সকল মেনু

একজন ডাক্তার দিয়ে চলছে হাসপাতাল

 হুমায়ুন কবীর, বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) থেকে ২১ আগষ্ট : ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তখন দুপুর ১ টা ৩০ মিঃ। হাসপাতালের বাহিরে ঘুড়াঘুড়ি করছে কয়েকজন রোগী। কেউ এসেছে নিজের চিকিৎসা নিতে আবার কেউ স্ত্রী বা সন্তানের চিকিৎসা নিতে এসেছেন। বারান্দার এধার থেকে ওধার পর্যন্ত পায়চারি করছেন আবার কেউ কেউ বসে আছেন গাছের ছায়ায়। জিজ্ঞেস করতেই তারা জানালেন প্রায় এক ঘন্টা হলো এসেছেন কিন্তু ডাক্তার নাই।images00

জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, একজন ওয়ার্ড বয় বসে বসে নিজমনে খাতাপত্র ঘাটছেন। ডাক্তার কোথায় জিজ্ঝেস করতেই বিরক্তির সুরে জানালেন, আমি জানিনা। পশ্চিম পাশে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়। সেখানে তালা বদ্ধ। পাশেই হাসপাতালের অফিস কক্ষ, সেখানেও তালাবদ্ধ। এতবড় হাসপাতাল ডাক্তার খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? জানতে খুজতে খুজতে দোতলায় ভর্তি হওয়ায় রোগীদের পাশেই ডিউটি রুম। সেখানে বসে আছেন দুজন নার্স। ডাক্তার কোথায় জানতে চাইলে কোন জবাব দিলেন না বরং কাগজপত্র ঘাটতে লাগলেন। দোতলা থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল একজন রোগী বহনকারী ভ্যান-রিক্সা হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যে দক্ষিন দিকে যাচ্ছে। আবার সেদিক থেকে আরো ৪/৫ জন রোগী হাতে কাগজ নিয়ে হাসপাতালের দিকে আসছে। আচ করা গেলো সেদিকই বোধহয় ডাক্তার আছেন। নিচে নেমে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যাওয়া রোগী ডাঙ্গীপাড়া গ্রামের আনসারুল, আকলেমা সহ কয়েকজন জানালেন, স্যার বাসায় আছেন। সেখানেই দোতলায় রোগী দেখছেন।

ডাক্তারদের আবাসিক এলাকার একটি বিল্ডিংয়ের দোতলায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে ডাঃ রেজা রোগী দেখছেন আর বারান্দায় চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগী অপেক্ষা করছেন। ডাক্তারের মাথার ওপরে কাগজে লেখা রয়েছে নতুন রোগীর পরামর্শ ফি ২শ টাকা এবং পুরাতন রোগীর জন্য ১শ টাকা। ভেতরে গিয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই ডাঃ রেজা বললেন, আজ (মঙ্গলবার) একজন মাত্র চিকিৎসক আমি। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার আল-মামুন রয়েছেন ছুটিতে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন পাশ্ববর্তী উপজেলা রানীশংকৈল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে হাসপাতাল চেম্বারে বসে রোগী দেখলে দুর-দুরান্ত থেকে আসা রোগীরা ৫ টা দিয়ে টিকেট কেটে চিকিৎসাপ নিতে পারতেন। বাসায় এসে ২শ টাকা পরামর্শ ফি দিয়ে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার সামর্থ অনকের নাই। জবাবে ডাঃ রেজা জানান, হাসপাতালে মোট রোগীর সংখ্যা ২১ জন। ১৭ টি ডাক্তারের পদ থাকলেও কার্যতঃ ডাক্তার রয়েছেন মাত্র ২ জন। এর মধ্যে আবার এরকজন ছুটিতে। একজন ডাকাতারকেই কেই নৈশকালীন ডিউটি সহ ২৪ ঘন্টায় ডিউটি করতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, প্রায় এক বছর আগে হাসপাতালে আরো ৩ জন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট ডাক্তারগন হাসপাতালে যোগদানের পর আর হাসপাতালে আসেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নার্স রয়েছে ৫ জন, হাসপাতালে চালু আছে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার বিশেষ ইউনিট। শুধুমাত্র ডাক্তারের অভাবে তাদের কোন সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গর্ভবতী মায়েদের রেফার্ড করা হচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ে। এতে করে এলাকার অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের প্রসূতিদের গুনতে হচ্ছে প্রায় ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকা। হরিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিশেষ ইউনিটে প্রসূতি মায়েদের সেবা দিতে পারলে সরকারি ভাবেই সম্পূর্ন ওষুধ এবং যাবতীয় পথ্য ও বিনেপয়সায় এম্বুলেন্স সেবা প্রদান করা যেতো। ওই প্রেগ্রামের আওতায় প্রসূতি মায়েদের জন্য ৬ হাজার টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ রয়েছে। শুধুমাত্র ডাক্তারের অভাবেই ওই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার প্রসূতি মায়েরা।

