সকল মেনু

৯ যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত, চার ঘটনায় ফাঁসি

saka-bg20130318045047 আছাদুজ্জামান হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা:  একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় এসেছে রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে।
যুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সাকার ফাঁসির আদেশ

পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ুন
এছাড়া হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা সহযোগিতা এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো তিনটি অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্যকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপহরণ ও নির্যাতনের দুটি ঘটনায় দেয়া হয়েছে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “মানবজাতির বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধ করার জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।”

১৭২ পৃষ্ঠার এই রায়ের সার সংক্ষেপে বলা হয়, সাংসদ সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে এ মামলায় প্রসিকিউশন যে ২৩টি অভিযোগ এনেছে, তার মধ্যে নয়টি (২ থেকে ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি।

আর প্রসিকিউশন শুনানির সময় কোনো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে রায়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি।

 
রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর এ স্থানেই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর এ স্থানেই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ফাঁসি

৩, ৫ , ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা ও অপহরণের পর খুন করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এই চার ঘটনাতেই এসেছে তার সর্বোচ্চ সাজার রায়।

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা এলাকায় কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়।

সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে প্রার্থনারত অবস্থা থেকে নূতন চন্দ্রকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হয়। সালাউদ্দিন কাদেরের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা নূতন চন্দ্রের ওপর গুলি চালানোর পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাকে গুলি করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।

অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযোগীরা পথ দেখিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের হিন্দুবসতিপূর্ণ বণিকপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে নেপাল চন্দ্র ধর, মণীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনীল বরণ ধর নিহত হয়। পরে বিভিন্ন বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনার সময় লুকিয়ে থাকা সনাতন বিশ্বাস ও তার পরিবার পরে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

এ ঘটনায় আনা গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে বলে বিচারক জানান।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে রাউজানের হিন্দু বসতি ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় সালাউদ্দিন কাদের ও তার কয়েকজন সহযোগী। মিটিংয়ে যোগ দেয়ার কথা বলে গ্রামের ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরপাড়ে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ওপর ব্রাশফায়ার করে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে চন্দ্র কুমার পাল, গোপাল মালী, সন্তোষ মালী, বলরাম মালীসহ ৫০ জনের পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় জানুতি বালা পাল কোমড়ে গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান। বেঁচে যাওয়া আরো অনেক হিন্দু পরিবারসহ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এ ঘটনায় গণহত্যা, দেশান্তরে বাধ্যসহ তিনটি অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফফর তার পরিবারসহ রাউজার থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে হাটহাজারীর তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় শেখ মুজাফফর ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে তাদের প্রাইভেট কার থেকে নামিয়ে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরে বিভিন্ন সময়ে তাদের মুক্তির জন্য সালাউদ্দিন কাদেরের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কারা দু’জন কখনো ফিরে আসেনি। পরে তাদের দুজনকে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে শেখ মুজাফফর ও শেখ আলমগীরকে অপহরণ ও হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে।

 

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় একসাথে ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় একসাথে ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০ বছর জেল
২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা সহযোগিতা এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের সিংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। প্রতিটি অভিযোগে তাকে দেয়া হয়েছে ২০ বছর করে কারাদণ্ড।

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে রাউজানের মধ্যগহিরা হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। পরে ডা. মাখনলাল শর্মার বাড়ির আঙিনায় নিরস্ত্র হিন্দুদের একত্রিত করে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের নির্বিচারে গুলি করে। এ ঘটনায় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, জ্যেতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ডা. মাখনলাল শর্মা ঘটনার তিন-চারদিন পর মারা যান। জয়ন্ত কুমার শর্মা গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

এ ঘটনায় গণহত্যা, এর পরিকল্পনা ও সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় ফটিকছড়ির এই সাংসদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় যান সালাউদ্দিন কাদের। ওই দিন সকালবেলায় সালাউদ্দিনের অন্য দুই সহযোগীকে ওই গ্রামে পাঠিয়ে একটি মিটিংয়ে যোগ দেয়ার জন্য বলা হয় গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। পরে গ্রামটি ঘিরে ফেলে কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জমায়েত হওয়া হিন্দুদের ওপর নির্বচারে গুলি চালানো হলে তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমীর কান্তি চৌধুরী, অশোক চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন।

