সকল মেনু

মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি

7c7acad3b53eeb4cb14211abdfaa274b_XLআছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম:সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাচ্যের দেশগুলোতে বাহ্যত বিভিন্ন দেশ ও জাতি অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনের কথা বলে পক্ষান্তরে সেই দেশগুলোর ওপর তাদের আধিপত্য বা উপনিবেশিকতা চাপিয়ে দিয়েছিল। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে উপনিবেশবাদীরা বিভিন্ন দেশ ও জাতির সম্পদগুলো লুট করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন যুদ্ধ বাধিয়েছে। এটা তাহলে কী ধরনের গণতন্ত্র? ইউরোপ ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের স্বরূপ তুলে ধরার পাশাপাশি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই মতবাদগুলোকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানের মানবিক বিভাগে বেশ মতানৈক্য রয়েছে। ইতিহাসের সূচনা থেকেই মানুষ গণতন্ত্র , স্বাধীনতা এবং নিজের অধিকার আদায় বা প্রতিষ্ঠার পেছনে সচেষ্ট ছিল। দ্বীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলোকে যথার্থ এবং যুক্তিগ্রাহ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। অথচ ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সেই ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর। পশ্চিমা বিশ্বের ডেমোক্রেসি নিয়ে কথা বলার আগে আমরা রোম এবং গ্রিসের মতো দেশগুলোতে ডেমোক্রেসি কীভাবে তার দৃপ্ত পদভার রেখেছিল সেই ইতিহাসের দিকে একবার নজর বুলানো যাক।

ডেমোক্রেসি একটি গ্রিক শব্দ। দুটি শব্দের মিশ্রণে এই পরিভাষাটির জন্ম হয়েছে। একটি হলো ডেমোস, অপরটি ক্রেসিয়া। ডেমোস মানে হলো জনগণ আর ক্রেসিয়া মানে হলো হুকুমাত এবং শক্তি বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তার মানে ডেমোক্রেসি বলতে বুঝায় জনগণের ক্ষমতা বা শাসন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দিতে এথেন্সে ডেমোস মানে বুঝাতো এমন এক জনসমাবেশকে যারা হুকুমাতের কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্যে সমবেত হতো। আর ডেমোক্রেসি বলতে বুঝাতো সেইসব শাসনব্যবস্থাকে যেই শাসন ব্যবস্থা সকল জনগণের হাতেই ন্যস্ত হয়। অবশ্য প্রাচীন এথেন্সের ডেমোক্রেসি আর বর্তমান কালের ডেমোক্রেসির মধ্যে অঅকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। এথেন্সে জনগণ এক জায়গায় সমবেত হতো নিজেদের সমাজের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন কানুন প্রণয়ন করার জন্যে। সকল নাগরিকেরই দায়িত্ব ছিল আইন প্রণয়নকারী সমাবেশে অংশ নেওয়া এবং নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখা।

অবশ্য দাসেরা-সমাজের একটি বিশাল অংশ হওয়া সত্ত্বেও এবং সেই সমাজের কাজগুলোর দায়িত্ব তাদের ওপর থাকার পরও- নারীদের সাথে সাথে তাদেরও অধিকার ছিল না নীতি নির্ধারণের জন্যে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে অংশ গ্রহণ করার। প্রাচীনকালের রোমানরাও এক ধরনের ডেমোক্রেসি চর্চা করেছিল। তবে এথেন্সের মতো এতোটা বিশাল পরিসরের ডেমোক্রেসি চর্চার সুযোগ তাদের হয় নি। রেণেসাঁসের যুগে অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় চৌদ্দ, পণর এবং ষোল শতকে ইউরোপের চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতির জগতে ব্যাপক পরিবর্তনের সুযোগ হয়েছিল। রেণেসোঁসের ফলে ডেমোক্রেসির ভিত্তিতে মৌলিক পরিবর্তন, উন্নয়ন ও বিকাশ দ্রুততর হয়েছিল। ষোলো শতকের শুরুতে প্রোটেস্টানিজমের প্রতিষ্ঠাতা ও জার্মান পাদ্রী মার্টিন লুথার ক্যাথলিক ধর্মের মূলনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং খোদার সাদা ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে গির্যার মধ্যস্থতা বা ভূমিকাকে অস্বীকার করেছিলেন।

প্রোটেস্টান্ট ধর্মে মানুষের মর্যাদা ও বিবেকের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে তেমনি সৃষ্টি জগতে মানুষের অবস্থানেরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ সময় বহু প্রোটেস্টান্ট গির্যা প্রতিষ্ঠিত হয় যার অনেকগুলোরই কাঠামো ছিল ডেমোক্রেটিক। সেই ষোলো শতকেই ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্ট গির্যার বিশ্বাস ছিল যে শাসকদের রাজনৈতিক শক্তির উৎস হচ্ছে জনগণ।

