৌড়াচ্ছে। সুখ পাখি নিজেই এসে তাকে ধরা দিয়েছে। আজ তিনি সুখী। সামাজিক অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজ সমাজে তিনি একজন সফল গর্বিত জননী। রহিমা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ২ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়ে। ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বর্তমান অবস্থান হচ্ছে : ১ম সন্তান শাহনাজ আফরোজা রুমা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসএস ডিগ্রি লাভ করেন।  তিনি বর্তমানে সূচীপাড়া যুক্ত সরকারি প্রাথমিক  বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার স্বামী মোঃ আশিকুর রহমান সূচীপাড়া ডিগ্রি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। দ্বিতীয় সন্তান মোঃ নিজামুল হক (স্বপন) পটুয়াখালী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ২৭তম বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারধারী কৃষি কর্মকর্তা। তাঁর বর্তমান কর্মস্থল ঢাকা ফার্মগেট খামার বাড়ি। ৩য় সন্তান ফয়েজুন্নেছা (রুনা) চাঁদপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। তিনি চিতোষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার স্বামী মোঃ কামাল হোসেন চিতোষী ডিগ্রি কলেজের  প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক। চতুর্থ সন্তন কামরুন্নাহার রুবি যশোর কলেজে দর্শন বিজ্ঞান বিভাগে এম এ অধ্যয়নরত। তার স্বামী মোঃ জামাল হোসেন বেনাপোল স্থলবন্দরে ওয়্যার হাউজ সুপারিনটেনডেন্ট পদে কর্মরত। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ডাঃ তারেক মাহমুদ ৩৩তম বিসিএসে (লাইভ স্টক ক্যাটাগরি) ১৫১ জনের মধ্যে ১৯তম হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম ভেটেনারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ভেটেনারী মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি পোস্টিংয়ের অপেক্ষায় আছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top