সকল মেনু

সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির দেওয়া পূর্ণাঙ্গ ভাষণ

অনলাইন ডেস্ক

জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি বক্তব্য রাখেন। কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য তার পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য তুলে ধরা হলো :

নমস্কার!
মহামান্যগণ,

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদজী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হকজী, কৃষিমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাকজী, ম্যাডাম শেখ রেহানাজীসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং সোনার বাংলার প্রিয় বন্ধুরা,

আপনাদের সবার এই স্নেহ আমার জীবনের অন্যতম মূল্যবান মুহূর্ত। আমি আনন্দিত যে, আপনারা আমাকেও বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আজ বাংলাদেশের জাতীয় দিবস, এবং স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীও। আজ ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করছে। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদজী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজী এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের এই গৌরবময় মুহুর্তগুলিতে এবং এই উত্সবে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এই উপলক্ষে, আপনাদের ১৩০ কোটিরও বেশি ভারতীয় ভাই-বোন তাদের ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাংলাদেশের জন্য।
সকল ভারতীয়ের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সকলকে এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিককে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানজীকে শ্রদ্ধা জানাই যিনি সোনার বাংলার স্বপ্নের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আমাদের ভারতীয়দের জন্য এটি গর্বের বিষয় যে, আমরা শেখ মুজিবুরজীকে গান্ধী শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করার সুযোগ পেয়েছি।

বন্ধুগণ,
আমার আজ বাংলাদেশের সেইসব সন্তানদের স্মরণ করছি যাঁরা সোনার বাংলার জন্য অগণিত অত্যাচার সহ্য করেছেন, রক্ত দিয়েছেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। আজ আমি স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের।

আজ আমি স্মরণ করছি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শিক্ষাবিদ রফিকউদ্দিন আহমেদ, ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এবং শফিউরজীকে! আজ আমি মুক্তিদ্ধের সময় বাংলাদেশের ভাই-বোনদের পাশে থাকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই সাহসী সৈন্যদেরও প্রণাম জানাই। যারা মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়েছিলেন, আত্মত্যাগ করেছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে খুব বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।

ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’, জেনারেল অরোরা, জেনারেল জ্যাকব, ল্যান্স নায়ক অ্যালবার্ট এক্কা, গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং, ক্যাপ্টেন মোহন নারায়ণ রাও সামন্ত সহ এমন অনেক বীর রয়েছেন যাঁদের নেতৃত্ব ও সাহসের কাহিনী আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

বাংলাদেশ সরকার এই বীরদের স্মরণে আশুগঞ্জে একটি স্মৃতিসৌধ উত্সর্গ করেছে। আমি এই জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমি আনন্দিত যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া অনেক ভারতীয় সেনাও এখানে এই বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন।
আমি এখানকার তরুণ প্রজন্মের আমার ভাই ও বোনদের খুব গর্বের সাথে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া আমার জীবনের প্রথম আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি ছিল। আমার বয়স তখন ২০-২২ বছর ছিল, যখন আমি ও আমার অনেক সহকর্মী বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সত্যাগ্রহ করেছিলাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন করায় আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম এবং কারাগারেও গিয়েছিলাম। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যতটা আকুলতা এখানে ছিল ততটা আকুলতা সেখানেও ছিল। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত জঘন্য অপরাধ ও নৃশংসতার চিত্রগুলি আমাদের বিচলিত করত এবং রাতের পর রাত বিনিদ্র করে রাখত।

গোবিন্দ হালদারজি বলেছেন-
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা,
আমরা তোমাদের ভুলব না,
আমরা তোমাদের ভুলব না।”
অর্থাৎ,
যারা তাঁদের রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিলেন, আমরা তাঁদের ভুলব না।
বন্ধুগণ,

একটি স্বৈরাচারী সরকার তার নিজস্ব নাগরিকদের গণহত্যা করছিল। তাদের ভাষা, তাঁদের কণ্ঠস্বর ও পরিচয়কে চূর্ণ করছিল।
অপারেশন সার্চলাইটের নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের যতটা সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি।

বন্ধুগণ,
এত কিছুর মাঝেও এখানে এবং আমাদের ভারতীয়দের জন্য আশার এক কিরণ দেখা গেল- তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর সাহস ও তাঁর নেতৃত্ব এটা নিশ্চিত করেছিল যে, কোনও শক্তিই বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
এবারের সংগ্রাম মুক্তির জন্য, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার জন্য।

তাঁর নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ, কৃষক, যুবক, শিক্ষক ও শ্রমিক সকলেই এক হয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে। তাই আজকের এই দিনটি মুজিববর্ষ , বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, তাঁর আদর্শ ও সাহসকে স্মরণ করার জন্যও আদর্শ একটি দিন। আজকের এই সময় “চির বিদ্রোহী” ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার স্মরণ করার সময়।

