সকল মেনু

শশীকান্তের রাজবাড়ি মুক্তাগাছায়

সানজিদা আক্তার হীরা:হটনিউজ২৪বিডি.কম,মুক্তাগাছা থেকে ফিরে:   image_9747_0ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় রাজা শশীকান্তের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ছাতা মাথায় কিংবা জুতা পায়ে কারও হেঁটে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। আর নিয়মভঙ্গকারীর জন্য বরাদ্দ ছিল কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। সেদিন ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি ঘুরে দেখছি যখন, কেয়ারটেকার গোছের একজন বলছিলেন এসব গল্প।

বললাম শশীজ্বি তো বেশ অত্যাচারী টাইপের ছিলেন, তাহলে! বললেন, তিনি এক রাজার মতন রাজা ছিলেন। ময়মনসিংহের অন্য রাজারাও তাকে ট্যাক্স দিতেন। সামান্য অত্যাচার ছাড়া প্রজারা কি আর বাধ্য থাকে?

রাজবাড়ির রঙমহলে গেলাম। মঞ্চ নেই। জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর ১৯৪৭ সালে বিক্ষুব্ধ প্রজাদের আক্রমণেই ধ্বংস হয়েছে সেসব। ছিল এক ঘূর্ণায়মান মঞ্চ, এশিয়া উপমহাদেশেই একমাত্র ছিল সেটা। ফ্রান্স থেকে আনানো হয়েছিল। কলকাতার নর্তকীরা এখানে এসে নাচতেন। বললাম, রাজা তো তাহলে বিশেষ সুবিধার ছিলেন না?
প্রতিবাদ করে কেয়ারটেকার বলেন, রাজার মনটা ছিল বড়, প্রচুর বখশিস দিতেন। শশীকান্ত রাজার রঙমহলে আসতে পারা যেকোনো নর্তকীর জন্যই ছিল গৌরবের।

রাজবাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, রাজা নেই তাতে কি? রাজবাড়িতে এসে রাজার এমন অনুগত কর্মচারীর সাক্ষাৎ পাওয়াও তো কম কথা না!

মোগল আমলে খাজনার দায়ে নিলামে ওঠা আলাপসিং পরগনা নামের এ রাজবাড়ি ও এখানকার রাজত্ব কিনে নিয়েছিলেন ঝাকড়ের মহারাজ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য। তদবংশীয় সূর্যকান্ত বা শশীকান্তের রাজ্যআমল হয়ে সবশেষ রাজা জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত এখানে তাদের রাজত্ব বহাল রাখেন। তবে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বে রাজা শশীকান্তই অধিক আলোচিত ও মনোযোগের দাবিদার।

রাজবাড়ির শুরুতেই দেখা গেল বিচার সিংহাসন কক্ষ। রাজার আদেশে সামান্য ভুল-ক্রটির কারণে এখানেই বহু প্রজার মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রণীত হতো। সেখান থেকে আমরা যাই ফাঁসির ঘরে। এ ঘরের সামনেই ছিল সেই গর্ত, যে গর্তের সঙ্গে দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথে যোগসূত্র ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের। ফাঁসির পর এই গর্তেই ফেলে দেওয়া হতো দুর্ভাগার লাশ। আর অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে যা গিয়ে ভেসে উঠতো ব্রহ্মপুত্রে।

হাতের ডানেই লাইব্রেরি কক্ষ। বহু মূল্যবান বইয়ের বিরল এক সংগ্রহ ছিল এখানে। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় জমিদারদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রজারা হামলা চালিয়ে এসব বইপত্র পুড়িয়ে ফেলেন।

একটু এগিয়ে গেলেই ফাঁকা মাঠের মতো খানিকটা জায়গা। সে জায়গা পেরিয়ে গিয়ে সোজা ভগ্নপ্রায় আরেক ভবনে ঢুকলে হাতের ডানে লক্ষ্মীপূজার ঘর। এখানে কষ্টিপাথরের আনুমানিক বিশ কেজি ওজনের একটি মূর্তি ছিল- বললেন কেয়ারটেকার।

এ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে গেলেই বাম পাশে দেখা মেলে রাজবাড়ির দুর্গাপূজা মণ্ডপ। খানিক এগিয়ে গেলে নানা রকম নকশাখোচিত বিলাসবহুল আরেকটি মন্দির। এর নাম রাজেশ্বরী মন্দির। শুধু রাজা আর রানীর ব্যক্তিগত এ প্রার্থনালয়ের মেঝেটি ছিল সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরের তৈরি। রাজা, রানী ও পুরোহিত ছাড়া এ মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না আর কারোই।

আমি প্রশ্ন করলাম, আর কেউ ঢুকলে তাকে কি করা হতো? কেয়ারটেকার বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি আর করা হতো? মেরে গাঙে ভাসানো হতো! (যেন খুবই স্বাভাবিক, আর এমনই হওয়া উচিত!)

