সকল মেনু

রং মিস্ত্রীর প্রেমের বলি;দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীতে এক কিশোরী প্রেমের বলি হয়েছেন দুই যুবক। প্রেমিক রং মিস্ত্রির সঙ্গে ওই কিশোরী ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুই যুবককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন (৩২) ও কাইয়ুম হোসেন (৩০)। পুলিশ নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়েছে। চাঞ্চল্যর ঘটনাটি ঘটেছে রোববার রাতে রাজধানীর মিরপুরের মডেল থানার দক্ষিণ পীরের বাগের বটতলা গলি এলাকায়। পুলিশ জানায়, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পীরের বাগের ১ নম্বর সড়কের লেকভিউ সোসাইটির ২১/৫/বি বাড়ির পাশ থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ কিশোরীর প্রেমের ঘটনার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে দুই যুবককে হত্যা করা হয়েছে। এ দিকে হত্যাকান্ডের রাতেই পীরেরবাগের র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা পরিদর্শন করেছে। এ সময় সিআইডির ক্রাইমসিনের দল হত্যার আলামত সংগ্রহ করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অ্যাপাচি ও ডিসকভারি ব্রান্ডের দুটি মোটর সাইকেল ও একটি মোবাইলফোন উদ্ধার করেছে। ডাবল মার্ডারের ঘটনায় পীরেরবাগ এলাকায় চরম আতঙ্ক ও থম থমে পরিবেশ বিরাজ করছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয়রা জানায়, ডাবল মার্ডারের পিছনে কিশোরীর অসম প্রেমের ঘটনা এবং মাদক সংশ্লিষ্টতা জড়িত রয়েছে।
পুলিশ, স্থানীয় সুত্র ও স্বজনেরা জানায়, পীরেরবাগ বটতলা গলি এলাকার জনৈক ব্যক্তির কিশোরী কন্যার ( পুলিশ তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়) সঙ্গে একই এলাকার বাসিন্দা রং মিস্ত্রি বেলালের অসম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ ঘটনায় শুক্রবার ওই কিশোরী বাড়ি হতে পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিক রং মিস্ত্রিকে বিয়ে করেন। এ খবর জানার পরে কিশোরী পরিবারের লোকজন বেলালের বোন পারভীনের পীরের বাগ বাড়িতে যান। এ সময় তারা বেলাল ও কিশোরী বিয়ের ঘটনাটি জানায়। পরে তারা পারভীনের কাছে কিশোরী ও বেলাল কোথায় আছে এ কথা জানতে চাওয়ায় তাদের উপরে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পারভীন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চরম বাগবিতন্ডা হয়। উত্তেজিত মুহুর্তে পারভীন কিশোরী পরিবারের লোকজনকে শারীরিকভাবে প্রহার করে। পরে তারা বাধ্য হয়ে বেলালের বোনের বাড়ি থেকে চলে আসেন। এর পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে কিশোরী লোকজন দুটি মোটরসাইকেল করে আবার পারভীনের বাড়িতে যায়। এ সময় কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কেন্দ্র করে পারভীনের সঙ্গে ব্যাপক ঝগড়া বিবাদ ও চরম হট্রগোলের সৃষ্টি হয়। ঘটনার এক পর্যায়ে পারভীনের বাড়ির সামনে নিহত হন দুই যুবক জাহাঙ্গীর ও কাইয়ুম। খবর পেয়ে পুলিশ রাত ১২ টার দিকে পীরেরবাগের লেকভিউ সিটির এক নম্বরের রোডের নির্মানাধীন একটি বাড়ির পাশ থেকে লাশ উদ্ধার করে। এ সময় দুটি লাশ একই জায়গার আলাদা জায়গা থেকে তারা উদ্ধার করে। পুলিশের সুরাতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নিহতদের ধারালা অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শরীরের একাধীক স্থানে ধারালা অস্ত্রের অসংখ্য আঘাতে ক্ষত চিহৃ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা, হুমায়ন মিয়া জানান, আনুমানিক রাত তখন ১১টা বাজে। এ সময় মোটর সাইকেলের আওয়াজ তারা অনেকেই শুনতে পান। তার ক” সেকেন্ড পরে পারভীন নামে ওই মহিলার বাড়িতে বেশ হৈ চৈর শব্দ শুনা যায়। কিন্ত এর পরে পারভীনের বাড়িতে কি হয়েছে তার জানা নেই বলে জানান। তিনি বলেন, পীরেরবাগ এলাকায় নব্য সন্ত্রাসীদের আর্বিভাবে এলাকাবাসী অতিষ্ট। অজানা কোন বিপদের আশঙ্কায় তারা কেউ সাহস পায়না পাশের বাড়িতে কি হচ্ছে।