বন্ধুগণ,

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতের প্রতিটি কোণা থেকে, প্রতিটি দল থেকে সমর্থন মিলেছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীজীর প্রয়াস ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ওই সময়েই ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অটল বিহারী বাজপেয়ীজী বলেছিলেন, “আমরা কেবল মুক্তি সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারীদের সাথে লড়াই করছি, সেই সাথে আমরা ইতিহাসকে একটি নতুন দিশা দেয়ার প্রচেষ্টাও করছি। আজ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাথে ভারতীয় সেনারাও নিজেদের রক্ত বিসর্জন দিচ্ছে। এই রক্ত একটি নতুন বন্ধন সৃষ্টি করবে যা কোন অবস্থাতেই ভাঙবে না, কোনো কূটনীতিরও শিকার হবে না। আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী জী বঙ্গবন্ধুকে একজন অক্লান্ত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ধৈর্য, প্রতিশ্রুতি ও আত্মসংযমের প্রতীক।

বন্ধুগণ,

এটি একটি আনন্দময় কাকতালীয় ঘটনা যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর আর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর একসাথে পড়েছে। আমাদের উভয় দেশেরই জন্য একবিংশ শতাব্দীর আগামী ২৫ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ঐতিহ্যের অংশীদার, আমরা উন্নয়নেরও অংশীদার। আমরা লক্ষ্যও ভাগাভাগি করি, চ্যালেঞ্জগুলোও ভাগাভাগি করি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাণিজ্য ও শিল্পে যেখানে আমাদের জন্য একই ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি সন্ত্রাসবাদের মতো সমান বিপদও রয়েছে। এই জাতীয় অমানবিক ঘটনাবলীর পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবে রূপদানকারী শক্তিগুলো এখনও সক্রিয় রয়েছে। আমাদের অবশ্যই তাদের থেকে সাবধানে থাকতে হবে এবং ওদের মোকাবিলা করার জন্য সংগঠিতও হতে হবে। আমাদের উভয় দেশেই গণতন্ত্রের শক্তি রয়েছে, এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট দূরদর্শিতা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অগ্রযাত্রা এই পুরো অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সমান জরুরি।

আর এজন্যে, আজ ভারত আর বাংলাদেশ দু’টি দেশের সরকারই এই সংবেদনশীলতা উপলব্ধি করছে আর সেদিকেই অর্থবহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রমাণ করেছি যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা থাকলে সকল সমস্যারই সমাধান করা যায়। আমাদের স্থল সীমান্ত চুক্তি এর সাক্ষী। করোনার এই দুঃসময়েও দু’টি দেশের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রয়েছে। আমরা সার্ক কোভিড তহবিল গঠনে সহযোগিতা করেছি, নিজেদের মানব সম্পদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছি। ভারত খুবই আনন্দিত যে ভারতের তৈরির টিকাগুলো বাংলাদেশের ভাইবোনদের কাজে লাগছে।

সাথীগণ,

ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার জন্য দু’টি দেশেরই তরুণদের মধ্যে আরও উন্নত যোগাযোগ সমান প্রয়োজনীয়। ভারত-বাংলাদেশ সর্ম্পকের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশের ৫০ তরুণ উদ্যোক্তাকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানাতে চাই। তাঁরা ভারতে আসুন, আমাদের স্টার্ট-আপ আর ইকোসিস্টেম উদ্ভাবনে যোগ দিন, পুঁজিপতি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দেখা করুন।
আমরাও তাদের কাছ থেকে শিখবো, তাঁরাও শেখার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি, আমি বাংলাদেশী যুবকদের জন্য সুবর্ণজয়ন্তী বৃত্তি ঘোষণা করছি।

সাথীগণ,
শেখ মুজিবুর রহমানজী বলেছিলেন,
“বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে
বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন কোনো শক্তি নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার মতো ক্ষমতা কারও নেই।

বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধিতাকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল এবং বাংলাদেশের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাসও ছিল। আমি আনন্দিত যে, শেখ হাসিনাজীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে তার সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। যারা বাংলাদেশ গঠনে আপত্তি করছেলিনে, যারা এখানকার মানুষকে নিচু চোখে দখেতনে, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, বাংলাদেশ তাদের ভুল প্রমাণ করছে।

সাথীগণ,

আমাদের সাথে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিন্ন ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণা।
গুরুদেব বলেছেন-
কাল নাই আমাদের হাতে;
কাড়াকাড়ি করে তাই সবে মিলে;
দেরি কারো নাহি সহে কভু
অর্থাৎ,

আমাদের অপচয় করার মতন সময় নেই, পরিবর্তনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এখন আর দেরি করা যায় না।
এটি ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।
দুই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য,
তাদের ভবিষ্যতের জন্য,
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের জন্য,
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য,
আমাদের লক্ষ্য এক, তাই আমাদের প্রচেষ্টাও এক হওয়া উচিত।
অতএব, আমাদের আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে, নতুন মাত্রা দিতে হবে, নতুন উচ্চতায় নিতে হবে।

আমি বিশ্বাস করি যে, ভারত এবং বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে একসাথে অগ্রগতি করবে।
আমি আবারো আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
আপনারা আমার প্রতি যে হৃদ্যতা দেখিয়েছেন, ভারতের প্রতি এই ভ্রাতৃত্ব, আপনাদের আন্তরিকতা আমি প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে পৌঁছে দেব!
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরঞ্জীবী হবে।
এই শুভকামনা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্যের ইতি টানছি।
জয় বাংলা!
জয় হিন্দ!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top