সকল মেনু

এক মধ্যরাতে নিভৃত কান্নার অবসান ঘটল

 

Bogobondhu-2bg20130814120409আছাদুজ্জামান:হটনিউজ২৪বিডি.কম,বাঙালি জাতির কান্নার অবসান ঘটল এক মধ্যরাতে। যে রাতে একটি সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেলিত হয়েছিল পুরো বাংলাদেশ।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ একদল ঘৃণ্য ঘাতকের গুলিতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে শাহাদাতবরণ করেন। তার পর জাতি যে বিচারের আশায় দিন গুনছিল তার অবসান হলো ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর। সেদিন প্রায় সারারাত জেগে ছিল বাংলাদেশ।

টিভি চ্যানেলগুলোর খবরে রাত ১টার মধ্যে দেশময় ছড়িয়ে পড়ল বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের সংবাদটি। রাতভর মুখর হয়ে রইল সংবাদপত্রের বার্তাকক্ষ। পরদিন কলঙ্কমুক্তির আনন্দে উদ্বেল হলো দেশ।

তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক খুনিদের দণ্ড এখনও কার্যকর করা যায়নি। মত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) আবদুর রশীদ, মেজর (বরখাস্ত) শরীফুল ইসলাম ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহউদ্দিন, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন (অব.) মাজেদকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় আর অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই এবারও এলো শোকাবহ ১৫ আগস্ট।

দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আর অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতেই খুনিচক্রকে ফিরিয়ে আনা আজ খুবই জরুরি। এছাড়া কারাগারে ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর শহীদ জাতীয় চার নেতার বিচার এখনও সম্পন্ন হয়নি।
আজ রক্তের অক্ষরে লেখা ১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার কলঙ্কিত আর কান্নার দিন আজ।

পঁচাত্তরের এ দিনে আগস্ট আর বর্ষণস্নাত শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়। সেই অনির্বাণ সূর্যের মতো প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। মানুষ মরে যায়, আদর্শ মরে না। তিনি নিজেও একাধিক বক্তৃতায় তা বলেছেন বলে বিভিন্ন ইতিহাসে পেয়েছি।
তাই বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। সেই প্রেরণাতেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একজন বাঙালি সন্তান হিসেবে আজ পুরো জাতির সঙ্গেও আমিও গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের।

১৯৭৫ সালের এ দিনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রাণ হারান তার প্রিয় সহধর্মিনী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শেখ রাসেল এবং দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল।

তবে প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। মধ্য আগস্টের নির্মম সে হত্যাকাণ্ডে আরও নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

ইতিহাসে জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আস্থাহীন দেশি কিছু রাজনীতিকের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে শহীদ হন সেই কালরাতে।

বাংলার পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাকেই ১৯৪৮ সাল থেকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হলো পাকিস্তান নামক ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনন্য নেতৃত্বে। সেই গণরায় উপেক্ষিত হলে একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।

সেদিন তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত `এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম` এ অমর বাণীতেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান ছড়িয়ে পড়েছিল নিপীড়িত কোটি বাঙালির প্রাণে। তার মন্ত্রপূত ঘোষণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।

৭ মার্চের পর আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার ঘোষণা। পাকিস্তানি বাহিনী ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। মৃত্যুর খড়গ মাথায় ঝুললেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) তিনি যে অনন্য দেশপ্রেম আর নেতৃত্বের ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, তার তুলনা বিরল।

মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাসী কয়েক সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে ওই চক্রান্তের বাস্তব রূপ দিতে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম ওই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার মহত্তম আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাস আর অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ।

রাজনৈতিক হত্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন কাল, পরিসরে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, আব্রাহাম লিংকন, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল লিয়াকত আলী খান, বেনজির ভুট্টো, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক নেতা হত্যার ইতিহাস এখনও জ্বলন্ত। কিন্তু সেসব হত্যার বিচার হয়েছে। এমনকি জন এফ কেনেডির হত্যাকারী লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে মেরে ফেলার জন্যও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে জ্যাক রুবিকে।

কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে ইতিহাস যেন উল্টো পথযাত্রী! এখানে বিচার বিঘ্নিত। তাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার যাতে করা না যায়, সে জন্য বিশ্বাসঘাতক নেপথ্য খুনি মোশতাক গং ও বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী শাসকরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো ঘৃণ্য আইন জারি ও তা বহাল রাখে দীর্ঘ ২১ বছর।

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে যাদের বিচার হওয়ার কথা, সেই খুনিদের আখ্যায়িত করা হলো `সূর্যসন্তান` বলে। পুনর্বাসন করা হলো উচ্চপদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে। জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক ও বেসামরিক সরকার তা বহাল রাখল বহু বছর।

অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ২১ বছর পর বাতিল করলেন সেই কালো আইন `ইনডেমনিটি`। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো পঁচাত্তরের খুনিদের। ১৯৯৮ সালে আদালতের রায়ে দণ্ডিত করা হলো খুনিদের। কিন্তু সে বিচারের রায় সংক্রান্ত আপিল আদালতে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হলো নানা চক্রান্ত আর ছলচাতুরীতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top