সকল মেনু

ন্যাশন্যাল হার্ট ফাউন্ডেশনে বকশিস বাণিজ্য চরমে ,রিং নিয়ে রমরমা ব্যবসা

crime-80x80শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম:  ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত ন্যাশন্যাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং রিসার্স সেন্টারে কর্মচারীদের বকশিস বাণিজ্য চরমে উঠেছে। কথায় কথায় কর্মচারীদের বকশিস দিতে হয়। বকশিস না দিলে কোন কাজ সহজভাবে আদায় করা যায় না। উপরন্তু রোগীদের জন্য যে খাবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে তা একদিকে যেমন অপর্যাপ্ত তেমনি অন্যদিকে নিচু মানের। কেবিন প্রতি রোগীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ভাড়া আদায় করা হলেও কেবিনের শয্যা ব্যবস্থাও ভাল নয়। রোগীদের দেয়া হয় না পত্র-পত্রিকা। কেবিনে নেই টেলিভিশনও। কোন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় রোগীরা চরম একাকিত্ব বোধ করে এবং অনেক সময় বাধ্য হয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে ঘটে নানা দুর্ঘটনা। তাছাড়া সেবার চাইতে দাম নেয়া হয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। খরচের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে অনেককেই চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে আসতে হয়।

২০০০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মীরপুর ২ নম্বরে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। শুরু থেকেই এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেশি। এর কারণ হাসপাতালের চিকিৎসকদের আন্তরিকতা। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন শত শত রোগী এখানে ছুটে আসে। এখানে বর্হিবিভাগে রোগী দেখার ব্যবস্থা থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হলে আগে থেকেই অ্যাপয়নম্যান্ট নিয়ে রাখতে হয়। সে জন্য ৪০০ টাকা করে ফি জমা দিতে হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানোর পর তার পরামর্শ মোতাবেক ভর্তি বা অন্য কোন ব্যবস্থা নিতে হয়। ভর্তি করানো রোগীদের অধিকাংশেরই এক্সরে, ইকো, রক্ত ও প্র¯্রাব পরীক্ষা, এনজিওগ্রাম করতে হয়। হাসপাতালে কেবিন পাওয়া ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেবিনের জন্য আবেদন করতে অলিখিতভাবে দিতে হয় ১০০ টাকা। তারপর এসিযুক্ত কেবিনের ভাড়া ২ হাজার ৫শ’টাকা, নন এসিযুক্ত কেবিনের ভাড়া ২ হাজার টাকা প্রতি রাতের জন্য প্রদান করতে হয়। আর ওয়ার্ডের জন্য ৫০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন ধরনের ভাড়ার তালিকা রয়েছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, হাসপাতালের স্টাফদের সব ধরনের সেবার জন্যই টাকা দিতে হয়। কক্ষ ঝাড়– দেয়া, রোগীকে বাথরুমে বা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন কক্ষে আনা নেয়া, এটেনডেন্ট ও ভিজিটর দেখা করাসহ এ ধরনের প্রত্যেকটি কাজের জন্য স্টাফরা সদাসর্বদা রোগীদের সামনে টাকার জন্য হাত পেতে থাকে। ৫০ বা ১০০ টাকার নিচে বকশিস দিলে আবার নিতে চায় না, কানাঘুষা করে। তারপর হাসপাতালে রোগীদের যে খাবার সরবরাহ করা হয় তা যেমন অপর্যাপ্ত তেমনি নিন্ম মানেরও। সকালে দেয়া হয় ২ পিচ পাউরুটি এবং ১ টি কলা ও সামান্য একটু জেলি। দুপুরে দেয়া হয় এক থেকে দেড়শ’ গ্রাম চালের ভাত বা জাউ। সাথে খুবই ছোট আকৃতির এক পিস ফার্মের মুরগির মাংস ও টেবিল চামচে দুই চামুচ পরিমাণ শাক। আর যারা ভাত বা জাউ খেতে পারে না তাদের দেয়া হয় ওয়ানটাইম ছোট গ্লাসে এক গ্লাস সাদা সুপ। বিকেলে কিছুই দেয়া হয় না। সন্ধ্যায় রাতের খাবার হিসেবে হয় ৩ টি ময়দার পাতলা রুটি, না হয় সামান্য জাউ বা সামান্য ভাত। সাথে পাতলা ডাল ও সামান্য একটু চালকুমড়ো ভাজি এবং ছোট এক পিস ফার্মের মুরগির মাংস। অধিকাংশ রোগীরই এই খাবারে পেট ভরে না। ফলে বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হয়। তার জন্যও দাড়োয়ানদের আবার বকশিস দিতে হয়। নইলে তারা ভেতরে খাবার নিতে দিতে চায় না।

