সকল মেনু

বাংলাদেশ ক্রিকেট ২০১৩ : অনিশ্চয়তা-সাফল্য-কলঙ্ক

রবিউল ইসলাম, ৩০ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : অনেক সাফল্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ের দুয়ার উন্মোচিত হয় এ বছর। নতুন এক কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই সাথে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভেন্যু বাতিলের শঙ্কা নিয়েই শেষ হচ্ছে ২০১৩।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক অর্জনের বছর এটি। শুধু দলীয় অর্জন নয় ব্যক্তিগত নানা অর্জনে ভরপুর এ বছর। বাংলাদেশের ক্রিকেটও এমনই কিছু আনন্দের রসদ পেয়েছিল ২০১৩ সালে। যার মধ্যে উল্ল্লেখযোগ্য হলো- টেস্টে মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি, ২০১০-এর পর ফের নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাওয়াশ এবং ইতিহাসের পাতায় সোহাগ গাজীর নাম লেখানো এবং বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টিতে এসে এক ওভারে আল-আমিন হোসেন হ্যাটট্রিকসহ পাঁচ উইকেট। সারা বছরের বাংলাদেশের ক্রিকেটের নানা অর্জন কিংবা হতাশা বিষয়বস্তু নিয়ে জাস্ট নিউজের পাঠকদের জন্য নিন্মোক্ত এ আয়োজন।

বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ নিয়ে সংশয় : এখনো অনিশ্চিত টি-২০ বিশ্বকাপ। শুধু বিশ্বকাপ নয় সাথে এশিয়া কাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) সভা। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। ওই আলোচনার প্রেক্ষিতে ২০ জানুয়ারি নিশ্চিত হওয়া যাবে এশিয়া কাপের ভেন্যু বাংলাদেশে থাকছে কিনা। সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হোম সিরিজও। এতো সব অনিশ্চয়তা নিয়েই ক্রিকেটের বছর শেষ হতে যাচ্ছে।

তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শঙ্কা তৈরি হলেও ইতোমধ্যে সবগুলো ভেন্যু প্রস্তুত। বাংলাদেশের তিনটি মূল ভেন্যু আইসিসির সবুজ সংকেত এরইমধ্যে পেয়ে গেছে। সর্বশেষ নবনির্মিত সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম আইসিসি পরিদর্শক দলে সপ্তমবারের মতো এসে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে গেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা আইসিসির আন্তর্জাতিক ভেন্যু স্বীকৃতি। স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হোম সিরিজের আগেই ভেন্যু স্বীকৃতি প্রায় নিশ্চিত। মিরপুর শেরে-ই-বাংলা ও চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সামান্য কিছু কাজ ছিলো সেটাও বহু আগেই শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে আইসিসি বাংলাদেশের সবগুলো ভেন্যুকে বুঝেও পেয়েছে। নবনির্মিত সিলেট স্টেডিয়ামে মহিলা ক্রিকেটারদের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ছেলেদের সবগুলো এবং মেয়েদের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।

এর আগে ৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের লগো উন্মোচন করে বাংলাদেশের স্থানীয় এক পাঁচ তারকা হোটেলে। বাংলাদেশের পতাকার রং মিশ্রিত সবুজ-লাল কম্বিনেশনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের লগো। লগো উন্মোচনের পর গত ২৭ অক্টোবর রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ম্যাচ ফিকশ্চার ও টিকেট বিক্রির তারিখ নির্ধারণ করে।

সেখানেই নির্ধারণ হয় ১৭ নভেম্বর থেকে এনসিসি ও অগ্রণী ব্যাংকের ১০০টি শাখায় টিকেট বিক্রয়ের তারিখ। টি-২০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত টিকিটের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা দাম নির্ধারিত হয়। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে সর্বনিম্ন যথাক্রমে ১০০ ও ২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩ হাজার ও ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