উপজেলার কারিগাঁও এলাকার প্রসূতি মা সাহেরা খাতুন সেখানেই সন্তান প্রসব করানোর জন্য বার বার আকুতি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ডাক্তারের অভাবে তাকেও রেফার্ড করা হলো ঠাকুরগাঁয়ে।

সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা ৩০ মিঃ পর্যন্ত আউটডোরে রোগী দেখলে এলাকার হতদরিদ্ররা ৫ টাকা খরচে চিকিৎসা নিতে পারতেন। মূখ্য এ সময়টা রোগীদের জন্য হাসপাতালে বসে রোগী দেখলে তারা ২শ টাকা পরামর্শ ফি থেকে বাঁচতেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি একই কথার পূনরাবৃত্তি করে বলেন, একজন ডাক্তার দিয়ে কিভাবে সেবা দেয়া সম্ভব।

হাসপাতাল ক্যাম্পাস ঃ ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির গত ১ বছর আগে নতুন ভবন নির্মান সহ আবাসিক ও জরুরি মা ও শিশু সেবার জন্য নতুন ভবন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারটির জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিকল হয়ে আছে এক্সরে মেশিন। জরুরি রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা সহ রোগ নির্নয়ের জন্য প্যাথলজি বিভাগ চালু থাকলেও সেখানে কোন কাজ হয় না। একজন প্যাথলজিষ্ট থাকলেও তাকেও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, দুপুর ১ টা ৩০ মিঃ এর সময়ইে বন্ধ পাওয়া গেছে হাসপাতালের কন্ট্রোল রুম।

হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলোর রঙ চকচকে থাকলেও হাসপাতালের ক্যাম্পাস জুরে জংলাকীর্ণ। দেখলে মনে হবে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত কোন গহীন এলাকার মধ্যে পরিত্যাক্ত কয়েকটি বিল্ডিং। চারদিকে মশা-মাছি আর অস্বাস্থকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এলাকার সুধীজন হামিদুর রহমান, নাজমুল ইসলাম সহ কয়েকজন জানান, হরিপুরে কারো যে কোন রোগের উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত হরিপুর ত্যাগ করে অন্যস্থানে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। আসলে হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা হয় না। হাসপাতালটিই বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ। সেখানে ভর্তি থাকা কয়েকজন রোগী জানান, পথ্য হিসেবে সেখানে যা সরবরাহ করা হয়ে থাকে তা খাবার অনুপোযুক্ত। এলাকার ইব্রাহিম খলিল, এডভোকেট মোজাফফর রহমান মানিক সহ কয়েকজন জানান, হরিপুর হাসপাতালটিতে সেবা না দিয়েও সরকারি লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে। চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন না ঘটিয়ে হাসপাতালটি পরিনত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে।

এ ব্যাপারে হরিপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামীগ সাধারন সম্পাদক জিয়াউল হাসান মুকুল জানান, একেবারে সীমান্তঘেঁষা এ উপজেলার হাসপাতালটিতে ডাক্তার থাকতে চাননা। কেউ কেউ নিয়োগ পেলেও তারাও বিভিন্নভাবে তদবির করে চলে যান। এতে করে এলাকার লোকজন স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছে।

এ ব্যাপারে হরিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মুসা জঙ্গী জানান, ডাক্তার নিয়োগের বিষয়ে উপরে জানানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top