চলে যাই তৎসময়কার সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত রাজা রানীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামালয়ে। ইংল্যান্ডের একটি বিশেষ স্থাপত্যকৌশল প্রয়োগে এ ঘরের ভেতরকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। বর্তমানে ভগ্নদশার এ ঘরটিতে এখনো সার্বক্ষণিক বাতাস বইতে থাকে বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন।

আমাকে ওই ঘরের ভেতর দাঁড় করিয়ে কেয়ারটেকার জিজ্ঞেস করলেন পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছি কিনা? বেচারা এতো আগ্রহ নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন যে, তাকে খুশি করার জন্য বলেছিলাম, আরে তাই তো! এখানে তো সত্যিই অনেক বাতাস! বস্তুত আলাদা করে বাড়তি কোনো বাতাস আমি মোটেই টের পাইনি ওই ঘরে।

এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজ কারাগারে! একটাই অপরাধ ছিল আমার, রাজবাড়ি দেখতে আসা! ভাবি এমন সত্যিই হয়তো হতে পারতো! কিন্তু তা তো আর না। তৎসময়ে খাজনা দেওয়াসহ অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে রাজ্যাদেশে অবাধ্যদের এনে আটকে রাখা হতো এখানে। রাজ্যাদেশ অবাধ্যের ঔদ্ধত্যময় পায়ে আমি ওই কারাগারের ভেতর ঢুকলাম। শ্যাওলা আর কংক্রিটের এক অন্ধকার বন্দীশালা সেটা। কেয়ারটেকারের তাগাদায় দ্রুত বেরিয়েও আসি আবার।

সবশেষে দেয়াল টপকে মূল ফটকের বাইরে মাঠের মতো একটা জায়গায় যাই আমরা। এ মাঠই ছিল রাজা শশীকান্তের নিরানব্বই হাতির পিলখানা। আমৃত্যু রাজা শশীকান্তের একটাই আফসোস ও অপূর্ণতা ছিল, তিনি কখনোই তার হাতির সংখ্যা একশো করতে পারেননি। যতবারই একশতম হাতি নিয়ে আনা হয়েছে, নতুন হাতি পথিমধ্যে থাকাকালীনই পিলখানার অন্য যেকোনো একটি হাতি নিয়ম করে মরে গেছে।

কোনো হাতি গর্ভবতী হলে, সে হাতির প্রসব যন্ত্রণায় মৃত্যু হয়েছে অন্য হাতির। এরকম নানা ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকতো রাজার হাতিশালায়। শেষ পর্যন্ত একশো হাতির স্বপ্ন কখনোই পূর্ণ হয়নি রাজা শশীকান্তের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়ারটেকার বললেন, প্রভু তাকে সব দিয়েছেন, একশতম হাতি দেননি। এখানেই প্রভুর খেলা!!

যদি যেতে চান
ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে এনা, সৌখিন ও নিরাপদসহ ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসে উঠে পড়ুন। ভাড়া ১৪০ টাকা থেকে শুরু। থাকার জন্য ময়মনসিংহ শহরের স্টেশন রোড ও গাঙ্গিনার পাড়ে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে। ভাড়াও খুব বেশি না, ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যেই। এছাড়া ইসলাম পরিবহনের বাসে সরাসরি চলে যেতে পারেন মুক্তাগাছায়। ভাড়া ১৭০ টাকা। মুক্তাগাছায় থাকতে চাইলে জনতা গেস্ট হাউজ হতে পারে আপনার মন্দের ভালো থাকবার ঠিকানা।

আর ময়মনসিংহ শহর এলাকায় অবস্থান করে মুক্তাগাছায় পৌঁছানোর জন্য আপনাকে যেতে হবে শহরের টাউন হল চত্বরের সিএনজি অটো রিকশা স্ট্যান্ডে। কমন ট্রিপে জনপ্রতি ২০ টাকা, আর প্রাইভেট ট্রিপে ১০০ টাকায় আপনি রাজবাড়ির প্রধান ফটকের একেবারে সামনে গিয়েই নামতে পারেন। পায়ে জুতা কিংবা হাতে ছাতা যা-ই থাকুক, নির্ভয়ে ঢুকে পড়ুন রাজবাড়িতে। কেননা, ভয়ের কিছু নেই, রাজা শশীকান্ত এখন আর থাকেন না

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top