টি-২০ প্রস্তুতিতে চ্যালেঞ্জ কাপ ও বিজয় দিবস টি-২০ টুর্নামেন্ট : টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আগামী বছর মার্চে। তাই সময়ও  খুব বেশি নেই ক্রিকেটারদের হাতে। এছাড়া বাংলাদেশের অধিনায়ক মুশফিক গত নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে একমাত্র টি-২০ ম্যাচ হেরে বলেছিলেন আমরা এখনো টি-২০ ফরম্যাট ক্রিকেটে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

ক্রিকেটারদের এই ফরম্যাটে অভ্যস্ত করানোর জন্যই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ক্রিকেটারদের নিয়ে চ্যালেঞ্জ কাপ ও বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি নামে দুটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। গত ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় দল ও এ দলের সমন্বয়ে দুটি দল নিয়ে ৩ ম্যাচের চ্যালেঞ্জ কাপ অনুষ্ঠিত হয়। নাসির হোসেনের নেতৃত্বাধীন এ দল মুশফিকের নেতৃত্বাধীন জাতীয় দলকে ৩-০ ব্যবধানে হারায়।

চ্যালেঞ্জ কাপ শেষে বিসিবির উদ্যোগে ৪ দলের সমন্বয়ে বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চলছে। যার ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে ৩১ ডিসেম্বর। আবাহনী, মোহামেডান, প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব ও ইউসিবি-বিসিবি একাদশ নিয়ে এ টুর্নামেন্টের প্রথম তিনটি রাউন্ড নবনির্মিতি সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে এ টুর্নামেন্টটি। বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আল-আমিন হ্যাটট্রিকসহ এক ওভারে ৫ উইকেট পাওয়ার কৃর্তি দেখান। বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি খেলায় মোহামেডান ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব ফাইনাল খেলার টিকেট পায়। এই টুর্নামেন্টে দেশের সেরা ৪ ক্রিকেটার চারটি দলের অধিনায়কত্ব করেন

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের নতুন চ্যাম্পিয়ন ‘গাজী ট্যাংক’ : অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে মাঠে গড়িয়েছিলো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের এবারকার আসর। মাঠে গড়িয়ে একাধিক তারিখ পরিবর্তন হয়েছিলো ঘরোয়া লিগের সর্বোচ্চ এ আসরটি। ১২টি ক্লাবের অংশগ্রহণে ১০ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার লিগ মাঠে গড়ায়। লিগের শুরুতেই স্পন্সর পেয়ে যায় বোর্ড। ২০১২-১৩ আসরের প্রিমিয়ার লিগের টাইটেল স্পন্সর হয় ‘ওয়ালটন’। হরতাল ও অবরোধে আটকে থাকার পর গত ৩০ নভেম্বর শিরোপা নিশ্চিত করে গাজী ট্যাংক। প্রাইম দোলেশ্বরকে ৬০ রানে হারিয়ে প্রথম বারের মতো শিরোপার স্বাদ  নেয় লুৎফর রহমান বাদলের গাজী ট্যাংক  ক্রিকেটার্স।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ক্ষণগণনা : রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্ষণগণনায় জমকালো আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ৫ জানুয়ারি একই সঙ্গে তিনটি শহরে জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ১০০ দিনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়। সিলেটে সুরমা নদীর তীরে, চট্টগ্রামে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে এবং ঢাকায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে আতশবাজীর মধ্য দিয়ে ১০০ দিনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়। প্রত্যেকটি ভেন্যুতে জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটাররা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রথম নির্বাচিত সভাপতি : এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন। এবারই প্রথম বিসিবির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে সরকারী কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই! পরিচালকদের সরাসরি ভোটে বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন নির্বাচনে সভাপতির পদে জয় লাভ করেন। ১২ অক্টোবর দুপুর বারোটায় ২৬ পরিচালকের মধ্যে ২৪ জনের সমর্থন পেয়ে পাপন প্রথম বারের মতো নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে বিসিবির দায়িত্ব পান। দুই পরিচালক (আফজালুর রহমান সিনহা ও শফিউল আলম চৌধুরি নাদেল) দেশের বাইরে থাকলেও আগেই তারা পাপনকে সমর্থন দিয়ে রেখেছিলেন। এর আগে ১০ অক্টোবর নির্বাচনে বোর্ড পরিচালনার জন্য সাবেক ৩ ক্রিকেটার সহ মোট ২৬ জন পরিচালক নির্বাচিত হন। বিসিবির নির্বাচনের জন্য ২৫ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্যের নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাচন কমিশনের প্রধান ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ক্রীড়া) আবদুর রহমান।

