সকল মেনু

রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য: কারসাজিতে যাত্রীর পকেট কাটা

রাজধানীর মিরপুর-১০ থেকে বাসে চড়ে কাজীপাড়া পার হতেই আসনে বসা এক যাত্রীর কাছে ভাড়া চাইলেন বাসের সহকারী। গন্তব্য আগারগাঁও জেনে ভাড়া হাঁকলেন ২৬ টাকা। ওই যাত্রী ২৫ টাকা বের করে দিলেন। তাঁর পাশের আসনে বসা আরেক যাত্রী যাবেন আজিমপুর। তাঁর কাছ থেকেও ভাড়া নেওয়া হলো ২৬ টাকা।

মিরপুর-আজিমপুর রুটে চলাচল করা সেফটি পরিবহনের বাসে গত বুধবার রাত ৯টার দিকের চিত্র এটি। অথচ পাশেই বাসের জানালায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা লাগানো রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব তিন কিলোমিটার। সর্বনিম্ন ভাড়া হিসাবে আসে সাত টাকা। যদিও প্রকৃত ভাড়া কিলোমিটার হিসাবে পাঁচ টাকার একটু বেশি।

দূরত্বে বড় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একই ভাড়া আদায় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বাস সহকারী রিয়াদ বলেন, ‘ভাই, এইটা কিছু করার নাই। আমি তো এক টাকা কম নিলাম। সবার জইন্যে সমান!

মালিক যেভাবে কইছে। চেক আছে। কাজীপাড়া পার হইলেই ২৬ টাকা।’

নেয়ামত উল্লাহ নামের আরেক যাত্রী পাশ থেকে বলেন, ‘মিরপুর-১০ নম্বরে একটি প্রাইভেট কম্পানিতে ছোট পদে চাকরি করি। আগারগাঁও থেকে লোকাল বাসে যাতায়াত করি। প্রতিদিনই বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। কম টাকায় একটি ছোট্ট কক্ষে থাকতে পারি বলে মিরপুরে বাসা নিইনি। কিন্তু চেকের নামে বাসগুলোর গলা কাটা ভাড়ায় সবই ওদের পেটে চলে যায়।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও ভাড়া নিয়ে আগের মতোই স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। প্রতিটি বাসে ভাড়ার তালিকা টাঙানোর নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ বাসে তা মানা হয় না। বিরতিহীন সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলেও কার্যত সব বাসই বিরতি দিয়ে চলে। আবার বিভিন্ন জায়গায় চেকের কথা বলে বিআরটিএর কিলোমিটারের হিসাব মানা হয় না। নিয়ম অনুযায়ী গণপরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ থেকে সাত টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু এই নিয়ম কেউ মানে না। গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদসহ প্রতিটি রুটেই বাসযাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিভিন্ন বাসের কন্ডাক্টরদের কাছে মালিকপক্ষের মনগড়া বর্ধিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তাতে সরকারি কোনো দপ্তরের সিল-স্বাক্ষর নেই। বাস মালিকরা নির্ধারিত কিছু স্টপেজ ধরে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রুটের মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্থান থেকে বাসগুলো ইচ্ছামতো যাত্রী তুলছে। ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছামতো।

দেখা যায়, সায়েদাবাদ থেকে বাড্ডার দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। মিনিবাসে এই দূরত্বে ভাড়া আসে প্রায় ১৫ টাকা। অথচ এই রুটে চলা অনাবিল, রাইদা, ছালছাবিলসহ সিটিং সার্ভিসের নামে বিভিন্ন পরিবহন আদায় করছে ৪০ টাকা।

সদরঘাট থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ীগামী ভিক্টর ক্লাসিক ও আকাশ পরিবহনের বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিআরটিএ নির্ধারিত তালিকা মানা হচ্ছে না। কিলোমিটার হিসাবে নয়, বাসে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে স্টপেজ বা চেকের হিসাবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় কিলোমিটারের হিসাব হারিয়ে গেছে রাজধানীর বাসগুলো থেকে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে স্টপেজ বা চেকের হিসাবে ভাড়া আদায়। এ নিয়ে কোনো যাত্রী কিছু বললেই কন্ডাক্টরের হুমকি শুনতে হয়। প্রতিবাদকারী যাত্রীকে মাঝপথে জবরদস্তি বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

গত রবিবার সদরঘাট থেকে এক যাত্রী ভিক্টর ক্লাসিকের বাসে চড়ে গুলিস্তানে এসে নামেন। তাঁর কাছ থেকে ভাড়া রাখা হয় ১০ টাকা। গুলিস্তান থেকে আয়েশা সিদ্দিকা নামে এক শিক্ষার্থী বাঁশতলা (নতুনবাজার) যাওয়ার জন্য ওঠেন। তাঁর কাছ থেকে নেওয়া হয় ৩০ টাকা। অথচ সদরঘাট থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। মাঝখানে চেকের নামে হিসাবের তালগোল পাকিয়ে চলে যাত্রীর পকেট কাটা।

যাত্রী আয়েশা বলেন, ‘পুরানা পল্টন বা বিজয়নগর পানির ট্যাংকির পাশ থেকে ভিক্টর ক্লাসিক বা আকাশ পরিবহনের বাসে উঠে শান্তিনগরে নামলেও ১০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। আবার ফ্লাইওভার পাড়ি দিয়ে আবুল হোটেলের সামনে নামলেই ভাড়া হয়ে যায় ২০ টাকা। অথচ পল্টন থেকে আবুল হোটেল পর্যন্ত দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি হবে না। কিছু বলতে গেলেও বাসের চালক ও সহকারী খারাপ আচরণ করে।’ এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করলে ভিক্টর ক্লাসিক ও আকাশ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আমি একটা কাজে একটু ব্যস্ত আছি। এসব বিষয়ে এখন কথা বলতে পারছি না।’

যাত্রী হয়রানিতে পিছিয়ে নেই মিরপুর থেকে বাড্ডা লিংরোডগামী বাস নূরে মক্কা পরিবহনও। এই বাসেও বিরতিহীন বা চেকের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম টিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিআরটিএ নির্ধারিত কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়াই আমরা নিচ্ছি। আমাদের পরিবহনে ১৫, ১০ ও ৫ টাকার তিনটি চেক রয়েছে। মিরপুর থেকে কালশী পর্যন্ত ২৫ টাকা। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে উঠলেও একই ভাড়া।’

বিরতিহীনের নামে লোকাল বাস চালানোর বিষয়ে তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় সিটিং সার্ভিস চালানো কঠিন। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে অনেক সময় তেল খরচের টাকাটাও উঠে আসে না। তবে যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলার কাজটা বাসের চালক-সহকারীরা করছে। আমরা আলাদা আলাদা চেক রাখলেও ওরা মেরে দিচ্ছে।’

এ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করলে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, ‘সড়কে বাড়তি ভাড়া আদায় বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান স্যার অথবা পরিচালক রোড সেফটি বলতে পারেন।’ গত বৃহস্পতিবার এবং সর্বশেষ গতকাল শনিবার বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের দাপ্তরিক নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরিচালক রোড সেফটির নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top