সকল মেনু

আব্দুল্লাহর অব্যক্ত বেদনা

  মেহেরপুর প্রতিনিধি : ‘এই ধুপি! ধুপি!’- শহরের বিভিন্ন জায়গায় এমন হাঁক প্রায়ই শোনা যায়। প্রতিটি ধুপির দাম মাত্র ২ টাকা। শীতের সকালে ধুপি খেতে মজা; বিক্রিও বেশ! মজার এই ধুপি শীতে বিক্রি করে আমাদের সমাজের চিরচেনা অবহেলিত শিশুরা। আমরা ইচ্ছা করেই তাদের ধুপি বিক্রির পিছনের কাহিনি জানতে চাই না। অথচ শ্রমজীবী এই শিশুদের প্রত্যেকেরই জীবনে রয়েছে বড় ধরনের অব্যক্ত বেদনা আর কষ্টের কথা।

মেহেরপুর শহরের অলি-গলিতে শীতের সকালে ধুপি বিক্রি করে আব্দুল্লাহ (১১)। কখনও স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। হেমন্তের সকালের হালকা শীতে সে ধুপি বিক্রি করতে বের হয়। তার কাছ থেকে ধুপি কিনে খেতে পাড়া-মহল্লার অনেক শিশু অপেক্ষা করে। আব্দুল্লার চেনা কণ্ঠের ‘এই ধুপি! ধুপি!’ শুনলেই তারা ছুটে যায় তার কাছে।

শ্রমজীবী শিশু আব্দুল্লাহ মেহেরপুর শহরের গোরস্থানপাড়ার বড় বাবুর সন্তান। তারা ৫ ভাই-বোন। ৩ ভাইয়ের মধ্যে আব্দুল্লাহ বড়। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। যখন আব্দুল্লাহর স্কুলে যাবার বয়স তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এখান থেকেই শুরু হয় আব্দুল্লাহর কষ্টের জীবন। আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বিতীয় সংসারে স্ত্রী-কন্যা পেয়ে প্রথম সংসারের স্ত্রী-সন্তানদের কথা ভুলে গেছেন তার বাবা। তিনি এখন তাদের সংসারের জন্য যে টাকা দেন তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। মাসহ তাদের চার জনের মাসের ১৫ দিনের খরচও তাতে মেটে না।

আব্দুল্লাহ জানায়, তার মা ছামেনা খাতুন অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। সংসারের হালে পানি জোগাতে তাকেও পথে নামতে হয়েছে। বাধ্য হয়েই তাকে ধুপি বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতিদিন ভোর রাতে নানি জায়রা খাতুন তাকে আটা-গুড় দিয়ে প্রায় দেড়শ ধুপি তৈরি করে দেন। সেগুলো নিয়ে আব্দুল্লাহ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সকাল ৯টার মধ্যে সব ধুপি বিক্রি হয়ে যায়। প্রতিটি ধুপিতে তার প্রায় এক টাকা লাভ হয়। কিন্তু এই কাজ করে কি সংসারে সচ্ছলতা এসেছে? এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুল্লাহর ছোট্ট বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে জানায়, এ জন্য সন্ধ্যায় সে শহরের রাস্তায় সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে।

মনের মধ্যে অনেক কষ্ট চেপে রেখে আব্দুল্লাহ আরো জানায়, স্কুলে যাবার খুব ইচ্ছা ছিল তার। লেখাপড়া শিখে বড় হবে, বড় চাকরি করে পরিবারকে এগিয়ে নিবে- এমন স্বপ্ন সে দেখে। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাধ্য তার নেই। সংসার চালাতে গিয়ে তাকে স্কুলের স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়েছে। অথচ সকালে সে যখন ধুপি বিক্রি করে তখন তার মতো অনেক শিশুকে সে বাবা-মার হাত ধরে স্কুলে যেতে দেখে। তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না।

তবে আব্দুল্লাহ এখন স্বপ্ন দেখে তার ছোট দুই ভাই স্কুলে যাচ্ছে। তারা অনেক বড় হয়ে একদিন সংসারের হাল ধরবে। মেহেরপুরে আব্দুল্লাহর মতো এমন অনেক শিশু রয়েছে যারা জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে ভাগ্য বিড়ম্বনায়। তাদের পিঠে সংসারের বোঝা, ফলে স্কুল-ব্যাগ তাদের আর বইতে হয় না। উল্টো শহরের কোনো স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বাধ্য হয়েই ধুপি, চকলেট, আচার বিক্রি করতে হয়। মেহেরপুর সদর উপজেলার বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু লায়েছ লাবলু বলেন, ‘দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। এ জন্য আইন রয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। যে কারণে বিদ্যালয় থেকে শিশু ঝরে যাওয়ার হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি মনে করেন, শিশু শ্রমের উৎস খুঁজে বের করে তা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বন্ধ না হলেও কিছুটা রোধ হবে। আব্দুল্লাহদের আর রাস্তায় রাস্তায় ধুপি বিক্রি করতে হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top