স্থানীয় সুত্র জানায়, নিহত জাহাঙ্গীর ও কাইয়ুম ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। কাইয়ুম দীর্ঘ দিন বিদেশে ছিলেন। বিদেশ থেকে দেশে আসার পরে কোন কাজ না করায় ঘটনাটি পছন্দ করত না তার পরিবার। এ নিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তার মনোমালিন্য চলছিলো। এককই বাড়িতে থাকার পরেও কাইয়ুম কে তার পরিবারের লোকজন আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেন। বাড়ির উত্তরকোনের আলাদা ঘরে থাকতেন কাইয়ুম। নিজের ঘরে কাইয়ুম তার বন্ধুদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা করতেন। ঘটনাটি তার পরিবারের কেউ পছন্দ করতনা জানার পরেও সকল কিছুই তিনি তোরাই কেয়ার করতেন। এভাবে বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কাইয়ুম নেশার জগতে পা বাড়ায়। এ সময় তার সঙ্গে ইলেকট্রিক দোকানদার জাহাঙ্গীরের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। জাঙ্গীর একদিকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন অন্যদিকে মিরপুরের দুই নম্বরে তার একটি ইলেকট্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। গত দেড় বছর আগে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে  কাইয়ুমের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। জাহাঙ্গীর পেশায় একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হওয়ায় মাঝে মধ্যে নেশা করতে। এরফলে তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল আরো গভীর। গত এক বছর আগে বরিশালের মেয়ে পুতুলকে জাহাঙ্গীর বিয়ে করেন।  বিয়ের পরে পতুল জানতে পারেন তার স্বামী নেশা করেন। এ নিয়ে স্বামী জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পুতুলের প্রায় ঝগড়া-বিববাদ হত। এ জন্য তাদের সংসারে অশান্তির শেষ ছিল না। জাহাঙ্গীর ও কাইয়ুম নেশার বনে যাওয়ায় তাদের সঙ্গে এলাকার বড় মাদক ব্যবসায়ীদের পরিচয় ঘটে। তাদের ইন্দনে দুই বন্ধু মিলে কিছু দিন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন। তারা দুজনে ছিলেন মানিকজোড়। কাইয়ুম এলাকার স্থানীয় হওয়ায় জাঙ্গীর তার সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখে ছিলেন। কিন্ত বিষয় তাদের দুই বন্ধুর পরিবার পছন্দ করত না। কিন্ত তার পরেও তাদের বন্ধুত্ব ছিলো অটুট। এ দিকে দুই বন্ধু ইয়া ব্যবসা করার শুরুতেই হোচট খায়। ব্যবসা শুরুর কিছু দিন পরে কাইয়ুম ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে ধরা পরেন। এ ঘটনায় তাকে কিছু দিন জেল খাটতে হয়েছে। এ সময় জাঙ্গীর কাইয়ুমকে জেল থেকে বেড় করতে টাকা পয়সা খরচ করে ছিলেন। জেলখানা থেকে কাইয়ুম বেড়িয়ে আসার পরে দুই বন্ধু মিলে তারা ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত তারা মাদক ব্যবসা ছাড়তে পারেন নি। এলাকার বড় ভাই বলে পরিচিত তাদের মাদক সরাবরাহকারীরা এ ব্যবসা তাদেরকে ছাড়তে দেয়নি। সুত্র জানায়, রোববার সন্ধ্যায় কাইয়ুম তার বন্ধুদের নিয়ে নিজের ঘরে নেশার আড্ডা জমিয়ে ছিল। সেই আড্ডায় জাঙ্গীরসহ তাদের পরিচিত ৪/৫ বন্ধুও সেখানে ছিলেন। ঘটনার রাতে ঘর পলাতাক কিশোরী ও রং মিস্ত্রি বেলালকে কেন্দ্র করে পারভীনের বাড়িতে ঝগড়া বিবাদের ঘটনা ঘটে। এর পরেই সেথানে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের হাতে দুই বন্ধু খুন হন। তবে নিহত দুটি পরিবার দাবী করেছেন জাহাঙ্গীর ও কাইয়ুম পরস্পর বন্ধুত্ব ছিলো না। এমনকি ঘটনার রাতে কিশোরী প্রেমের দরবার বা সালিশে তারা কেউ উপস্থিত ছিলো না। তবে কারা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এ ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না।

