সকল মেনু

মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার জীবন চলে ভিক্ষার চালে

  চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি, ১ ডিসেম্বর:  ‘আমগের খোঁজ নিয়ি আর কি হবিনে বাহাজি। এইজি দেকতি পাইচ্চু একুন আবার যুদ্দে যাইচ্চি। একাত্তুরে কান্দে আছিলু রাইফেল এহন ভিক্কির ঝুলা।
লোহের দুয়োরে, দুয়োরে ভিক্কির ঝুলি লয়ি বীর সন্তান হাত পা’তে পা’তে বলবিনে ও মা মাগো গো… ও….মা….এট্টা ভিক্কি দে মা…ও মা… এট্টা ভিক্কে দে…মা….। এই আমার জীবনের অর্জন, এইজি আমার জীবনবাজীর গল্প বাজান।

জাগোর লাগি যুদ্দে গেলাম, জাগোর জীবনে কষ্ট দিলাম হেই স্ত্রী, সুন্তানদের মুকি বাত জুগাইতে সব নুজ্জা ভুলি ভিক্কি চালে তাগের নিয়ে বহু সুহে আচি। সরকারের লোহেরা বীরের মুর্যাদা দিচে। এই বেরাকে এট্টা সুহির ঘর দিচে।’

অশ্রুশিক্ত দুঃখ ভারাকান্ত কন্ঠের কথা যেন তার থামেনা । দীর্ঘ ৪০ বছরের কষ্টের সব জ্বালা জুড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা এই বীরসন্তান গোলাম মোস্তফার। দু চোখের নোনা জলে তার বুক ভিজে যায়, তার চোখে চোখ রাখতে লজ্জা হয় নিজের, একজন বাঙ্গালি হিসেবে; বাংলাদেশি হিসেবে।

তাই স্বান্তনা না দিয়ে বীরের যুদ্ধের কাহিনী শুনি। গোলাম মোস্তফা জানান, ‘দেশমাতৃকার জন্নী জীবনের বাজি রাকি যুদ্দে গেচিলাম তার স্বাদ ব্যাস ভালই পাইতেচি। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর দেশের সরকারের কাচে আমার আর কিচুই চাবার নাই। ভিক্কি করি আর চায়ি খায়ি যে কডাদিন চলে।’

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বীর মুক্তি যোদ্ধা আর কিছু না পাক জীবনের শেষ সায়াহ্নে এসে শ্রেষ্ঠ সনদ ভিক্ষা বৃত্তির জুলিতো পেয়েছে? এখন তার জীবন চলে, ভিক্ষার চালে।

যোদ্ধা অশ্রুভরা নয়নে বলেন, ‘একবার  যুদ্ধের সাথী ক্যাপ্টেন সেনা প্রধান জেনারেল (অবঃ) মোস্তাফিজুর ১৯৯৪ সালের জীবননগরে আইচুলো। ওই সময় আমি হের সাথে দেহা করি হেয় আম্কে বুহে জরাই ধরি ৫ হাজার ট্যাহা দেয়।’

দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র করার স্বপ্ন নিয়ে মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জীবননগর উজেলার লক্ষিপুর গ্রামের মৃত আরশাদ আলীর ছেলে গোলাম মোস্তফা (৭৮)। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার-অবিচার, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীধর্ষণের মতো ঘটনা সহ্য করতে না পেরে চাকরির মায়া ছেড়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলেও তিনি এখন ভিক্ষাবৃত্তি করে ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটাচ্ছেন। ৭১’-এর রণাঙ্গনে যে হাতে অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন সেই হাতেই এখন ভিক্ষার ঝুলি তুলে নিয়েছেন দেশের গর্বিত ও শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা গালাম মোস্তফা।

চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে বাস যোগে ২৫ কিলো গেলেই মনোহর পুর। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝীবননগর কালিগন্জের প্রধান সড়কের পাশে আবাসন প্রকল্পের ১৩ নং ব্যারাকের ৭নং টিনের ছোট্ট একটি রুমে স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে থাকেন গোলাম মোস্তফা।

গত শনিবার বিকেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার সাথে দেখা করতে গেলে তাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যরা জানালেন, জীবিকার সন্ধানে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। তাঁর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। এক পর্যায়ে  সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার সময় ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে বাড়িতে এলেন গোলাম মোস্তফা।

আমাকে দেখার পর  বললেন, ‘আসেন বাজি আসেন আমাক কির লাগি খুঁজচেন?’ সব কথা বুঝিয়ে বলার তার টিনের ব্যারাকে ভিতরে তাড়া হুড়া করে চৌকির ওপর বসতে দিল। এর পর কৌতুহল দৃষ্টিতে জানতে চাইলো। কিসের জন্য তাকে খুঁজছি ।

