সকল মেনু

টমেটো চাষে কৃষকের ভাগ্যবদল

শানজানা জামান, , ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর:  গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ করেই যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ২৭টি গ্রামের কৃষক নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। যেসব কৃষকের তিন বেলা খাবারই জুটত না, তাদের অনেকেরই এখন ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। কেউ কেউ কিনেছেন জায়গাজমিও।

আষাঢ়-শ্রাবণ থেকে টানা ছয় মাস বাঘারপাড়ার কৃষকদের হাতে কাজ থাকত না। অনেকের জায়গাজমি বলতে কিছুই ছিল না। যে কারণে অনেক সময়ই তাদের ঠিকমতো তিন বেলা ভাতও জুটত না। অভাবের তাড়নায় তারা অন্য এলাকায় গিয়ে কামলা খাটতেন। অথচ তারা সবাই এখন স্বাবলম্বী।

গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে বাঘারপাড়ার কৃষকরা কিনছেন নানা ধরনের কৃষি সরঞ্জামও। কেউ কিনেছেন মোটরসাইকেল। সৃষ্টি হয়েছে অনেকের মৌসুমি কর্মসংস্থানের। লাভজনক হওয়ায় বাঘারপাড়ায় খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ। টমেটো আবাদে বিশেষ সফলতার জন্য কৃষি পদকও পেয়েছেন এখানকার সফল দুজন কৃষক।

১৯৯৫-৯৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাহাবউদ্দিন উচ্চ তাপমাত্রা সহনীয় এই টমেটোর জাত উদ্ভাবন করেন। দেশের কয়েকটি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এ জাতের টমেটোর চাষ করা হলেও একমাত্র যশোরের বাঘারপাড়ায় সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বলরামপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি টমেটো আবাদ করে আসছেন। আর এর সফলতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। অর্জন করেছেন জাতীয় কৃষি পদক। ২০০৫ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে সেরা টমেটো চাষির খেতাব পেয়েছেন।

কৃষক মো. জালালউদ্দিন জানান, গত মৌসুমে তিনি ২০ শতক জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ করেন। ২ লাখ ৪০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করেন তিনি। খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে জালাল উদ্দিন লাভ করেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।

‘অন্যান্য ফসল থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আবাদ করে বেশি লাভবান হচ্ছি। এ কারণে টমেটো আবাদ এবং বিক্রি করাই আমার একমাত্র ধ্যান।’ জানালেন জালাল উদ্দিন। টমেটো বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি ২০ লাখ টাকায় এক বিঘা জমিও কিনেছেন।

একই উপজেলার দাদপুর গ্রামের অন্যতম সফল চাষি পরিতোষ ঘোষ। তিন বছর ধরে তিনি গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ করছেন। পরিতোষ জানান, প্রথম বছর তিনি ৭ শতাংশ জমিতে চাষ করেন।

টমেটো চাষে অসাধারণ সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ২০১০ সালে পরিতোষ ঘোষের হাতে সেরা টমেটো চাষির পদক তুলে দেয়। টমেটো চাষে ধারাবাহিক সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনও ২০১২ সালে পরিতোষকে সেরা টমেটো চাষির পুরস্কার দেয়।

২০১২ সালে ১৮ শতাংশ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আবাদ করে পরিতোষ ঘোষ দেড় লাখ টাকা লাভ করেন। বেশি লাভজনক হওয়ায় চলতি মৌসুমে তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করবেন।

পরিতোষ জানান, চলতি বছর আবাদ সম্প্রসারণের জন্য টমেটো বিক্রির ১ লাখ টাকায় তিনি অন্যের জমি বন্ধক নিয়েছেন। এক ছেলে আর এক মেয়ের বাবা পরিতোষ এখন সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। একটি সেমিপাকা বাড়ি করেছেন। বছর বছর সম্প্রারণ করছেন টমেটোর আবাদ। ছেলেকে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়াচ্ছেন। আর মেয়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

বাঘাড়পাড়ার জামদিয়া ইউনিয়নের ছোট ভিটাবল্লা গ্রামের রফিকুল ইসলাম গত মৌসুমে ১৫ শতক জমিতে টমেটো আবাদ করেন। এতে তার খরচ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে তিনি ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করেছেন। এই জমি থেকে আরো অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারবেন বলে রফিকুল আশাবাদী।

তিনি জানান, এর আগে ১৫ শতাংশ জমিতে তিনি ধান আবাদ করেন। এতে ৯ মণ ধান উৎপাদিত হয়। প্রতি মণ ৬০০ টাকা হিসেবে তিনি মাত্র ৫ হাজার ৪০০ টাকার ধান বিক্রি করেন। সেই একই পরিমাণ জমিতে টমেটো আবাদ করে কয়েক গুণ বেশি লাভ করেছেন। আর এই লাভের টাকায় তিনি টমেটো আবাদ সম্প্রসারণ করবেন।

এজন্য তিনি ৭৮ শতক জমিও এ বছর বন্ধক নিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং লাভজনক ফসল হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন টমেটো। টমেটোর আবাদ করে এ এলাকার অনেক যুবক এখন দামি মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাড়িও করেছেন অনেকে।

কৃষকদের উদ্যোগে গঠিত দাদপুর-বলরামপুর টমেটো চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জালালউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত টমেটো বিক্রি করা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। স্থানীয় দাদপুর বাজারেই গড়ে উঠেছে টমেটোর বড় মোকাম। এ বাজারেই রয়েছেন চারজন পাইকারি আড়তদার। তারাই প্লাস্টিকের ক্যারোট (খাঁচি) পাঠিয়ে চাষিদের কাছ থেকে টমেটো সংগ্রহ করেন।’

জালাল জানান, এ বাজার থেকে প্রতিদিন অন্তত তিন থেকে চার ট্রাক টমেটো ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।

বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপঙ্কর দাশ বলেন, ভালো বীজ সঠিক সময়ে চাষ করলে  ভালো ফলন পাওয়া যায়। এই উপজেলার মাটি টমেটো চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাঘাড়পাড়ায় ২৮ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ হচ্ছে। পাশাপাশি এর আশপাশের গ্রামগুলোতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে।

গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ বেশি লাভজনক হওয়ায় তা খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তিন বছর আগে যেখানে মাত্র ১০ হেক্টর জমিতে এই টমেটোর আবাদ হতো, এখন তা ২৮ হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে বলে কৃষিবিদ দীপঙ্কর দাশ জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক শেখ হেমায়েত হোসেন জানান, যশোরে বর্তমানে ৬০ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে বাঘারপাড়ায় ২৮ হেক্টর জমিতে। সদর উপজেলায় চাষ হচ্ছে ১০ হেক্টরের বেশি জমিতে।

এই কর্মকর্তা আরো জানান, যশোরের গ্রীষ্মকালীন টমেটো ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। লাভজনক বলে অনেকেই এগিয়ে আসছেন টমেটো চাষে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top