এছাড়া অমলেন্দ্র বিকাশ চৌধুরী, জ্যোৎস্না বালা চৌধুরী ও ছবি রাণী দাস গুরুতর আহত হন।এরা প্রত্যেকে পরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘর লুটপাট করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, সহযোগিতা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে রাউজান পৌরসভা এলাকায় সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে যান সালাউদ্দিন কাদের। এসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সতীশের কথা কাটাকাটির পরে সালাউদ্দিন কাদের পাকিস্তানি সেনাদের বলেন, ‘এ ভয়ঙ্কর লোক এবং একে মেরে ফেলা উচিত’।

এসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সতীশ চন্দ্রকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে এবং তিনি ভেতরে যাওয়ার পথেই তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ ঘরের খেতরে রেখে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার পরে সতীশ চন্দ্রের পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে যায়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে সতীশ চন্দ্রের হত্যা ও বাড়ি পোড়ানোতে সহযোগিতা এবং দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়।

 
উনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। উনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। ৫ বছর কারাদণ্ড
১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে সালাউদ্দিন কাদেরকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ১৭: ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা-সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন সহযোগী ও পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি থেকে নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সিরাজ, ওয়াহিদ ওরফে জানু পাগলাকে অপহরণ করা হয়। তাদেরকে গুডস হিলে নিয়ে নির‌্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে একসময় ওয়াহিদ ওরফে জানুকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে নাজিমুদ্দিন ও সিরাজকে স্বাধীনতার আগে পর‌্যন্ত আটকে রাখা হয়। এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১৮: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চাঁদগাঁও থানাধীন মোহরা গ্রামের মো. সালাহউদ্দিনকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে আটকে রেখে নির‌্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

খালাস

বিচারক রায়ে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এ কারণে তাকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়।

অভিযোগ ১: রাউজানের আন্ধারমানিকে অরবিন্দ সরকার, মতিলাল সরকার, অরুণ চৌধুরী, শান্তি কুসুম চৌধুরী, যোগেশ চন্দ্র দে, কুমিল্লা গ্রামের পরিতোষ দাস ও সুনীলকে ১৯৭১ সালের ৪ অথবা ৫ এপ্রিল অপহরণ করে ‘গুডস হিলে’ নিয়ে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এদের মধ্যে সুনীল কমবয়সী হওয়ায় তাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত করা হয়। বাকি ছয়জনকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়।

নিহতরা নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের হওয়ায় এ ঘটনায় গণহত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

অভিযোগ ১০: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের ডাবুরা গ্রামের মানিক ধরের বাড়িতে লুটপাট এবং ওই এলাকার চেয়ারম্যান সাধন ধরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এসময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের।

 
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর হিন্দু বসতিপূর্ণ শাকপুরা গ্রামে সালাউদ্দিন কাদের ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর গুলি চালায় এবং বেয়নেট চার্জ করে তারা। এ ঘটনায় ফয়েজ আহমেদ, জালাল আহমেদ, হাবিলদার সেকান্দার আলী, অরবিন্দ ধরসহ ৭৬ জনকে শাকপুরা প্রাইমারী স্কুলের নিকটবর্তী জঙ্গল ও ধানক্ষেতে নিয়ে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া অনেকে ভারতে পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় গণহত্যা ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয় সেই সময়ের মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১২: ১৯৭১ সালের ৫ মে মাসে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে জগৎমল্লপাড়ায় নিয়ে যায় সালাউদ্দিন কাদের। তার উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বিজয়কৃষ্ণ চৌধুরী, বিভূতি ভূষণ চৌধুরী, হরেন্দ্র লাল চৌধুরীকে হত্যা করে।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ ১৪: ১৯৭১ সালের ২০ মে বিকাল ৪টার দিকে সালাউদ্দিন কাদেরের সহযোগিতায় রাউজানের পাথেরহাটের কর্তা দিঘীর পাড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. হানিফের বাড়িতে গিয়ে তাকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। হানিফকে ছাড়িয়ে আনার জন্য নাজমা খাতুন নামে এক নারীকে সেখানে পাঠান হানিফের স্ত্রী। নাজমা ফিরে এসে জানান হানিফের মুক্তিপণ হিসেবে ১ হাজার টাকা চেয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের। তিনি আরো জানান, হানিফকে নির‌্যাতন করা হচ্ছে গুডস হিলে। হানিফ পরে কখনো ফিরে আসেননি।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা হয় অপহরণ, আটক, নির‌্যাতন ও হত্যার অভিযোগ।

