সকল মেনু

ঘুরে দাড়ানোর প্রত্যয়ে ঢাকাই ছবি

ঢাকা, ২৮ ডিসেম্বর: আক্ষেপ একটাই। শেষটা ভালো হল না। সিনেমা সংশ্লিষ্টদের ২০১৩-এর ছবি নিয়ে এই আক্ষেপ থেকেই যাচ্ছে। তবে বছরের শুরুটা ছিলো ভালোই। তার চেয়েও বেশি করে চোখে পরার বিষয় ছিলো ঢাকাই ছবির ঘুরে দাড়ানোর আভাস। ৩৫ মিলি মিটারে সিনেমা তৈরি এবং রিল দিয়ে ছবি প্রদর্শনের যুগের অন্তিম সময় আর ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শনের নবযাত্রা। এই দুইয়ে মিলে একটি নির্দিষ্ট দিকে যাত্রার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। যদিও দীর্ঘ হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের তালিকা। কমেছে এক বছরে ছবি মুক্তির সংখ্যা। নির্মিতব্য ছবির সংখ্যাও কমছে দিনকে দিন। ‘সুপারস্টার’ শব্দটির গুরুত্বও যে কমেছে দর্শক মহলে এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবুও আশা আছে। হলে বাড়ছে দর্শক সমাগম। ডিজিটাল ছবিগুলো একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে অর্ধশতেরও বেশি হলে। যারা অর্থলগ্নি করছেন তারাও কেউ কেউ লাভের মুখ দেখছেন। প্রযোজক ও পরিচালকরা আগ্রহী হচ্ছেন আবারও নতুন কোন প্রযোজনার জন্য। সবমিলিয়ে বলা যায় চলচ্চিত্র শিল্প এবং শিল্পীরা স্বপ্ন দেখেতে শুরু করেছেন। তারা স্বপ্ন দেখাচ্ছেনও। সেই স্বপ্নের পিঠে সাওয়ার হয়ে ঢাকাই ছবির পট পরিবর্তনের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা আগামী বছরে পাবে পূর্ণতা এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
indexএ বছর মোটে একান্ন ছবি:
বছরের শেষে এসে পিছিয়ে গেছে বেশ কিছু সিনেমার মুক্তি। চারপাশে অস্থির পরিবেশ এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে প্রযোজকরা একের পর এক স্থগিত করেছেন ছবি মুক্তি। বিশেষ করে এ বছরের বহুল আলোচিত সিনেমা ‘অগ্নি’, সামিয়া জামানের চলচ্চিত্র ‘আকাশ কত দূরে’, ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত ‘কি দারুণ দেখতে’ প্রভৃতির মুক্তির সকল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও শেষ মুহুর্তে এসে মুক্তি দেননি সংশ্লিষ্টরা। সরকারি অনুদান পাওয়া ছবি আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা’, পথিক মাসুদের ‘নেক্কাবরের মহাপ্রয়াণ’ও এই তালিকায় আছে। সব মিলিয়ে ২০১৩-এর শেষ তিনমাসে বেশকিছু ছবি মুক্তির কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। তারপরও সর্বমোট একান্নটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে চলতি বছর।

এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছবি ছিল ৩৫ মিলিমিটারে নির্মিত। বাকি সব ডিজিটাল সিনেমা। এ বছরের হিট বা মোটামুটি ভাবে অনেক প্রেক্ষাগৃহে চলেছে, এমন ছবিগুলোর মধ্যে  আছে ‘জোর করে ভালোবাসা হয় না’ ১৪০টি হলে, ‘নিষ্পাপ মুন্না’ ২০২টি, ‘জটিল প্রেম’ ২০০টি, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’, ‘অন্য রকম ভালোবাসা’, ‘দেহরক্ষী’ ১৭০টি, ‘মাই নেম ইজ খান’ ১৫০টি,  ‘এর বেশী ভালোবাসা যায় না’ ১১০টি, ‘প্রেম প্রেম পাগলামি’ ১৩৮টি, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ ১০৬টি হলে মুক্তি পায়।

