প্রতিনিধি চট্টগ্রাম, ৪ ডিসেম্বর: গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের একটি বিশেষ খবর নানাভাবে ঘোরাঘুরি করছে। খবরটি হল ‘দুধের নদী’ নিয়ে।
পৃথিবীতে এ ধরনের কোন নদীর অস্তিত্ব নেই। সুতরাং বাংলাদেশের মতো অভাগা দেশের বেলায় তা না থাকারই কথা। কিন্তু দুধ ঢালতে ঢালতে এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নাকি দুধের নদীতে পরিণত হয়েছে! অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করা আর চাঁদে সাইদীকে দেখা বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে প্রায় সমান পর্যায়ের।
দুটি বিষয়ের মধ্যে বাস্তবতার দিক থেকে কিন্তু বিস্তর তফাত, এই যা। নদীতে হাজার হাজার লিটার দুধ ঢালা হয়েছে, হচ্ছে- এ বিষয়টি সত্যি। তবে তা হয়তো কর্ণফুলির খরস্রোতে মুহূর্তেই ভেসে গেছে, মিশে গেছে জলরাশির বুকে।
কিন্তু নদীতে দুধ ঢালার কষ্টে খামারীর চোখে যে জলস্রোতে বইছে তা মিশে যাচ্ছে তারই পোড়া দেহে। করার কিছুই নেই। নিরুপায়!
দুধের সঙ্কটে যেখানে সারা দেশের শিশুরা চিৎকার করে ঘর-দুয়োর মাথায় তোলার জোগাড় সেখানে চট্টগ্রামের দুগ্ধ খামারীরা নাকি রাস্তায় দুধের শ্রাদ্ধ দিচ্ছেন! ভাবা যায়?
যায়, এদেশে সবই ভাবা যায়। করাও যায়। আর তা-ই হচ্ছে দেদারছে।
সরকার আপনার কথা শুনছে না? ভয় নেই! আগে দেন দিন কয়েকের হরতাল। তারপর অবরোধ। আকাশ, নদী, জমিন সবই অবরোধ করে দেন। কথা আবার শুনবে না?
এ অবরুদ্ধ নীতির অবরোধ এ দেশে জন্মলগ্ন থেকেই কম-বেশি চালু। ফাঁকে-ফোঁকরে সব দলই জাতিকে অবরুদ্ধ করে দিয়ে শক্তি দেখায়।
সে রকম এক অবরোধ মৌসুম পার করছে এ দেশ। এখানে দুধের নদী, কান্নার সাগর, ধোয়ার আকাশ সবই হওয়া সম্ভব! এসব দেখে যারা অবাক হচ্ছেন তাদের বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ শুধু সড়ক, রেল, নদী ও আকাশে অবরুদ্ধ নয়; দেশটির মস্তিষ্কও আজ অবরুদ্ধ। আমরা সবাই অবরোধবাসী!
কারও কারও হয়তো বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে অথবা ভিমরি লাগছে। কিন্তু শুনেছেন কি চট্টগ্রামের প্রায় ৫০ হাজার দুগ্ধজীবীর কথা? আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিবেদক রেজাউল করিমের কাছ থেকে জেনে নেয়া যাক বিস্তারিত।
বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের টানা অবরোধে পথে বসার উপক্রম হয়েছে চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়া ও কর্ণফুলী এলাকার পাঁচ শতাধিক দুগ্ধ খামারী।
প্রতিদিন উৎপাদিত দুধ ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরবারাহ করতে না পারায় কোটি কোটি টাকার দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খামারীদের।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে পটিয়া দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র এলাকায় রাস্তার ওপর উৎপাদিত দুধ ঢেলে খামারীরা অবরোধের প্রতিবাদ জানান।
পশ্চিম পটিয়া-কর্ণফুলি ডেইরি এসোসিয়েশন ও সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন হায়দার জানান, অবরোধের কারণে চট্টগ্রামে পটিয়া ও কর্ণফুলী এলাকা থেকে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে পারছে না।
অপরদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে দুধের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থায় দুগ্ধ খামারীরা মারত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
টানা অবরোধ-হরতালে দুগ্ধ খামারীদের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে দাবি করে খামারী নাজিম উদ্দিন জানান, তারা দুধ বিক্রি করতে না পারায় প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এসব দুধ নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। টানা অবরোধ আর হরতালে দুধ বিক্রি করতে না পেরে খামারীরা শেষ পর্যন্ত নদী, পুকুর ও রাস্তায় দুধ ঢেলে ফেলে অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
দুগ্ধ খামারী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুছা জানান, পটিয়া ও কর্ণফুলী এলাকায় প্রায় ৫ শতাধিক দুগ্ধ খামারী প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করেন। এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে জড়িত। হরতাল অবরোধ আর সহিংসতার কারণে দুগ্ধ খামারীদের জীবন-জীবিকা এখম হুমকির মুখে রয়েছে।
রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করার সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম পটিয়া-কর্ণফুলি ডেইরি এসোসিয়েশন ও সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন হায়দার, সংগঠনের সাবেক সভাপতি হারুন নেভী, নুরুল আবছার চৌধুরী, দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি মুছা আদর্শ, মো. ইউছুপ, মো. বেলাল, মো. রিদোয়ান, মো.নুরু সওদাগর, মো. ফোরকান, মহিউদ্দিন, ছালাউদ্দিন, মো. রাসেল, হোসেন সওদাগর, আবদুল মান্নান, জাহেদ সওদাগর, মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. দিদার প্রমুখ।।
খামরীদের আশঙ্কা, অবরোধ আর কিছু দিন ধারাবাহিক থাকলে তাদেরই হয়তো দুধের নহরে ঝাপ দিয়ে পরপারে পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু তার আগে বাংলাদেশ কি পাল্টাবে না?
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।