অভিযোগ ১৯: ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা হাটহাজারী এলাকা থেকে কিন ভাই নুর মোহাম্মদ, নুরুল আলম ও মাহবুব আলমকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের আটকে রেখে নির‌্যাতন করা হয়। পরে এক হাজার টাকার বিনিময়ে নুর আলম ও নুর মোহাম্মদকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে নূর মোহাম্মদ জানতে পারেন, তার ভাই মাহবুব আলমকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ এনেছিল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

অভিযোগ ২০: ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই বিকাল ৩টা/৪টার দিকে কদুর খালী গ্রাম থেকে এখলাস মিয়াকে আটক করে বোয়ালখালী রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে রাজাকাররা।

পরে তাকে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত্যু পর‌্যন্ত নির‌্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে আটক, নির‌্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ ২৩: ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জামাল খান এলাকা থেকে এম সলিমুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির এক হিন্দু কর্মচারীকে নির‌্যাতন করে সালাউদ্দিন কাদেরের সহযোগীরা। তাতে বাধা দিলে এম সলিমুল্লাহকে হুমকি দেয়া হয় এবং পরে আটক গুডস হিলে নিয়ে সারারাত নির‌্যাতন করা হয়।

এ ঘটনায় এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

 

মূল্যায়ন হয়নি ৬ অভিযোগের

প্রসিকিউশন ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগে দুটি গণহ্যতাসহ বেশ কিছু অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের জড়িত থাকার কথা বললেও কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। এ কারণে রায়ে এসব অভিযোগের মূল্যায়নও করা হয়নি।

অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি জিপগাড়িতে করে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী রাজাকার ক্যাম্পে যান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি ওই রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান করার সময় মুন্সীরহাট থেকে শান্তি দেবকে ধরে নিয়ে বণিকপাড়ায় নিয়ে হত্যা করা হয়। একই সময়ে সেনাবাহিনী কণিকপাড়ার রাম বাবুর বাড়ি ও কদুরখালির হিন্দু পাড়ার বাড়ি লুট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এসব এলাকার অনেক হিন্দু পরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

এসব ঘটনায় গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১৩: ১৯৭১ সালের ১০ মে সন্ধ্যার দিকে সালাউদ্দিন কাদের, তার বাবা ও সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য অলি আহমেদের নির্দেশনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সমর্থক অধ্যুষিত ঘাসি মাঝিরপাড়া এলাকায় পৌঁছায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

সেখানে বিভিন্নজনের বাড়িতে লুটপাট চালায় তারা। এসময় অন্তত পাঁচজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও দুই জনকে গুরুতর আহত করা হয়। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- নুরুল আমীন, আবুল কালাম, জানে আলম, মিয়া খাঁ, আয়েশা খাতুন ও সালেহ জহুর। আহতরা হলেন মুন্সী মিয়া ও খায়রুল বাশার।

এ ঘটনায় আনা হয় গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ।

অভিযোগ ১৫: ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শেখ মায়মুন আলীকে চন্দনপুরে তার বন্ধু ক্যাপ্টেন বখতিয়ারের বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এসময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের। শেখ মায়মুন আলীকে গুডস হিলে নিয়ে নির‌্যাতন করা হয়। পরে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ছাড়িয়ে আনে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা।

সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় এ ঘটনায়।

অভিযোগ ১৬: ১৯৭১ সালের ৭ জুন চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গুডস হিলে নিয়ে আসা হয় ওমর ফারুককে। সেখানে তাকে নির‌্যাতনের পরে সালাউদ্দিন কাদেরের নির্দেশে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে ফজলুল কাদেরের ছেলের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ২১: মুক্তিযুদ্ধের সময় অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা আটক করে গুডস হিলে নিয়ে যায়। তাকে ৩/৪ দিন ধরে নির‌্যাতন করা হয় এবং পরে ছেড়ে দেয়া হয়। নির‌্যাতনের ফলে ফজলুল হক পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ২২: একাত্তরের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সালাউদ্দিন কাদের ও তার সহযোগী আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার আব্দুল হাকিম চৌধুরীর বাড়ি থেকে মো. নুরু চৌধুরীকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে আটকে রেখে নির‌্যাতনের পরে তার বাবার কাছ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় বিএনপির এই সাংসদের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর গত বছরের ৪ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।
খবর > বাংলাদেশ > ৯ যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত, চার ঘটনায় ফাঁসি
৯ যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত, চার ঘটনায় ফাঁসি
কাজী শাহরিন হক, সুলাইমান নিলয় ও নাহিদ আশরাফী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 01 Oct 2013 18:10 BdST Updated: 01 Oct 2013 21:10 BdST
Previous Next
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় এসেছে রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে।
172
8
0 Print Friendly and PDF
RELATED STORIES
যুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সাকার ফাঁসির আদেশ
01 October 2013
RELATED FILES
পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ুন
এছাড়া হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা সহযোগিতা এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো তিনটি অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্যকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপহরণ ও নির্যাতনের দুটি ঘটনায় দেয়া হয়েছে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “মানবজাতির বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধ করার জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।”

