সকল মেনু

কুয়াকাটায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা চরম বিপাকে

download (6)মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৭ আগস্ট :পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় একখন্ড জমি কেনা। সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এযেন ছিল স্বপ্নের বাস্তবায়ন। যারা এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জমি কেনা, সেখানে বহুতল ভবন, আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা। আলাদা একটি প্যাসেজ থাকা সেখানে। অবসর পেলেই বিরামহীন ব্যস্ততার ফাকে কুয়াকাটায় ছুটে আসা। একটু অবসর, একা কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্জনে খাটানো। দীর্ঘ সৈকতের বেলাভুমে স্বাধীন বিচরণ। সমুদ্রস্নাত সূর্যোদয়, অস্তমিত সূর্য। এসব বিরল দৃশ্য উপভোগ করা- এইতো। এসব স্বপ্ন পূরনের আশায় হাজারো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সোনার দামে কিনেছেন এক চিলতে জমি। এক সময়ের অচেনা, বন জঙ্গলে ঘেরা শ্বপদ শঙ্কুল জনপদে একের পর এক ইটের উপরে ইট গেঁথে করেছেন বহুতল অত্যাধুনিক আবাসিক হোটেল-মোটেল। কেউ কেউ থ্রি ষ্টার মানেরও হোটেল নির্মাণ করেছেন। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন পর্যটন প্রকৃতিপ্রেমি মানুষেরা। কিন্তু গত প্রায় দু’বছর ধরে লগ্নিকারদের সুখের সেই স্বপ্ন ক্রমশ দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু হয়েছে। ভবিষ্যৎ সোনালী দিনের আশায় যারা ব্যবসায় প্রসার লাভের চিন্তা করেছিলেন তারা এখন বহুজনে চোখে দেখছেন সর্ষেফুল। এক শ্রেণীর স্থানীয় টাউট বাটপার, প্রতারক, জালিয়াত চক্রের কারণে কুয়াকাটায় জমি কিনে কোটি কোটি টাকার লগ্নি করে এসব ব্যবসায়ীদের এখন দুরাবস্থা হয়েছে। পথে বসে পড়ার আশঙ্কা দেখা হয়েছে অনেকের। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে সর্বশান্ত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন। অনেককে একের পর এক মিথ্যা মামলায় আসামি করে হয়রানিও করা হচ্ছে। একই জমি তিন/চারবার পর্যন্ত কিনতে হয়েছে। হয়রানির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার কয়েকটি স্থানীয় চক্রও গড়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসনও জড়িতের এন্তার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি খাস জমি, বিতর্কিত জমি জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল-পর্চা তৈরি করে উচ্চ দরে বিক্রি করে এসব চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর পরে ঘাপটি মেরে থাকা চক্রটি আবার বিক্রি দেয়া জমির তথা কথিত অংশীদার বানিয়ে শুরু করে হয়রানি। নানান কায়দায় করা হয় আর্থিক ফায়দা লোটার কাহিনী। অর্থ লুটতে না পারলে দখল করা হয় জমি। গত চার বছরে অন্তত ৫০টি দখল সন্ত্রাস চলেছে কুয়াকাটায়। ফলে কুয়াকাটায় বেসরকারি ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এখন হুমকির পথে। যা কুয়াকাটার সার্বিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়িয়েছে।

দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে এসব চক্রের হয়রানির চমকপ্রদ কাহিনী পাওয়া গেছে। কয়েকজন ভূক্তভোগীর অভিযোগ, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতার কারণে প্রতারক এই চক্রটি মরিয়া হয়ে লেগেছে হয়রানি বাণিজ্যে। প্রতারক চক্রের কবল থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিলেন কুয়াকাটা এগ্রো সার্ভিস লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস হোসেন। তিনি তার লিখিত আবেদনে উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘ দশ বছর জাপানে চাকরী করার পরে ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে লতাচাপলী ইউনিয়নের লতাচাপলী মৌজার নবীনপুর গ্রামে ৫১৪ খতিয়ানে দুই একর জমি কিনে ব্যবসা শুরু করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ই,ই,এফ, ইউনিট এর সহযোগিতায় ২০০৪ সালে কুয়াকাটা এগ্রো সার্ভিস লিঃ নামে একটি কোম্পানী গঠন করে মৎস হ্যাচারি করতে পাঁচ একর ষাট শতক জমি ক্রয় করেন। জনতা ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ নিয়ে দলিলপত্র পরীক্ষা করেন।

