সকল মেনু

বারে গান গাওয়া আর পরপুরুষকে শরীর দেওয়া এক নয়

 

 1380300067.
‘বারে গান না গাইলে আমায় যৌনকর্মী হয়ে বেঁচে থাকতে হত। তার চেয়ে গান গাওয়া তো ঢের ভাল’। ডলি, প্রথম দিকের আলাপেই আমায় চমকে দিল। চাঁদনি চকের একটি নাম করা বার-এ আয়না দেখে ঠোঁটের রঙ ভরতে ভরতে ডলির সঙ্গে ওর বারে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম। সাংবাদিক শুনে ডলি নিজেকে প্রথম থেকেই একটা পেশাদারি মোড়কে গুটিয়ে রেখেছিল।

মানে বলতে চাইছি ও যেমন আর পাঁচটা বাইরের মানুষের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলে আমার সঙ্গেও সেভাবেই নিজেকে তুলে ধরতে চাইছিল। ভেবেছিল বুঝি কোনও গল্পের গন্ধ পেয়ে আমি ওর কাছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পৌঁছেছি। সেটাকে পূঁজি করেই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা চমৎকার গল্প তৈরী করব। কিন্তু যখন বললাম ‘আমিও তোমার মতো গান গাই’, দেখলাম ও অনেকখানিই সহজ হল।

আমার মুখ থেকে প্রায় কথা কেড়ে নিয়েই ডলি বলল ‘আপনিও তো গান করেন। সেরকমই আমি। বারে গান গাইলেই নষ্ট মেয়ে হয় না। এটা আমার চাকরি। সুরে গাই বলেই এত লোকে আমায় কদর করে। আর কত মানুষের মনকে শান্ত করে, ক্লান্তি দূর করে আমি তাদের আনন্দ দিয়ে থাকি। এটা কি কম কথা’? ডলিকে দেখছিলাম, ওর ভরাট ফর্সা গালে ঠোঁট ভর্তি কটকটে লাল লিপস্টিক। চোখে পুরুষ্টু আইলাইনার।

গোলাপি রঙের ব্লাশারের প্রলেপ লাগাতে লাগেতে ও বলল ‘বাইরে সবাই ভাবে আমরা দেহ নিয়ে ব্যবসা করি। এটা ভুল। কতগুলো খারাপ মেয়ের জন্যে আমাদের সকলের ওপর এই বদনাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে’  ডলির ট্রা তো সুরাপানের উচ্ছ্বাসে আপ্লুত অগুনতি পুরুষের মনোহরণ করে। সেটা যদি পেশা হয়, তবে যৌনকর্মীদের প্রতি সে এত নির্মম কেন? জানতে চাইলে ডলি বেশ ধমকের সুরেই বলে ‘পরপুরুষের গান গেয়ে মন ভোলান, আর পরপুরুষকে নিজের শরীর দিয়ে দেওয়া কি এক? ওটা খারাপ কাজ’  সমাজ থেকে বেরিয়ে এসেও ডলি সমাজের শেখানো বুলি আওড়ায়। খারাপ-ভালর দ্বিধা নিয়ে বাঁচে।

কিন্তু পরপুরুষ? ডলির নিজের পুরুষ কোথায়? ‘আমি বিবাহিত’ ডলির সাফ জবাব। ‘আমার  সংসার আছে। আমি প্রেম করে আমাদের পাড়ারই একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিলাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে দুই ভাই আর তিন বোনের মধ্যে বাবা অনেক কষ্টে আমায় উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াতে পেরেছিলেন। গানের গলা খুব ভাল ছিল বলে ক্যাসেট থেকে গান তুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মফঃস্বলে গান গাইতে, আরম্ভ করি আমি। ভালই রোজগার ছিল আমার। উনিশ, কুড়ি বছরের একা গাইয়ে মেয়েকে অনেকবারই কোনও পুজো উদ্যোক্তা, জলসার দালাল, তবলা বাদকের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছিল। আর এই হেনস্থার বেশিরভাগটাই ছিল শরীরী। আমার পাড়ার সেই বন্ধুই আমায় বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছিল। অবশেষে সেই সুনীলকেই বিয়ে করি আমি। ও আমার সব অনুষ্ঠানের খবরাখবর থেকে শুরু করে টাকার হিসেব সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছিল।

সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু দালাল পেরিয়ে, না শুয়ে, সঙ্গে বর নিয়ে, অনুষ্ঠান করায় অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমতে শুরু করল। পাড়াতে, এমনকি বাড়িতেও গান গাইতে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে, লোক এসে শোওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসত আমায়। ভয় দেখাত সুনীলকে খুন করে আমায় তুলে নিয়ে যাবে। আমার চেহারা বরাবরই খুব সুন্দর ছিল, সেই কারণে পাড়ার লোকেও বলতে শুরু করল আসলে গান নয়, আমি বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে শুয়েই মাঝরাতে বাড়ি ফিরি। আর বরকে সঙ্গে রাখি ‘পাপ’ কাজ ঢাকার জন্যে। পরিস্থিতি খারাপ হতে আরম্ভ করল।

আমার বাড়ির লোকও আমার পাশে ছিল না। ভাবত মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সুনীল রাস্তায় একবার পার্টির লোকাল ছেলের হাতে বেধড়ক মার খেল। কোন পার্টি বলব না আমি। তবে সেদিন রাতেই আমরা যদি মফঃস্বলে পালিয়ে না যেতাম শুনেছিলাম ওরা আমায় তুলে নিয়ে কোথাও পাচার করে দেবে। পুলিশকে বলেও কিছু হত না। আমরা পালিয়ে বাঁচলাম। কিন্তু প্রকাশ্যে গান গাওয়ার কথা আর ভাবতে পারিনি। একদিন সুনীল আমায় এই বারের মালিকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই অবধি এখানেই আছি’।

আদা দিয়ে তৈরি স্পেশ্যাল চায়ে চুমুক দিতে দিতে ডলি বলল ‘আমার প্রচুর ক্লায়েন্ট। বিবাহিত, অবিবাহিত, বয়স্ক, অল্প বয়সের ছেলে। সবাই যে যার মতো এই বারে আসে। সবাই খুব সম্মান করে আমায়। আমি জানি কোন ক্লায়েন্ট কী গান পছন্দ করেন। আমি সেইমতো গাই। যেমন চ্যাটার্জিদা। উনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কিছুই শুনতে চান না’। ‘বারে রবীন্দ্রসঙ্গীত?’ আমি চমকে উঠি। ডলি আবার ধমকায় আমায়, ‘আপনিও বড় সেকেলে তো! সেই ভাবছেন বার মানেই খারাপ সবকিছু নাহ্?’ ডলিকে শান্ত করি, লক্ষ্য করি চ্যাটার্জিদার কথা বলাতেই ওর চোখটা চকচক করে ওঠে, পথ হারানো বিষণœ নদী যেমন ঝর্ণার দেখা পেয়ে খুশিতে ভরে ওঠে, ঠিক তেমন। ডলি নিজেই বলতে শুরু করে ‘চ্যাটার্জিদা খুব ভাল মানুষ। গান পাগল, নেশায় চঞ্চল। ওর সঙ্গেই কেবল আমি বাইরে যাই। ঘুরি, খাই, উনি আমায় কত কী কিনেও দেন। সম্মান করেন বলেই একমাত্র ওঁর সঙ্গে বাইরে যাই। উনি তার জন্যে আলাদা টাকাও দেন। ব্যস ওইটুকুই। নয়তো বেড়াতে যাওয়া তো দূর আমার সঙ্গে সামনে এসেও আমার গান শুনে কেউ টাকা ছুঁড়ে দিতে পারে না। বেয়ারাদের হাতে টাকা দিয়ে দেয় সবাই। তারপর সেটা আমরা নিয়ে নিই’। ‘আর প্রেম?’ ‘ও সব আর হয় না। আপনি আবার লিখবেন না যেন চ্যাটার্জিদার সঙ্গে আমার প্রেম। নাহ্, ওই সময়টা আমি খুব এনজয় করি এই পর্যন্তই। ভাল লাগবে নাই বা কেন? তাই না?’

দিব্যি শব্দ ছড়িয়ে, ছন্দের আনন্দে, আমোদে ডলি সুরের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে খুঁজে নিয়েছে। ওর মেক আপ শেষ, ফ্লোর থেকে ডাক এসে গেছে ওর। বেজে উঠল ওর মোবাইলের রিং টোন ‘তুমি রবে নীরবে’ডলি একগাল হেসে বলল ‘চ্যাটার্জিদা এসে গেছেন। আসছি আমি  ডলি রাত মজলিশের মৌতাতে সুর ভরতে ফ্লোরের দিকে এগোল। আর আমি কলকাতার রাতঘুম জড়ানো ক্লান্ত রাস্তায় নামলাম, স্ট্রিট লাইটের ঝকঝকে আলো কেবলই আমায় ডলির জৌলুসকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল….. সুর ভেসে আসছিল ‘তুমি রবে নীরবে/ হৃদয়ে মম’।

লেখক: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
সাংবাদিক, আনন্দবাজার

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top