আবারো বাংলাওয়াশের স্বাদ পেলো টাইগাররা : আবারো বাংলাওয়াশের স্বাদ পেলো টাইগাররা। আগের দলটি ভারসাম্যহীন থাকলেও এবারকার দলটি ছিলো ভারসাম্যে ভরা। বাংলাদেশের সাকিব-তামিম ছাড়াই একদিনের ম্যাচে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিয়েছে ব্ল্যাক ক্যাপসদের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১০ সালের মতো এবারো ধারাবাহিক ক্রিকেট খেলেছে মুশফিকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতলেও হারতে হয়েছে এক ম্যাচের টি-টোয়েন্টি। অন্যদিকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের দুটি ম্যাচই ড্র হয়।

চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের স্পিনার ১৩৬ বছরের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন কৃর্তি করেছেন সোহাগ গাজী। ওই টেস্টে শতক করার পর হ্যাটট্রিকসহ নেন ৬ উইকেট। আর এতেই টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে যান পটুয়াখালীর এ ক্রিকেটার। এছাড়া মমিনুল হকও ১৮৯ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন চট্টগ্রাম টেস্টে। চট্টগ্রামের সুখসৃস্মি নিয়ে ঢাকা টেস্ট শুরু করে ক্রিকেটাররা। যদিও বৃষ্টি দেবতার প্রায় দুইদিন খেলা মাঠে গড়াতে দেয়নি। তাই ঢাকা টেস্টও ড্র। ঢাকা টেস্টেও শতক করে মুমিনুল হক টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড বুকে নাম লেখিয়ে নিয়েছেন।

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ড্র নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে ২৯ অক্টোবর প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামে বাংলাদেশ। নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচে, রুবেল হোসেনের অসাধারণ ফারফর্মম্যান্সে ৪৩ রানে জয় পায় বাংলাদেশ। ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় ম্যাচে ব্ল্যাককেপসদের উড়িয়ে দিয়ে সিরিজ নিশ্চিত করে টাইগাররা। তৃতীয় ও শেষ একদিনের ম্যাচে ৩০৭ রানের বিশাল স্কোর গড়েও জিততে পারেনি নিউজিল্যান্ড। হাইস্কোরিং এ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় লাভ করে ৪ উইকেটে। আর এ জয়ের ফলে টানা দুইবার ব্ল্যাক ক্যাপসদের বাংলাওয়াশ করে লাল-সবুজরা। ৬ নভেম্বর একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১৫ রানে হার মানে টাইগাররা। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বছরের শেষ সিরিজটি তাই ভালোভাবেই পার করছে লাল-সবুজরা।

জাতীয় দলের শ্রীলংকা সফর : বাংলাদেশ জাতীয় দল ২০১৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে মাঠে নামে। ৮ মার্চ মুশফিকবাহিনী শ্রীলংকার গল মাঠে প্রথম টেস্ট ম্যাচে মুখোমুখি হয়। সুনামী আক্রান্ত গলে শ্রীলংকার জেতার রেকর্ড ৯০ ভাগ। সেখানে বাংলাদেশ পাঁচদিন লড়াই করে শ্রীলংকার বিপক্ষে ড্র করে। ইতিহাস গড়ে মুশফিক, আশরাফুল ও নাসির। গল টেস্টের তৃতীয় দিনে আশরাফুল ১৮৯ রান করেন, যা বাংলাদেশির মধ্যে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে যে কোন দলের বিপক্ষে হাজার রানের মাইলস্টোনে প্রথম পা রাখেন আশরাফুল ( ১২ ম্যাচে ১০৪৭ রান)। কিন্তু চতুর্থ দিন পাল্টে যায় রেকর্ড। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম প্রথম বাংলাদেশি হয়ে টেস্ট ম্যাচে শতক হাকান। এরপর নাসির হোসেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক তুলে নেন। সাফল্যে ভরা গল টেস্টের পর কলম্বোতে বাংলাদেশ সাত উইকেটে পরাজিত হয়। টেস্টের সাফল্যের পর ওয়ানডে সিরিজের সাফল্য পায় টাইগাররা।

তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ হয়। বৃষ্টির কারণে দ্বিতীয় ম্যাচটি ভেস্তে যায়। এর আগে প্রথম ম্যাচে ডর্ক লুইস পদ্ধতিতে শ্রীলংকা আট উইকেটের জয় পায়। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশও ডর্ক লুইস পদ্ধতিতে তিন উইকেটের জয় পায়। সফরের একমাত্র টি-২০ ম্যাচেও ছিল টাইগারদের দাপট। শ্রীংলংকা আগে ব্যাট করে ১৯৮ রান জমা করে। জবাবে বাংলাদেশ ১৮১ রানের বেশি করতে পারেনি। শ্রীলঙ্কা সফর শেষে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম হয়। যেখানে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশে ক্রিকেট পারফরম্যান্স ছিলো নাজুক সেখানে ২০১৩ সালের সিরিজটা নতুন করে ক্রিকেট বিশ্বকে জানাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ উদিত হওয়ার খবর।

ব্যর্থতার জিম্বাবুয়ে সফর : শ্রীলংকা সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই নয় দিনের ব্যবধানে জিম্বাবুয়ে উড়ে যায় টাইগাররা। সফরের প্রথম ম্যাচে টাইগারা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও দ্বিতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। প্রথম টেস্ট জিম্বাবুয়ে জিতে নেয় ৩৩৫ রানের বিশাল ব্যবধানে। এরপর দ্বিতীয় টেস্ট টাইগাররা জিতে নেয় ১৪৩ রানে। টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজেও চলে তুমুল যুদ্ধ। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ ১২১ রানে জিতে নেয় বাংলাদেশ। এরপর ঘুরে দাড়ায় জিম্বাবুয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে টাইগারদের থেকে ছয় উইকেটের জয় ছিনিয়ে আনে। ১-১ এ সমতায় থাকা ওয়ানডে সিরিজের ফাইনালেও জিম্বাবুয়ে জয় পায়। বাংলাদেশকে পরাস্ত করে ৭ উইকেটে। ওয়ানডে সিরিজের হারের পর দুই ম্যাচের টি-২০ সিরিজ খেলে দুই দল। সমতায় শেষ হয় দুই দলের লড়াই।

প্রথমবারের মতো ফ্রাঞ্চ্যইজি ভিত্তিক জাতীয় ক্রিকেট লিগ: প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক জাতীয় ক্রিকেট লিগ আয়োজন করে। যার সক্ষিপ্ত নাম বিসিএল দেওয়া হয়। এই লিগে প্রথম গোলাপী বলে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ৭ টি বিভাগকে চারটি জোনে ভাগ করে চারটি ফ্রাঞ্চইজিকে দিয়ে দল পরিচালনা করা হয়। দলগুলো হলো ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন, বিসিবি নর্থ জোন, ইসলামী ব্যাংক সাউথ জোন এবং প্রাইম ব্যাংক ইস্ট জোন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল)র প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় ‘ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন’। মাঝপথে বিপিএলের দ্বিতীয় সেশনের খেলার জন্যে বিসিএল বন্ধ ছিলো। বিপিএলের একদিন পরই টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনালটি হয় দিবারাত্রির। বিসিবি নর্থ জোনের মুখোমুখি হয় ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন।  গোলাপি বলে প্রথম শিরোপা জয়েও ইতিহাস হয়ে থাকে ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন। ৭৪ রানে পরাজিত হয় বিসিবি নর্থ জোন। টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় তারা।