২০০৬ সালে প্রোডাকশনে আসে হ্যাচারি। এমনকি কলাপাড়া ভূমি অফিসে ৫-কে/০৪-০৫ মোকাদ্দমায় ২০০৫ সালের ২৩মার্চ পৃথক খতিয়ান খুলে খাজনা পরিশোধ করে ভোগ দখল করে আসছেন অদ্যাবধি। শুরু হয় হয়রানি ২০০০ সালে। মিথ্যা ওয়ারিশ সেজে গলাচিপার নলুয়াবগি এলাকার নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী ময়না বেগম ওয়ারিশ সেজে আদালতে মামলা দায়ের করেন (৩১৯/২০০২)। প্রথমে মোকাদ্দমায় মোট আট একর ৮১ শতক জমির মালিকানা দাবি করেন। এমনকি জনৈক কুলসুম বিবির কাছ থেকে কেনা ৪১ শতক জমি নিয়ে শুরু করে নাটকীয় কাহিনী। হঠাৎ জমির মালিকানার দাবি ৮ একর ৮১ শতক থেকে কমিয়ে এক একর ৪০ শতক বলা হয়। স্বামীর জীবদ্দশায় কুলসুম ও তার স্বামী আর্শ্বেদ গাজী যৌথ দাতা হিসাবে একাধিক দলিল প্রদান করেন। ১৯৭৭ সালের ৫ নবেম্বর, ১৫ এপ্রিল এবং ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ তিনটি দলিল কুলসুম বিবি সেজে দেয়া হয় বলে প্রতিপক্ষ দাবি করেছে এবং ওই মহিলা কুলসুম নয় ফাতেমা বেগম। অথচ রহস্যজনক কারণে জমির মালিকানা দাবি করা ময়না বেগম কুলসুম কিংবা ফাতেমা বেগমকে থানায় দায়ের করা মামলায় আসামি না করে লীগ্নকারক ইলিয়াস হোসেনসহ তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের আসামি করে মামলা, জিডিসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিতে থাকে। কিন্তু কুলসুম কিংবা ফাতেমা যাকে লাখ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে জমি কিনতে গিয়ে তাকে আসামি করা হচ্ছে না। ইলিয়াস হোসেনের অভিযোগ নবীনপুর গ্রামে নব্য কোটিপতি আয়কর ফাঁকিবাজ হাজী ইসমাইল বাহিনী তাকে এভাবে হয়রানি করেছে। পরবর্তীতে মোটা অংকের বিনিময়ে বিষয়টি ইলিয়াস ফয়সালা করেন।

শুধু একজন ইলিয়াস হোসেন নয়। কুয়াকাটায় প্রথম লগ্নিকারক হিসাবে পরিচিত শাহজালাল হোসেন। তিনি ৯০ সালের পরে লতাচাপলী মৌজার ১২২৭নং খতিয়ানের প্রথমে ১৪ শতক, পরবর্তীতে ২৬ শতক জমি ক্রয় করেন। নির্মাণ করেন একটি টিনশেড আবাসিক হোটেল। তার ভাষায় সেকান্দার শেখ ও ছোমেদ শেখ গংদের মালিকানায় কাগজপত্র দেখে তিনি এই জমি ক্রয় করেন। এসব জমির দলিল দিয়ে নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেন। দীর্ঘদিন ব্যবসা করার পরে তাদের স্থাপনা কয়েক বছর আগে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়। তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশে ফের কোনমতে স্থাপনা ধরে রেখেছেন। কিন্তু তাদের কুয়াকাটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। স্থানীয় ভূমি অফিস জানায়, ১২২৭ নং খতিয়ানটি লুচ খতিয়ান থাকায় তা বাতিল করা হয়েছে। মূলত ওই জমি এখন সরকারের খাস খতিয়ান। একই খতিয়ানের থেকে স্কাই কটেজ মালিকও এক একরের বেশি জমি ক্রয় করেন। তার হোটেল বহু আগেই উচ্ছেদ করা হয়েছে। এভাবে ক্রেতা সহিদুল, শাহজালাল মিয়া, আবুল কালাম, হাসানুল ইকবাল, ইউসুফ আলী তালুকদার, জাহাঙ্গীর, রুস্তুম আলী সবাই মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়ে এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। ক্ষতিগ্রস্থ লগ্নিকারকদের অভিযোগ ১৭ দশমিক ৫০ একর জমির মূল মালিক আরজ আলী শেখ গং। অথচ খতিয়ানের মূল মালিক আরজ আলী শেখ এর সন্তানরা ওই সব জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। গড়ে তুলেছে সেকান্দার হোটেল, সৈকত হোটেল ও নিজস্ব বাড়িঘর। সে সব স্থাপনা ভাঙ্গা হয়নি। এদের দেয়া তথ্যমতে, আরজ আলী শেখ এর কাছ থেকে তিন একর, সেকান্দার আলী শেখ এর কাছ থেকে তিন একর, ওয়াজেদ আলী শেখ এর কাছ থেকে তিন একর, সুলতান আহম্দে এর কাছ থেকে এক একর, চান মিয়ার কাছ থেকে দেড় একর, জব্বার মিয়ার কাছ থেকে দেড় একর, নিজাম উদ্দিন এর দেড় একর। এ পরিমাণ জমি কিনে এখন সবাই প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, হোটেল ঢাকা নিবাস, কটেজ সুইট হোম, গ্রেভারইন, হোটেল সৈকত, হোটেল আঁখি, হোটেল শিপনসহ অসংখ্য লগ্নিকারদের ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দলিল দেয়া হয়েছে। এমনকি বেড়িবাঁধের স্লোপের খাস জমির দখল বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কুয়াকাটায় আসা লগ্নিকারকরা এমনভাবে প্রতারিত এবং হয়রানির জন্য স্থানীয় একটি টাউট চক্রকে দায়ী করেছেন। যারা জমি বিক্রি শেষে স্থাপনা তোলার পরে ভূয়া অংশীদার দাড় করে মালিকানা দাবি করা হয়। এ চক্রের লক্ষ্য যদি হয়রানি করে মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায়, তা ভাগাভাগি করে নেয়া যাবে। বর্তমানে লগ্নিকারকদের দাবি এ চক্রের বিরুদ্ধে জরুরী আইনী পদক্ষেপ নেয়া হোক এবং সরকারী খাস জমি ব্যক্তিস্বার্থে জালিয়াতি করে মালিকানা তৈরি করে যারা বিক্রি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। এছাড়া উদ্ধার করা খাসজমি কুয়াকাটায় আসা বেসরকারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সিলিংয়ে বন্দোবস্ত দেয়া হোক। তাইলে কুয়াকাটার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। নইলে কোটি কোটি টাকার লগ্নিকারকরা এখান থেকে শূন্য হাতে ফিরে যাবে। হবে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top