২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো হলো: ‘লাভ ইন জঙ্গল’, ‘ভালবাসার বন্ধন’, ‘টেলিভিশন’, ‘জোর করে ভালবাসা হয় না’, ‘দেবদাস’, ‘অন্য রকম ভালবাসা’, ‘জীবন নদীর তীরে’, ‘আত্মঘাতক’, ‘পাগল তোর জন্য রে’, ‘শিরি ফরহাদ’, ‘মাটির পিঞ্জিরা’, ‘কাজলের দিনরাত্রি’, ‘কষ্ট আমার দুনিয়া’, ‘সেই তুমি অনামিকা’, ‘দেহরক্ষী’, ‘অন্তর্ধান’, ‘শিখণ্ডী কথা’, ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘জটিল প্রেম’, ‘এই তো ভালবাসা’, ‘নিষ্পাপ মুন্না’, ‘রোমিও ২০১৩’, ‘পোড়ামন’, ‘তোমার মাঝে আমি’, ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’, ‘ভালবাসা আজকাল’, ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘এর বেশি ভালবাসা যায় না’, ‘এক পায়ে নূপুর’, ‘ইভটিজিং’, ‘ঢাকা টু বোম্বে’, ‘মৃত্তিকা মায়া’, ‘কিছু আশা কিছু ভালবাসা’, ‘মন তোর জন্য পাগল’, ‘প্রেম প্রেম পাগলামী’, ‘রূপগাওয়াল’, ‘তবুও ভালবাসি’, ‘বাংলার পাগলু’, ‘কুমারী মা’, ‘ফুল এন্ড ফাইনাল’, ‘প্রেমিক নাম্বার ওয়ান’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’, ‘কি প্রেম দেখাইলা’, ‘অনিশ্চিত যাত্রা’, ‘একই বৃত্তে’, ‘আয়না কাহিনী’, ‘উধাও’, ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’, ‘তোমার আছি তোমারই থাকবো’, ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’, ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং ‘৭১-এর গেরিলা’।

এর মধ্যে ব্যবসা সফল সেরা দশ ছবির তালিকায় আছে ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’, ‘ভালোবাসা আজকাল’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’, ‘দেহরক্ষী, ‘ফুল এন্ড ফাইনাল’, ‘মাই নেম ইজ খান, ‘পোড়ামন’,  ‘ইভটিজিং’, ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’,   ‘জটিল প্রেম’।

ভিন্নধারার ছবি হিসেবে আলোচনায় ছিলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’। এ ছাড়া সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের ‘অন্তর্ধান’, গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’, কাজী মোরশেদের ‘একই বৃত্তে’, বেলাল আহমেদের ‘অনিশ্চিত যাত্রা’ এবং রাজ্জাকের ‘আয়না কাহিনী’ সিনেমাগুলোও ভিন্নধারার ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়।

অবস্থান নিয়ে নায়ক-নায়িকাদের ইঁদুর দৌড়:
এখন ঢাকাই ছবির ‘স্বঘোষিত সেরা নায়ক’ দুইজন। প্রযোজক পরিচালক অভিনেতা এম এ জলিল অনন্ত এবং ‘ঢাকার কিং’খ্যাত শাকিব খান। তাদের মধ্যে অনন্তের একমাত্র সিনেমা ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ নিয়ে মাতামাতি ছিলো ঢের। এই নায়কের একমাত্র নায়িকা এবং তার ঘরনি বর্ষাও ছিলেন আলোচনায়। সিনেমার পাশাপাশি তাদের দাম্পত্যকলহ নিয়েও তো আর কম নাটক হয়নি! অন্যদিকে শাকিব খানের সর্বাধিক নয়টি সিনেমা মুক্তি পায় ২০১৩ সালে। যার অনেকগুলোই দারুণ ব্যবসা করে। এছাড়া নতুনদেরকে নায়িকা হিসেবে বেছে নিয়ে তিনি সফলই ছিলেন বলে মত দেওয়া যায়। বিশেষ করে মাহিয়া মাহি ও ছোটপর্দার অভিনেত্রী জয়া আহসানের সঙ্গে তার দুই ছবি ‘ভালোবাসা আজকাল’ এবং ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ বেশ ভালো ব্যবসা করে।

