সকল মেনু

মেয়ের মুখে বাবা আলতাফ মাহমুদের গল্প

 শানজানা জামান : মুঠোফোনে ডায়াল করতেই অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো এখন তো আমি বাইরে যাচ্ছি তুমি বিকালে আসো। ফোনের অপর প্রান্তের সেই মানুষটি বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। আজ শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ের সামনে বসে শুনবো তার বাবার গল্প। আনমনে গেয়ে চলেছি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই ছোটবেলা থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই খালি পায়ে যেতাম প্রভাত ফেরিতে। সবার কণ্ঠে থাকতো একটা গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।” এ গানটি যিনি সুর করেছেন আজ তার মেয়ের সামেনে বসে শুনবো সেই মহান মানুষটির গল্প। ভাবতে ভাবতে শাওন মাহমুদের দিলু রোডের বাড়িতে যখন গিয়ে হাজির হয়েছি তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।

বাড়ির দরজায় বেল চাপতেই স্বাগত জানালেন শাওন মাহমুদ। মুখ জুড়ে তার এমন ম্নিগ্ধ হাসি যেন কতো দিন ধরেই আমাকে চেনেন। ঢাকা থিয়েটারের অনুষ্ঠানে দু-একবার দেখেছি কিন্তু কোন দিনই পরিচয় হয় নি। প্রথম পরিচয়েই এমনভাবে আপন করে নিলেন যেন বহুদিন ধরে চেনেন আমাকে। বাঙালি মায়েরা মনে হয় এমনই হয়। আমার মায়ের ছায়া খোঁজে পেয়েছি শাওন মাহমুদের মুখ জুড়ে।

আলাপের শুরুতেই জানতে চাই একাত্তরে আপনার বয়স কতো ছিলো? স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে শাওন আপা জানালেন “একাত্তরের তেমন কিছুই আমার মনে নেই, তখন আমার বয়স তিন বছর। একাত্তরে বাবাকে হারিয়েছি, কিন্তু বাবা হারানোর বিষয়টি বুঝতে পেরেছি অনেক পরে। আমাকে সবাই বলতো যে বাবা ফিরে আসবে। অনেক বছর পরে আমি বুঝতে পেরেছি আমার বাবা আর কোন দিন ফিরে আসবে না।”

কথাগুলো বলতে বলতে স্নিগ্ধ চেহারায় ফুটে উঠলো বেদনার ছায়া। পরমুহূর্তেই জানালেন ক্ষোভের কথা ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই সবাই বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করেন। আর সারা বছর কেউ খোঁজও নেয় না। বাবার জন্ম-মৃত্যু দিনটাও কেউ মনে রাখে না। বাবাকে হারানোর পর আমাদের সংসারটাকে আগলে রেখেছেন মা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের পরিবার হিসেবে আমাদেরকে থাকার জন্য একটা সরকারী বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই বাড়ি থেকে আমাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। স্বাধীন দেশে আমাদেরকে ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে বিনা নোটিশে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়েছিলো।

জানতে চাই আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সম্পর্কে। শাওন আপা জানান, এটা করা হয়েছে এক ধরনের তাড়না থেকে। নতুন প্রজন্ম শহীদ আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাদের কাছে আলতাফ মাহমুদকে তুলে ধরার জন্য এ ফাউন্ডেশন কাজ করছে। আমরা এখন আলতাফ মাহমুদ পদক প্রবর্তন করেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য এখনো কাজ করে যাচ্ছে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে এ পদক দেয়া হবে।

কথাগুলো শুনছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম আলতাফ মাহমুদের পরিবারকেই দায়িত্ব নিতে হলো নতুন প্রজন্মের কাছে আলতাফ মাহমুদের আদর্শকে তুলে ধরার? আলতাফ মাহমুদ তো এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। তবে রাষ্ট্র কেন তার সন্তানদের কাছে পূর্ব পুরুষের বীরত্ব গাথা তুলে ধরছে না?

আমার এ ভাবনার অভিমানি জবাব যেন দিলেন শাওন আপা। তিনি বললেন, “আমি জহির রায়হান এর ছেলেকে বলেছি, তাজউদ্দিন আহমেদ এর মেয়ে রিমি আপার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাকেও বলেছি, রাষ্ট্র জহির রায়হান, তাজউদ্দিন আহমেদ, আলতাফ মাহমুদদের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে জানাবে না। তাই আমাদেরকেই এ কাজটা করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম জহির রায়হানের চাইতে অনেক বেশী জানে নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা চেয়ে গুয়েভারার গল্প। অবশ্যই নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভারাকে চিনতে হবে। কিন্তু সেই সাথে তাজউদ্দিন আহমেদ জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদদেরও চিনতে হবে। এ দায় আমাদের নিতে হবে। আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি জাতির সূর্য সন্তানদের কথা জানাতে পারি নি।

শাওন আপার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যখন বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি তখন মনে মধ্যে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আলতাফ মাহমুদের আদর্শকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায় কি শুধুই শাওন মাহমুদ আর তার পরিবারের? তাজউদ্দিন আহমেদকে আমরা যতোটা জানতে পারি তার পেছনেও তো তাজউদ্দিন আহমেদ এর মেয়ে সিমিন হোসেন রিমির ভূমিকায় বেশী। রাষ্ট্রের কি কোন দায় নেই এ মানুষগুলোকে চর্চা করার। ভাবছি আর করুণা হচ্ছিলো রাষ্ট্র কর্তাদের প্রতি। রাষ্ট্রের এই সূর্য সন্তানদের এভাবে আড়াল করে রেখে কতো দূর যেতে পারবে বাংলাদেশ? বার বার মনে হচ্ছিলো সেই চিরায়ত সংলাপ “যে দেশে গুণের সমাদর হয় না, সেই দেশে গণীজন জন্মায় না”।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top