সকল মেনু

বদলে যাচ্ছে চলনবিল

Cholon bill20130825070050হটনিউজ২৪বিডি.কম,চাটমোহর (পাবনা), ২৫ আগস্ট: সকাল ৬ টায় ঢাকার গাবতলী থেকে বাসে উঠি। সকাল সাড়ে ৯ টায় পৌঁছে যাই বাড়িতে। একসময় চলনবিল থেকে উপজেলা সদরে যেতে লাগতো পুরো ৬ ঘন্টা।
বর্ষায় লাগতো আরও বেশি সময়। এভাবেই বদলে গেছে চলনবিলের জীবনযাত্রা। চলনবিলের বদলে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে গেলে চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল বাজারের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জামিন হোসেন জানালেন এসব কথা।
ওই এলাকায় কর্মরত সংবাদকর্মী জাকির সেলিম জানান, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে চলনবিলের চালচিত্র। তিনি বলেন, আমার ভাবনায় আর দেখায় তফাৎটা হলো, চলনবিলের বুক চিরে নির্মিত বনপাড়া-হাটিকুমরুল বঙ্গবন্ধু সেতু সংযোগ সড়ক।
এই সড়কটি চলনবিলের মানুষের জীবনে গতি এনে দিয়েছে। চাটমোহর, তাড়াশ, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলার মাঝ দিয়ে সোজাসুজি চলে গেছে সড়কটি।
তাড়াশ ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক মেহেরুল ইসলাম বলেন, এক সময়ের দূর্গম তাড়াশ এখন এই সড়কের মাঝখানে হওয়ায় এটি উন্নয়ন ভরসার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার ছেলে-মেয়েরা এখন যে আধুনিক পোষাকটি পরছে, এখানকার ছেলে-মেয়েরা সেটাই পরছে। আর সকালে গিয়ে বিকেলে ঢাকায় কাজ সেরে বাড়ী ফিরছে অনায়াসে। যেটা একদিন স্বপ্নের মতই ছিল।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ এলাকার মহিষলুটির আড়তদার মোশারফ হোসেন জানান, আগে রাস্তাঘাট না থাকায় বর্ষাকালে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রিত থাকত। পরে শুটকি করা হতো অথবা ফেলে দেওয়া হতো।
এখন তো আর সেদিন নেই। দিন বদলেছে। এখন ঢাকাসহ দেশের সব এলাকা থেকে চলনবিলের মাছ কিনতে ব্যাপারিরা এসে হাজির হয়। ট্রাক ভরে মাছ নিয়ে ফিরে।
বর্ষাকালে প্রতিদিন এখানে কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। চলনবিলের মাছে অর্থনীতি জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব ফেলে।
চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের সমাজ গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর সদর দপ্তরে কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলী মমিন মুজিবুল হক টুটুল বলেন, ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়।
চলনবিলের বড়ালব্রীজ, শরৎনগর, মোহনপুর, দিলপাশার ষ্টেশনগুলোর সঙ্গে কোলকাতার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে করে মাছ যেতো কোলকাতায়।
পাকিস্তান আমলে খুব সীমিত আকারে চলনবিলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। সে সময় নির্মিত হয় ঢাকা-বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়ক। আর স্বাধীনতার পরে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত নির্মিত হয় মুজিব বাঁধ।
এই বাঁধ বিলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক মাইলফলক হয়ে আছে এখনও।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে চলবিলের বুকচিরে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়। চালু হওয়ার পরে চলনবিলের যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌকা, গরুরগাড়ী ও পায়েহাঁটার যুগ অতিক্রম করে।