এর পরের কাতারে ছিলেন উদীয়মান অভিনেতা বাপ্পি চৌধুরী, সাইমন, নিলয় প্রমুখ। এদের মধ্যে বাপ্পির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাতটি ছবি মুক্তি পায়। গত বছরের আলোচিত নায়ক ইমন বছর জুড়েই ছিলেন সংবাদপত্রের পাতায়। তার অভিনীত একটিমাত্র ছবি তেমন ব্যবসা না করতে পারলেও কাগুজে নায়ক হিসেবে তিনি ঠিকই খবর সরবরাহ করেছেন নিয়মিত। এছাড়া নীরবের তিনটি এবং আমানের চারটি ছবি মুক্তি পায়। আরেফিন শুভর দুটি ছবি মুক্তি পায় এ বছর। তার অভিনয়ও ছিলো আলোচনায় । ছোটপর্দার প্রিয় মুখ শুভ ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’তে সহঅভিনয় শিল্পী হিসেবে অভিনয় করলেও তার নায়োকোচিত ‘লুক’ অনেকের মনেই আশা জাগিয়েছে। এর পরপরই দেবাশীষ বিশ্বাসের ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ ছবিতে পুর্ণাঙ্গ নায়ক হিসেবে তার যাত্রাও হয়েছে শুভ। এই ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন আইরিন। ২০১৩ সালে ঢাকাই ছবির বড় আবিষ্কার টিভি পর্দার অভিজ্ঞ এবং জনপ্রিয় অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলনের আর্বিভাব ছিলো ঝড়ের মত। তার ও ববির ‘দেহরক্ষি’ ছবিটি দর্শক দারুণভাবে পছন্দ করে। এরপরে ‘পোড়ামন’ও ভালো ব্যবসা করেছে। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’খ্যাত নায়ক ফেরদৌসেরও দুটি ছবি মুক্তি পায় এ বছর।

আর, নারী অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে মাহির চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। তাছাড়া, অপু বিশ্বাস, ববি, নিপুণ,আঁচল এবং সাহারা অভিনীত ছবি মুক্তি পেয়েছে তিনটি করে।আর  মৌসুমীর দুটি। তাদের মধ্যে অপুর নিজেকে বদলে ফেলা এবং মাহিয়া মাহির মনকাড়া উপস্থিতিও নতুন দিশা দেখাচ্ছে বলেই মনে করেন অনেকে।

আড়ালে যত মুখ:
এ বছর আমরা হারিয়েছি ‘বাংলার মুকুটহীন নবাব’খ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, প্রবীণ অভিনেতা ও পরিচালক আকতার হোসেন, চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গীতিকার আহমেদ জামান চৌধুরী, চলচ্চিত্র কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার শচীন কুমার নাগ প্রমুখ। এছাড়া চলচ্চিত্রাঙ্গন ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাহারা ও পুর্ণিমা। আড়ালে চলে গেছেন ডিপজল।

সংখ্যার দিক থেকে একান্ন খুব ছোট হলেও ঢাকই ছবিতে আসছে বৈচিত্র। নির্মাণ, গল্প, অভিনয়সহ অনেক ক্ষেত্রেই তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন নায়ক- নায়িকারা তাদের গেটাপ ও মেকাপে যে পরিবর্তন এনেছেন তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। অন্যদিকে গ্রাফিক্স, সম্পাদনা, অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যবহার, দেশিয় লোকেশনকে ব্যবহার করে ছবি নির্মাণ করার যে প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাও আমাদের আশাবাদী করে। এ বছরে এমন অনেক ছবিই তৈরি হয়েছে যা আগামী বছরে মুক্তি পাবে সেসব ছবিতেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যদিও কোরিওগ্রাফি, কাহিনি, সংলাপ, অভিনয়সহ অনেক জায়গাতেই আমরা এখনও আনাড়ি। তবুও আমরা আশা করতেই পারি, স্বপ্ন দেখতেই পারি। একদিন আমরাও চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে হাজির হব বিশ্ব বাজারে। নান্দনিকতা, শিল্প-ভাবনা এবং মেধা ব্যবহার করে একদিন শিল্পের সর্বাধুনিক এই শাখাতেও বয়ে আনবো সম্মান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top