রেণেসাঁসের যুগ থেকেই ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ধীরে ধীরে মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। বৃটেনের জনগণ সেই ১২১৫ সালেই তাদের রাজাকে বাধ্য করেছিল মেগনাকার্টা নামে মানুষের ব্যক্তি অধিকার বিষয়ক সর্বপ্রথম সনদটি প্রবর্তন করতে। এই আইনটি পাশ হবার পর বৃটিশরা তাদের সরকারের মুখোমুখি হবার প্রেক্ষাপট তৈরিতে সচেষ্ট হয়। বৃটেনের জনগণ ১৬৮৮ সালে যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, ঐ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেদেশে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কিন্তু এরই মাঝে বৃটেনের বিশিষ্ট দার্শনিক জন লক জনগণের জান, মাল এবং স্বাধীনতার প্রতি সরকারী সমর্থনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যাপারেও জনগণের পূর্ণ ক্ষমতার দাবী জানান।

ইউরোপের অন্যান্য দেশেও অভিন্ন চিন্তার প্রবর্তন ঘটতে দেখা যায়। যেমন ফ্রান্সে জন্ম নিয়েছিলেন শার্ল দ্য মন্টেসকিও, ফ্রাঁসোয়া ভলতেয়ার এবং জন জ্যাক রুশোর মতো দার্শনিকের। তাঁদের মতো দার্শনিকের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে সেদেশে ডেমোক্রেটিক চিন্তার বিকাশ ও বাস্তবায়নের সুছনা ঘটে। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাশি বিপ্লবের ক্ষেত্রে এইসব চিন্তাদর্শের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

ভলতেয়াররাও জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি সরকারের আগ্রাসনের বিরোধিতা করতেন। সামাজিক চুক্তি নামক বইতে রুশোও লিখেছেন জনগণ কেবল সেই শক্তিরই আনুগত্য করবে যেই শক্তির বৈধতা রয়েছে। তিনি প্রকৃত শাসক বলতে জনগণকেই বোঝাতেন। ফরাশি বিপ্লব ইউরোপীয় ডেমোক্রেসির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে পরিগণিত, কেননা ঐ বিপ্লব মুক্তি এবং স্বাধীনতার মতো বিশ্বাসগুলোকে দৃঢ়তা দিয়েছিল। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত আমেরিকার বিপ্লবও পাশ্চাত্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত। মার্কিন উপনিবেশবাসীরা এসেছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। তারাই তাদের স্বাধীনতার দাবীতে বিদ্রোহ সংগ্রাম করেছিল। তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির দাবীর মুখে ১৭৭৬ সালে একটি ঘোষণাপত্র লিখিত হয়। ‘মার্কিন স্বাধীন ঘোষণা’ নামে পরিচিত এই স্মারকটি মহাদেশীয় কংরগ্রেসে গৃহীত হয়েছিল। এই ঘোষণাটিকে ডেমোক্রেসির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ বলে মনে করা হয়। শিল্প বিপ্লব এবং শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকেও ইউরোপে ডেমোক্রেসির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপের নতুন চিন্তাদর্শের প্রভাবে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতেও ডেমোক্রেসির বিস্তার ঘটে।

ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র যদিও পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র সুবিধা বয়ে এনেছিল, কিন্তু পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা ঐ ডেমোক্রেসিকে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করা এবং সেসেব দেশের ধন-সম্পদ লুট করে নেওয়ার অজুহাত বা হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল। উপনিবেশবাদী দেশগুলো নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতরো বলে ভাবতো। আর মুসলমানদেরসহ যেসব দেশের ওপর পশ্চিমারা তাদের উপনিবেশিকতা আরোপ করতো তাদেরকে পশ্চাদপদ বলে গণ্য করতো। এ কারণে তারা চাইতো তাদের উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোর সংস্কৃতিকে তাদের আদর্শ তথা চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির আদলে সাজাতে। এর ফলে পক্ষান্তরে যা হতো তা ছিলো উপনিবেশ কবলিত দেশগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের এক ধরনের আগ্রাসন, যে আগ্রাসনের লক্ষ্য হলো অন্য দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে তার স্থলে নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া।

অথচ ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এই জীবন বিধানে মানুষের সমগ্র জীবনের জন্যে সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গলের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে নিহিত রয়েছে। এগুলোর একটি হলো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার বিধান অনুযায়ী রাসূলে খোদা (সা) ইসলামী সমাজ গড়েছিলেন। ইমাম আলী (আ) এর খেলাফত এবং তাঁর বক্তৃতাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলেই সে বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top