রোগীদের বিভিন্ন কক্ষে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নিয়ে মিনিটের পর মিনিট বসিয়ে রাখা হয়। কর্মচারীরা মনে করে যেন, রোগীরা সব মক্কেল আর তারা প্রভূ। ইকো করা হয় এমন ছোট একটি কক্ষে যে সেখানে রোগীর পক্ষেই একা অবস্থান কষ্টকর। একটি সরু বেডের উপর রোগীদের কাত করে শুইয়ে তার একপাশে টেকনিশিয়ান বসে ইকোর কাজ সারেন। সেই কক্ষেই বেডের পাশে কম্পিউটার নিয়ে বসে এক মহিলা স্টাফ রোগীদের লক্ষ্য করে নাক সিটকাতে থাকেন। এনজিওগ্রামের আগে রোগীদের কিছু স্পর্ষকাতর স্থানের পশম কাটা হয়। একজন সুইপার এই কাজটি করে। এর জন্যও তাকে বকশিস দিতে হয়। এনজিওগ্রামের আগে রোগীদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এক ধরনের সার্ট পড়তে দেয়া হয়। এই সার্টগুলোর অবস্থা এতটাই নাজুক যে এগুলো দেখলেই বমি আসার উপক্রম হয়। অথচ তারপরও এগুলোই রোগীদের গায়ে দিতে হয়।

সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যাদের বুকে রিং বসানো হয় তারা বা তাদের আতœীয়-স্বজনরা জানেও না, কী মানের রিং বসানো হচ্ছে। অথচ রিং এর প্রকার ভেদের কথা বলে ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির কথা বলে সিংগাপুরের রিং বসিয়ে দেয়া হলেও কারো কিছু করার বা বলার থাকে না। এই রিং নিয়ে একটি দালাল চক্র সবসময় ডাক্তারদের আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। কথিত রয়েছে মালয়েশিয়া, সিংগাপুরের রিং এর দাম ৫০ হাজার টাকার ভেতর হলেও সেগুলোই জার্মানী, যুক্তরাষ্ট্রের বলে দেড় থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত টাকা আদায় করে নেয়া হয় রোগীদের কাছ থেকে।

সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা হাসপাতালে আসেন না। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে পুরো হাসপাতালের রোগীদের দেখার দায়িত্ব দেয়া হলেও তার পক্ষে দিনমান কাজ করেও সব রোগী দেখা সম্ভব হয় না। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ নেবার ক্ষেত্রেও রোগীদের সমস্যায় পড়তে হয়। কাগজ-পত্র তৈরি করতেই ৩/৪ ঘন্টা সময় লেগে যায়। তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি টাকা না নেয়ায় হাসপাতালের টাকা জমা দিতে যেয়ে রোগী বা তাদের সাথে যাওয়া লোকজনদের ব্যাংকে যেয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। হাসাপাতালে তিনটি লিফটের ব্যবস্থা থাকলেও ১ টি ডাক্তার এবং ভর্তি করা রোগীদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি দু’টি লিফট দিয়ে অভ্যাগতদের ভিড় সামলানো যায় না। তাছাড়া লিফটগুলো প্রতিটি ফ্লোরে থামে বলে অনেক সময় এগুলোতে করে যেয়ে জরুরি কাজও সারা যায় না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top