১৭২ পৃষ্ঠার এই রায়ের সার সংক্ষেপে বলা হয়, সাংসদ সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে এ মামলায় প্রসিকিউশন যে ২৩টি অভিযোগ এনেছে, তার মধ্যে নয়টি (২ থেকে ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি।

আর প্রসিকিউশন শুনানির সময় কোনো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে রায়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি।

 
রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর এ স্থানেই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর এ স্থানেই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ফাঁসি

৩, ৫ , ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা ও অপহরণের পর খুন করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এই চার ঘটনাতেই এসেছে তার সর্বোচ্চ সাজার রায়।

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা এলাকায় কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়।

সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে প্রার্থনারত অবস্থা থেকে নূতন চন্দ্রকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হয়। সালাউদ্দিন কাদেরের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা নূতন চন্দ্রের ওপর গুলি চালানোর পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাকে গুলি করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।

অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযোগীরা পথ দেখিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের হিন্দুবসতিপূর্ণ বণিকপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে নেপাল চন্দ্র ধর, মণীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনীল বরণ ধর নিহত হয়। পরে বিভিন্ন বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনার সময় লুকিয়ে থাকা সনাতন বিশ্বাস ও তার পরিবার পরে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

এ ঘটনায় আনা গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে বলে বিচারক জানান।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে রাউজানের হিন্দু বসতি ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় সালাউদ্দিন কাদের ও তার কয়েকজন সহযোগী। মিটিংয়ে যোগ দেয়ার কথা বলে গ্রামের ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরপাড়ে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ওপর ব্রাশফায়ার করে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে চন্দ্র কুমার পাল, গোপাল মালী, সন্তোষ মালী, বলরাম মালীসহ ৫০ জনের পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় জানুতি বালা পাল কোমড়ে গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান। বেঁচে যাওয়া আরো অনেক হিন্দু পরিবারসহ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এ ঘটনায় গণহত্যা, দেশান্তরে বাধ্যসহ তিনটি অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফফর তার পরিবারসহ রাউজার থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে হাটহাজারীর তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় শেখ মুজাফফর ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে তাদের প্রাইভেট কার থেকে নামিয়ে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরে বিভিন্ন সময়ে তাদের মুক্তির জন্য সালাউদ্দিন কাদেরের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কারা দু’জন কখনো ফিরে আসেনি। পরে তাদের দুজনকে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে শেখ মুজাফফর ও শেখ আলমগীরকে অপহরণ ও হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে।

 

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় একসাথে ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় একসাথে ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০ বছর জেল
২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা সহযোগিতা এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের সিংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। প্রতিটি অভিযোগে তাকে দেয়া হয়েছে ২০ বছর করে কারাদণ্ড।

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে রাউজানের মধ্যগহিরা হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। পরে ডা. মাখনলাল শর্মার বাড়ির আঙিনায় নিরস্ত্র হিন্দুদের একত্রিত করে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের নির্বিচারে গুলি করে। এ ঘটনায় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, জ্যেতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ডা. মাখনলাল শর্মা ঘটনার তিন-চারদিন পর মারা যান। জয়ন্ত কুমার শর্মা গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

এ ঘটনায় গণহত্যা, এর পরিকল্পনা ও সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় ফটিকছড়ির এই সাংসদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় যান সালাউদ্দিন কাদের। ওই দিন সকালবেলায় সালাউদ্দিনের অন্য দুই সহযোগীকে ওই গ্রামে পাঠিয়ে একটি মিটিংয়ে যোগ দেয়ার জন্য বলা হয় গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। পরে গ্রামটি ঘিরে ফেলে কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জমায়েত হওয়া হিন্দুদের ওপর নির্বচারে গুলি চালানো হলে তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমীর কান্তি চৌধুরী, অশোক চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন।