মুক্তি যুদ্ধের কথা বলতেই তাঁর জীবনের নানা দুঃখের কথা বলতে শুরু করলেন গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘তখন আমার বয়স ৩৮ বছর। মুজাহিদ বাহিনীতে চাকরি করি। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর অত্যাচার-অবিচার, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতিবাদ এবং দেশের টানে যুদ্ধে যাবার সিন্ধান্ত গ্রহন করি।

পিতা না থাকায় মা ও স্ত্রী কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় স্ত্রী ও একমাত্র ৬ মাসের শিশু সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বাড়ির লোকজনকে কিছু না বলেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দেশ স্বাধীন হল, বিজয় উল্লাসের ধ্বনি মুখে নিয়ে সেদিন বাড়ী ফেরার পর শুরু হয় আমার জীবন চলার যুদ্ধ।

যুদ্ধে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। নিজের কোন জমি-যায়গা না থাকায় বসবাস করার জন্য রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় আশ্রয় নিই। সংসারের খরচ চালাতে দিনমজুরের কাজ শুরু করি। এক পর্যায়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ডান পা ও বাম হাত ভেঙ্গে যায়। এর পর থেকে আমি দিন মজুরের কাজ আর করতে পারিনি।

দুর্ঘটনার ১ সপ্তাহ পর কোন উপায় না পেয়ে পরিবারের ৪ সদস্যের মুখের খাবার জোগাড় করতে খুব ভোরে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। ভিক্ষা করতে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে। ভাবছি আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিবেবে কি ঠিক কাজ করছি!। যে হাতে অস্ত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সে হাতেই ভিক্ষার ঝুলি! কিন্তু পরক্ষনেই আবার সন্তানদের খাবারের কথা চিন্তা করে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছি।

১৯৭১-এ যুদ্ধের সময় যে চোখে হানাদার, রাজাকার, আলবদরের সন্ধান করেছি বৃদ্ধকালে সে চোখে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করছি। পায়েই এখন আমার অন্ন। পা চল্লে ভিক্ষার চাল বেশি হয়, না চল্লে হয় না।

এরই মাঝে মেয়ের জামাইয়ের যৌতুক হিসেবে দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় ২ বছর আগে সে বড় মেয়েকে তালাক দিয়েছে। সেও এখন তার দু’ সন্তানকে নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপেছে। বর্তমানে এলাকাবাসীর সহযোগীতায় মনোহরপুর আবাসন প্রকল্পে আমাকে একটি ঘর বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে ।

এ ঘরেই আমি, স্ত্রী, দু মেয়ে ও বড় মেয়ের দু’ সন্তানসহ ৬ জন বসবাস করছি। প্রতিমাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং সারাদিন ভিক্ষাবৃত্তি করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসারের ৬ সদস্য নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। সংসারে সবসময় টানাপোড়েন লেগেই থাকে।’

স্বাধীনতর দীর্ঘ ৪০ বছর পরও এমন বীর সন্তান গোলাম মোস্তফাদের কষ্টের কাহিনী যেন আর না লিখতে হয় এই প্রত্যাশা জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের আবাসন ব্যারাকের সহজ সরল মানুষদের। ব্যারাকবাসীরা বলেন দেশের বীর সন্তান ভিক্ষে করে খাবে এটা জাতির জন্য লজ্জা।

গোলাম মোস্তফা জানেন না কোন অপরাধে দেশ বাঁচিয়েও জীবনকে তিনি অভাবের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। তেমনি জাতি হিসেবে আমরাও জানিনা কোন অপরাগতায় দেশের সূর্য সন্তানদের জন্য সমৃদ্ধ-অভাবহীন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। তবে, এই লজ্জা চোখে দেখা যায় না।

আমাদের সমাজে অনেকেই আছি যারা হর হামেশাই অনেক টাকা অপচয় করে ফেলি অনায়াসে। যে টাকার পরিমাণ বীর গোলাম মোস্তফার সারা বছরের আয়েরও চাইতেও বেশি। আমরা কি পারিনা নিজেদের এই অপচয়ের পরিমাণটা একটু কমিয়ে এনে গোলাম মোস্তফার মত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকদের জীবনটাকে স্বাচ্ছন্দের করে তুলতে, আনন্দময় করে তুলতে। নিশ্চয় পারি। মানুষ তো মানুষেরই জন্য। তাই না?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top