এই সড়কটির ফলে এখানকার মানুষের জীবন যাপনে যানবাহন এনে দিয়েছে দ্রুতগতি। রাজধানীসহ সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে আরও সহজ।
চাটমোহরের বাসিন্দা ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনির্ভাসিটির শিক্ষক ড. জহুরুল ইসলাম বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একযুগ আগের এই পশ্চাৎপদ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান আর আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা।
আমি চলনবিলের ওপর কিছু কাজ করেছি। আমার ধারনা, যোগাযোগের এই প্রভাব পড়েছে চলনবিলের প্রতিটি গ্রামে।
উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়ন সদরের, এমনকি অধিকাংশ গ্রামের সঙ্গে ইউনিয়নের পাকা সড়ক হয়েছে। এলাকায় গিয়ে দেখেছি, প্রতিটি ইউনিয়ন সদরের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
এবার ঈদে গ্রামে গিয়ে অবাক হয়েছি। গ্রামে এখন সিএনজি পৌঁছে গেছে। গ্রামের পাকা সড়কগুলোতে সিএনজি চলছে। গ্রামের মানুষ তাতে চড়ে দ্রুত শহরে যাচ্ছে, আবার ফিরেও আসছে।
তিনি আরও বলেন, চলনবিল এলাকা সম্ভবনার দ্বার খুলে বসে আছে। যোগাযোগের ওপর ভর করে গড়ে তুলতে হবে শিল্পকারখানা। আয় উৎসারি কর্মকান্ড বাড়াতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ের মধ্যে চলনবিল আলো দেখাবে দেশকে।
চলনবিলের তাড়াশ উপজেলার আরেক কৃতি সন্তান পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বলেন, আমার জন্ম তাড়াশ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কুশাবাড়ীতে। গ্রামের সাথে আমার এখনও নাড়ির সম্পর্ক। অনেক স্বপ্ন দেখি আমার প্রিয় চলনবিল নিয়ে।
ঢাকায় আমার নিজস্ব বাড়ী নেই। কারন, আমি শেকড়ে ফিরবো অবসর নিয়ে। তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, চলনবিলের সকল উপজেলায় ভবিষ্যতে গ্যাস লাইন যাবে। বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়ক হয়ে রাজশাহী যাওয়া গ্যাস লাইনটি চালুর পর এই সম্ভাবনা আরও বেড়েছে।
তিনি স্মৃতি হাতড়ে বলেন, আমার এখনো মনে পড়ে, গ্রাম থেকে ৫ ঘন্টা নৌকায় ভেসে সিরাজগঞ্জ এসে তারপর ফেরি পার হয়ে ট্রেনে ঢাকা আসতাম গভীর রাতে। আর এখন বাড়ী গিয়ে দিনে দিনে আবার ঢাকায় ফিরি।
শুনেছি একসময় ভয়ে কোন সরকারী কর্মকর্তা তাড়াশে বদলি হয়ে যেতে চাইত না। শুধু তারাই আসতে বাধ্য হতেন, যাদের শাস্তিমূলক বদলি হতো। আর এখন শুনি অনেকেই তদবির করে সেখানে বদলি নেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, যে কোন উন্নয়ন পরিবেশ-প্রতিবেশ অর্থাৎ জীববৈচিত্রের ক্ষেত্রে একটা বিপর্যয় নিয়ে আসে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের একমুখো উন্নয়ন ভাবনায় সেটি ব্যাপকভাবে প্রতিভাত হয়।
সে ক্ষেত্রে চলনবিলের আজকের উন্নয়নেও তাই ঘটেছে। এখন চলনবিলে মাছ পাখি জলজ উদ্ভিদ আমরা হারাতে বসেছি। মাছের বিল চলনবিলে এখন মানুষের পাতে মাছ নেই। সারা বছর পানি থাকছে না বিলে। নদীগুলোও মরছে।
পাবনা-৩ আসনের সাংসদ আলহাজ্ব মকবুল হোসেন বলেন, পাবনার টেবুনিয়া-চাটমোহর হয়ে আরেকটি বড় সড়ক বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহসড়কের মান্নান নগর পর্যন্ত নির্মাণ হচ্ছে। এটি শেষ হলে চলনবিলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও গতিসঞ্চার হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top