এছাড়া অমলেন্দ্র বিকাশ চৌধুরী, জ্যোৎস্না বালা চৌধুরী ও ছবি রাণী দাস গুরুতর আহত হন।এরা প্রত্যেকে পরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘর লুটপাট করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, সহযোগিতা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে রাউজান পৌরসভা এলাকায় সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে যান সালাউদ্দিন কাদের। এসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সতীশের কথা কাটাকাটির পরে সালাউদ্দিন কাদের পাকিস্তানি সেনাদের বলেন, ‘এ ভয়ঙ্কর লোক এবং একে মেরে ফেলা উচিত’।

এসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সতীশ চন্দ্রকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে এবং তিনি ভেতরে যাওয়ার পথেই তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ ঘরের খেতরে রেখে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার পরে সতীশ চন্দ্রের পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে যায়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে সতীশ চন্দ্রের হত্যা ও বাড়ি পোড়ানোতে সহযোগিতা এবং দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়।

 
উনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। উনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। ৫ বছর কারাদণ্ড
১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে সালাউদ্দিন কাদেরকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ১৭: ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা-সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন সহযোগী ও পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি থেকে নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সিরাজ, ওয়াহিদ ওরফে জানু পাগলাকে অপহরণ করা হয়। তাদেরকে গুডস হিলে নিয়ে নির‌্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে একসময় ওয়াহিদ ওরফে জানুকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে নাজিমুদ্দিন ও সিরাজকে স্বাধীনতার আগে পর‌্যন্ত আটকে রাখা হয়। এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১৮: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চাঁদগাঁও থানাধীন মোহরা গ্রামের মো. সালাহউদ্দিনকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে আটকে রেখে নির‌্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

খালাস

বিচারক রায়ে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এ কারণে তাকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়।

অভিযোগ ১: রাউজানের আন্ধারমানিকে অরবিন্দ সরকার, মতিলাল সরকার, অরুণ চৌধুরী, শান্তি কুসুম চৌধুরী, যোগেশ চন্দ্র দে, কুমিল্লা গ্রামের পরিতোষ দাস ও সুনীলকে ১৯৭১ সালের ৪ অথবা ৫ এপ্রিল অপহরণ করে ‘গুডস হিলে’ নিয়ে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এদের মধ্যে সুনীল কমবয়সী হওয়ায় তাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত করা হয়। বাকি ছয়জনকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়।

নিহতরা নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের হওয়ায় এ ঘটনায় গণহত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

অভিযোগ ১০: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের ডাবুরা গ্রামের মানিক ধরের বাড়িতে লুটপাট এবং ওই এলাকার চেয়ারম্যান সাধন ধরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এসময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের।

 
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর হিন্দু বসতিপূর্ণ শাকপুরা গ্রামে সালাউদ্দিন কাদের ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর গুলি চালায় এবং বেয়নেট চার্জ করে তারা। এ ঘটনায় ফয়েজ আহমেদ, জালাল আহমেদ, হাবিলদার সেকান্দার আলী, অরবিন্দ ধরসহ ৭৬ জনকে শাকপুরা প্রাইমারী স্কুলের নিকটবর্তী জঙ্গল ও ধানক্ষেতে নিয়ে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া অনেকে ভারতে পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় গণহত্যা ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয় সেই সময়ের মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১২: ১৯৭১ সালের ৫ মে মাসে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে জগৎমল্লপাড়ায় নিয়ে যায় সালাউদ্দিন কাদের। তার উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বিজয়কৃষ্ণ চৌধুরী, বিভূতি ভূষণ চৌধুরী, হরেন্দ্র লাল চৌধুরীকে হত্যা করে।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ ১৪: ১৯৭১ সালের ২০ মে বিকাল ৪টার দিকে সালাউদ্দিন কাদেরের সহযোগিতায় রাউজানের পাথেরহাটের কর্তা দিঘীর পাড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. হানিফের বাড়িতে গিয়ে তাকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। হানিফকে ছাড়িয়ে আনার জন্য নাজমা খাতুন নামে এক নারীকে সেখানে পাঠান হানিফের স্ত্রী। নাজমা ফিরে এসে জানান হানিফের মুক্তিপণ হিসেবে ১ হাজার টাকা চেয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের। তিনি আরো জানান, হানিফকে নির‌্যাতন করা হচ্ছে গুডস হিলে। হানিফ পরে কখনো ফিরে আসেননি।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা হয় অপহরণ, আটক, নির‌্যাতন ও হত্যার অভিযোগ।