নিহত জাহাঙ্গীরের স্বজনেরা জানান, মিরপুর কাশেম আলী রোডে জাহাঙ্গীরের একটি ইলেট্রিক দোকান আছে। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন শ্যাওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের ভাড়া বাড়িতে। স্ত্রী সন্তান সম্ভ্যাবনা হওয়ায় গত ১৫ দিন আগে তাকে শ্বশুরবাড়ি বরিশালের কাওনিয়ায় রেখে আসেন জাহাঙ্গীর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিহতের বেয়াই শহীদুল জানান, পুলিশের কাছ থেকে সকালে জাহাঙ্গীর হত্যার খবর পেয়েছন তারা। কিন্ত কি কারনে তাকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে তারা কিছুই জানতে পারেন নি। এছাড়া জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রীর সংসারে জবা (৮) ও জেরিন (২) নামে তাদের দুটি মেয়ে রয়েছে বলে সুত্র জানায়। বড় ভাই শাহজাহান বলেন, তারা ৪ বোন দুই ভাই। তিনি ভাইর জন্য কান্নাজগিড় কন্ঠে বলেন, আমাদেরকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। ওর স্ত্রীর অনাগত সন্তানের কি হবে। কারা তার ভাইকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে কিছুই তাদের জানা নেই বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি ভাই হত্যার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি সাভার জেলার সদরের। তার পিতার নাম জয়নাল আবেদীন বলে জানান। এ দিকে নিহত কাইয়ুমের ভাই কায়েশ জানান, তার ভাই কাইয়ুম দীর্ঘ ১৪ বছর মালয়েশীয়া ছিলেন। গত দুই বছর ধরে তিনি দেশে ফিরেছেন। কিন্ত বিদেশ থেকে আসার পরে তার ভাই বেকার কাটিয়েছেন। মিরপুরের মধ্যে পীরেরবাগের ৭৮/৩ নম্বর বাড়িতে চার ভাই তিন বোন নিয়ে তাদের স্বপরিবার। তিনি বলেন, রোববার রাত ১১টার দিকে কাইয়ুম কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ছিলো। এর কিছুক্ষণ পরে তাদের কাছে খবর আসে তাদের বাড়ির অদুরে কাইয়ুম ও অপর এক অপরিচিত যুবককে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ সময় তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন জাহাঙ্গীরের থেকে একটু দুরে আলাদা জায়গায় তার ভাই কাইয়ুমের লাশ পড়ে আছে। পরে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে। কি কারনে এবং কারা তার ভাইকে হত্যা করতে পারে সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, এলাকায় তাদের কোন শত্রু আছে বলে জানা নেই। তিনি বলেন হত্যাকান্ডের ঘটনাটি পুলিশ তদন্ত করলেই বেড়িয়ে আসবে।
এ দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থলের পাশেই একটি চায়ের  দোকান রয়েছে। বটতলার পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনের কাজ চলছে। নির্মানাধীন ভবনের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ১২টার দিকে ২০-২৫ জন যুবকের মধ্যে হুড়াহুড়ি ও মারামারির শব্দ শুনতে পান তারা। তখন ভয়ে কেউ বের হননি। পরে ওই গলিতে দু’টি লাশ পড়ে থাকতে দেখে তারা পুলিশকে খবর দেন তারা।
মিরপুর থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন জানান, খুনের মোটিভ সম্পর্কে মোটামুটি জানা গেছে। পীরেরবাগের বেলাল নামে এক রং মিস্ত্রী একই এলাকার এক কিশোরীকে নিয়ে গত শুক্রবার পালিয়ে যায়। রোববার রাতে এ ষিয়টি নিয়ে পারভিনের লোকজনের সাথে তাদের হাতাহাতি হয়। পরে জাহাঙ্গীর ও কাইয়ুমসহ চার জন দুটি মোটর সাইকেলে ওখানে যান এবং দুই পক্ষের সংঘর্ষে তারা দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় পারভীন ও তার সক্ষামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করা হয়েছে। হত্যাকান্ডে জড়িতদের ধরার জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহৃত রয়েছে বলে তিনি জানান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top