কলঙ্কিত ক্রিকেট ও নিষিদ্ধ আশরাফুল : বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে কালো অধ্যায় ২০১৩ সাল। সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুল স্পটফিঙিং ক্যালেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ক্রিকেটের থেকে সাময়িকভাবে নির্বাসিত হন। যদিও আশরাফুলের বিচার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। বছরের প্রায় পুরো সময়টা জুড়েই ছিলো আশরাফুলের নানা বিষয়ের নানা সংবাদ। পুরো বছর জুড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে সাফল্য সেটা আশরাফুলের এই কৃতি কিছুটা হলেও কুলষিত করেছে দেশের ক্রিকেটকে।

চলতি বছরের ৪ই জুন। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) কাছে ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশের ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ের খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে। আর মুহূর্তেই নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন টেস্টের সর্বকনিষ্ঠ এ সেঞ্চুরিয়ান।

২০০১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। শ্রীলংকার বিপক্ষে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে বিশ্ব-কাঁপানো অভিষেক ঘটে আশরাফুলের। এর ৩ বছর পর থেকেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফিঙিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আশরাফুল। তবে আশরাফুলের জড়িত থাকার বিষয়টি ধরা পরে বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে।

চলতি বছরে অনুষ্ঠিত বিপিএলে ৩টি ম্যাচ নিয়ে সন্দেহ হয় আকসুর। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-খুলনা ও ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-বরিশাল মধ্যেকার অনুষ্ঠিত ম্যাচে অনিয়ম হয়েছে-এমনটা আশংকা প্রকাশ করে আকসু। শুরু হয় তদন্ত। যার চূড়ান্ত ফল- আকসুর কাছে আশরাফুলের দোষ স্বীকার।

এমন অবস্থার মধ্যে চলতি বছরের আগস্টের ১৩ তারিখে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে বিপিএলে ফিঙিংয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আকসু। প্রতিবেদনে ফিঙিংয়ের সঙ্গে ৯ জনের জড়িত থাকার কথা বলা হলেও  কারও নাম বলা হয়নি। তবে জানা যায় এই তালিকায় থাকা ৯ জনের মধ্যে রয়েছেন- মোহাম্মদ আশরাফুল, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের মালিক সেলিম চৌধুরী, তাঁর ছেলে শিহাব চৌধুরী, প্রধান নির্বাহী ভারতের গওহর রাওয়াত, ৩ বোলার মোশাররফ হোসেন (রুবেল), মাহবুবুল আলম (রবিন) ও শ্রীলংকার কৌশল লোকুয়ারাচ্চি, ইংলিশ ব্যাটসম্যান ড্যারেন স্টিভেনস এবং বোলিং কোচ মোহাম্মদ রফিক।

অবশেষে গত মাসের ২৪ নভেম্বর কাজ শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের প্রধান সাবেক বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিন। জানা গেছে, এক মোহাম্মদ রফিক ছাড়া বাকি ৮ অভিযুক্তের পক্ষেই ট্রাইব্যুালের সামনে কোনও না কোনও ভাবে হাজির হয়েছিলেন তাঁদের আইনজীবীরা। এর মধ্যে মোহাম্মদ আশরাফুল আর ড্যারেন স্টিভেন্সের পক্ষে ব্রিটিশ আইনজীবী ইয়াসিন প্যাটেল কথা বলেন স্কাইপের মাধ্যমে। বাকি আইনজীবীরা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। সে সময় আইনজীবীরা জানিছিলেন, আগামী ১৯ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করা হয়েছে।

বিপিএলের দ্বিতীয় আসর : বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) প্রথম সেশনের নান ভুল-ক্রুটি নিয়েই দ্বিতীয় সেশনের বিপিএল মাঠে গড়ায়। প্রথম সেশনের টাকা পয়সা নিয়ে সমস্যা বিপিএলের দ্বিতীয় সেশনেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিপিএল গভনিং কাউন্সিল তথা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। তারপরও ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) দিয়ে। ১৮ জানুয়ারী মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটসের ও খুলনা রয়েল বেঙ্গলস। সাত দলের অংশগ্রহণে টুর্নামেন্ট ৩১ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় পরের মাসের ১৯ ফেব্রুয়ারী। ম্যাচে চিটাগং কিংসকে ৪৩ রানে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস। টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস। যদিও দ্বিতীয় সেশনের বিপিএল বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top