অভিযোগ ১৯: ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা হাটহাজারী এলাকা থেকে কিন ভাই নুর মোহাম্মদ, নুরুল আলম ও মাহবুব আলমকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের আটকে রেখে নির‌্যাতন করা হয়। পরে এক হাজার টাকার বিনিময়ে নুর আলম ও নুর মোহাম্মদকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে নূর মোহাম্মদ জানতে পারেন, তার ভাই মাহবুব আলমকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ এনেছিল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

অভিযোগ ২০: ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই বিকাল ৩টা/৪টার দিকে কদুর খালী গ্রাম থেকে এখলাস মিয়াকে আটক করে বোয়ালখালী রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে রাজাকাররা।

পরে তাকে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত্যু পর‌্যন্ত নির‌্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে আটক, নির‌্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ ২৩: ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জামাল খান এলাকা থেকে এম সলিমুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির এক হিন্দু কর্মচারীকে নির‌্যাতন করে সালাউদ্দিন কাদেরের সহযোগীরা। তাতে বাধা দিলে এম সলিমুল্লাহকে হুমকি দেয়া হয় এবং পরে আটক গুডস হিলে নিয়ে সারারাত নির‌্যাতন করা হয়।

এ ঘটনায় এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

 

মূল্যায়ন হয়নি ৬ অভিযোগের

প্রসিকিউশন ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগে দুটি গণহ্যতাসহ বেশ কিছু অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের জড়িত থাকার কথা বললেও কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। এ কারণে রায়ে এসব অভিযোগের মূল্যায়নও করা হয়নি।

অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি জিপগাড়িতে করে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী রাজাকার ক্যাম্পে যান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি ওই রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান করার সময় মুন্সীরহাট থেকে শান্তি দেবকে ধরে নিয়ে বণিকপাড়ায় নিয়ে হত্যা করা হয়। একই সময়ে সেনাবাহিনী কণিকপাড়ার রাম বাবুর বাড়ি ও কদুরখালির হিন্দু পাড়ার বাড়ি লুট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এসব এলাকার অনেক হিন্দু পরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

এসব ঘটনায় গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ১৩: ১৯৭১ সালের ১০ মে সন্ধ্যার দিকে সালাউদ্দিন কাদের, তার বাবা ও সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য অলি আহমেদের নির্দেশনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সমর্থক অধ্যুষিত ঘাসি মাঝিরপাড়া এলাকায় পৌঁছায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

সেখানে বিভিন্নজনের বাড়িতে লুটপাট চালায় তারা। এসময় অন্তত পাঁচজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও দুই জনকে গুরুতর আহত করা হয়। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- নুরুল আমীন, আবুল কালাম, জানে আলম, মিয়া খাঁ, আয়েশা খাতুন ও সালেহ জহুর। আহতরা হলেন মুন্সী মিয়া ও খায়রুল বাশার।

এ ঘটনায় আনা হয় গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ।

অভিযোগ ১৫: ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শেখ মায়মুন আলীকে চন্দনপুরে তার বন্ধু ক্যাপ্টেন বখতিয়ারের বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এসময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের। শেখ মায়মুন আলীকে গুডস হিলে নিয়ে নির‌্যাতন করা হয়। পরে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ছাড়িয়ে আনে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা।

সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় এ ঘটনায়।

অভিযোগ ১৬: ১৯৭১ সালের ৭ জুন চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গুডস হিলে নিয়ে আসা হয় ওমর ফারুককে। সেখানে তাকে নির‌্যাতনের পরে সালাউদ্দিন কাদেরের নির্দেশে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে ফজলুল কাদেরের ছেলের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ২১: মুক্তিযুদ্ধের সময় অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা আটক করে গুডস হিলে নিয়ে যায়। তাকে ৩/৪ দিন ধরে নির‌্যাতন করা হয় এবং পরে ছেড়ে দেয়া হয়। নির‌্যাতনের ফলে ফজলুল হক পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ২২: একাত্তরের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সালাউদ্দিন কাদের ও তার সহযোগী আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার আব্দুল হাকিম চৌধুরীর বাড়ি থেকে মো. নুরু চৌধুরীকে অপহরণ করে গুডস হিলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে আটকে রেখে নির‌্যাতনের পরে তার বাবার কাছ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় বিএনপির এই সাংসদের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির‌্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর গত বছরের ৪ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top