সকল মেনু

আনন্দ স্কুলের নামে লাখ লাখ টাকা লুটপাট

images (2)শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর:  চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলায় রঙ্গ-২-এর অধীনে অস্তিত্বহীন আনন্দ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী দেখিয়ে শিক্ষক বেতন, উপকরণ, পোশাক, ঘরভাড়া ও ঘর মেরামতের নামে ১৭ লাখ টাকা লুটপাটের সংবাদ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকায় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

জানা যায়, হাইমচর উপজেলায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি হতে রঙ্গ-২-এর কার্যক্রম শুরু হয়। রঙ্গ-২- এর অধীনে হাইমচরে ৬২টি আনন্দ স্কুলের কার্যক্রম কাগজে-কলমে থাকলেও অনুসন্ধানে বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকরা উপজেলার ভিঙ্গুলিয়া গ্রামের নূরু মিয়া কবিরাজ বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে জানতে পারেন, শিক্ষিকা রুমা আক্তার বিবাহ সূত্রে মতলব উত্তরে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছেন। মতি ভূঁইয়া আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষিকা পারুল বেগম বাড়িতে অবস্থান করছেন কিন্তু ১০০ গজের মধ্যেই ৮নং দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হওয়ায় কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই এমনকি আনন্দ স্কুলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ বলতে পারেনি এখানে আনন্দ স্কুল নামে কোনো স্কুল আছে কিনা। খলিল পাটওয়ারী বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষিকা স্বপ্না রাণী নেই। স্থানীয়রা জানান, তিনি এনজিও ইউএসটির অধীনে নদীর পশ্চিম পাড় ১নং গাজীপুর ইউনিয়নে কর্মরত। নাজিম মাস্টার বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আনন্দ স্কুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমিন মিজি বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল নামে কোনো ঘর নেই এবং শিক্ষিকা ফাতেমা বেগমকেও কেউ চিনে না। এলাকা সূত্রে জানা যায়, শিক্ষিকার বাড়ি দূরে হওয়ায় তিনি কখনও এখানে আসেননি এবং এ স্কুলের আশপাশে কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই। কাদির পাটওয়ারী বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষিকা মুক্তা রাণী কোনো দিন ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাস নেননি। স্কুলের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ বলতে পারেনি। এলাকা সূত্রে জানা যায়, বিগত দিনে কেউ এ স্কুলের কোনো খোঁজ নিতেও আসেনি। মাস্টার বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ইতি রাণী এ স্কুলের শিক্ষিকা। তার ঘরটি তালাবদ্ধ। এখানে তার বসতঘরটিতে তার পরিবার এবং তার ভগ্নিপতি বসবাস করেন। স্কুল কোথায় স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, এখানে স্কুল আছে বলে আমাদের জানা নেই। শিক্ষিকা ইতি রাণী সাংবাদিক আসার সংবাদ পেয়ে সাংবাদিকদের মোবাইলে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। পার্শ্ববর্তী মুদি ব্যবসায়ী ছফিউল্যাহ জানান, মাস্টার বাড়িটি আমার দোকানের পেছনে, এখানে কোনো স্কুল থাকলে আমিতো ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার আওয়াজ পেতাম। বিউটি রাণী বিশ্বাস বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, বিউটি রাণী বিশ্বাসের দোচালা টিনের ঘরটি তালাবদ্ধ। জানা যায়, শিক্ষক চাঁদপুরে একটি মাল্টিপারপাসে চাকুরি করেন ও ডিগ্রিতে পড়াশোনা করেন চাঁদপুরে অবস্থান করে। স্থানীয় আমান উল্যাহ দেওয়ান বিস্ময়ের সাথে জানান, এখানে আনন্দ স্কুলের লেখাপড়ার আওয়াজতো কোনোদিন শুনিনি। ছাত্র-ছাত্রীতো আসতে দেখিনি। এ সম্পর্কে স্থানীয় ২৫নং মধ্যচর কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আঃ রশিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি গত বছর এ এলাকার ৩টি স্কুল সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়েছি যে, স্কুলগুলো ভুয়া। ওই স্কুলগুলো এখনো চলে কিনা আমার জানা নেই। পার্শ্ববর্তী মফিজ তফাদার বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়েও স্কুলের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। জানা যায়, শিক্ষিকা তারা রাণী বিবাহ সূত্রে মতলব (দঃ) উপজেলায় স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করছেন। কেউ খোঁজ নিতে গেলে তার বোন নিজকে তারা রাণী বলে পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। গাজী বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ঘর ভাড়া ও ঘর মেরামতসহ সকল টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু সভাপতি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জানান, এখানে কখনও স্কুল চলে না। আমাদের ছেলে-মেয়ে আমরা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই। চরভাঙ্গা গাজী বাড়ি আনন্দ স্কুৃলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। জানা যায়, শিক্ষক মোঃ ফারুকুল ইসলাম চরভৈরবী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এখানে স্কুল কোনো দিন চলে না। কাশিম পাটওয়ারী বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে জানা যায়, ওই স্থানে আনন্দ স্কুল নামে কোনো কিছুই নেই। এলাকাবাসী জানায়, গত ১ বছর আগে মাঝে মাঝে দেখতাম রফিক মিয়া নামে একজন এ বাড়িতে এসে বসত। কিন্তু এখন আর দেখি না। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরাতো প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। নুরুল ইসলাম গোলদার বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, এ চরাঞ্চলে আনন্দ স্কুল নামে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব নেই। এলাকাবাসী জানায়, সোহেল নামে ছেলেটিতো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে সকালে ছোট ছোট বাচ্চা পড়ায়। সে তো কখনও আনন্দ স্কুল নামে কিছুই চালায়নি। পার্শ্ববর্তী মাল বাড়ি আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের কোনো অস্তিত্বই নেই। স্কুল ঠিকানা থেকে কিছু দূর গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক মুকবুল হোসেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রমের ৪-৫জন ছোট ছোট শিক্ষার্থী নিয়ে বসে গল্প করছে।

শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ৬২টি আনন্দ স্কুলে ৯৯৭জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক বেতন প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা, পোশাক প্রতি শিক্ষার্থী ৪শ’ টাকা, প্রতি স্কুলের উপকরণ ২ হাজার টাকা, স্কুল ঘর ভাড়া প্রতি মাসে ৪শ’ টাকা, ঘর মেরামত ৪ মাসে ১ হাজার টাকা ব্যয় হয়। ৬২টি স্কুলের নামে গত মে মাসে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। সোনালী ব্যাংক হাইমচর বাজার শাখা প্রতি স্কুলের হিসেবে এ টাকা জমা করে। গত জুলাই মাসে শিক্ষকদের বেতন, ঘর ভাড়া ও মেরামতের টাকা শিক্ষকরা উত্তোলন করেন। গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতি স্কুলের উপকরণ ও পোশাক বিতরণ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে উপজেলা ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর মোঃ রাশেদ ফরিদগঞ্জ হতে হাইমচরে এসে শিক্ষকদের সাথে যোগসাজশে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের বেতন, ঘর ভাড়া ও মেরামতের টাকা ছাড় করেছেন এবং একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করে নিচু মানের পোশাক ও উপকরণ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটপাট হলেও দেখার যেনো কেউ নেই।

এসব সম্পর্কে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ হারুন-অর-রশিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার অফিসে জনবল সঙ্কট রয়েছে। আমার পক্ষে টাকা দেয়ার আগে স্কুলের অস্তিত্ব আছে কিনা, ছাত্র-ছাত্রী আছে কিনা দেখা সম্ভাব হয়নি। ৪ মাসের টাকা দিয়েছি। আগামীতে উপবৃত্তি ও টাকা দেয়ার আগে আমি যাচাই-বাছাই করে টাকা দেবো।

ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর মোঃ রাশেদ জানান, আমি ফরিদগঞ্জ ও হাইমচর ২ উপজেলার দায়িত্বে রয়েছি। সবগুলো স্কুল দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এবার দিয়েছি, আগামীতে উপবৃত্তি ও টাকা দেয়ার আগে যাচাই করে নেবো। বিধি বহির্ভূতভাবে নিন্মমানের উপকরণ ও পোশাক সরবরাহ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top