সকল মেনু

গিরীশ চন্দ্র সেনের ১০৩তম মৃত্যুবাষির্কী

 

Narsingdi 01 নরসিংদী প্রতিনিধি:   পবিত্র কোরআন শরীফের সর্ব প্রথম বঙ্গানুবাদ কারী গিরীশ চন্দ্র সেনের ১০৩তম মৃত্যু বাষির্কী। ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট এ দিনে ঢাকায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। নরসিংদীর কৃতি সন্তান গিরীশ চন্দ্র সেন কোরআন শরীফ বঙ্গানুবাদ করে সারাবিশ্বে চমক সৃষ্টি করলেও বর্তমান প্রজন্ম এমনকি স্থানীয় লোকজনই ভূলতে বসেছে এ মহান ব্যাক্তিকে। সংরক্ষণ না করায় নিশ্চিহৃ হতে চলেছে নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনার মেহেরপাড়ায় তার পৈত্রিক বাড়ী ও সমাধিস্থল।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর সদর উপজেলার পাচঁদোনার মেহেরপাড়ায় গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর বলতে কেবল চার দেওয়াল। তাও কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে, ছাদটি ধসে গেছে। ভেতরে জমেছে ময়লা আবর্জনার স্তুুপ। দেওয়াল ঘিরে ক্রমেই বেড়ে উঠছে লতাপাতা। ঘরে ঢোকার কোন প্রবেশ পথও এখন আর নেই। ঘরের সামনে একটি রিক্সার গ্যারেজ। তার পাশে সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ও পাঁচদোনা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়।

এলাকাবাসী জানায়, গিরীশ চন্দ্রের ঘর ব্যতীত বাড়ির আশেপাশের সকল জায়গা তাঁর উত্তরসূরীরা বিক্রি করে দিয়েছে। গিরীশ চন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি সংরক্ষণ না করায় নিশ্চিহৃ হতে চলেছে। পাশাপাশি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে শেষকৃত্য স্থানটিও।

এ মহান ব্যক্তি নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা দেওয়ান দর্পনারায়ন নারায়নের বংশে ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গিরীশ চন্দ্র সেনের পিতার নাম মাবধর রাম রায়। তার পিতামহ ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের ভাই দর্পনারায়ণ নবাব মুর্শিদ কুলি খার দরবারের প্রভাবশালী অমাত্য ছিলেন। নবাব তাকে রায় উপাধি প্রদান করেন। হিন্দু পরিবার হলেও তাদের সুনাম-সুখ্যাতি বা প্রভাব প্রতিপত্তির কেন্দ্র বিন্দু ছিল আরবি-ফার্সি ভাষা সংশিষ্ট পাতিত্য জ্ঞান। শৈশবেই গিরীশ চন্দ্র সেন পিতাবিযোগ ঘটে পিতামৃত্যুর পর ১৮৪৬ সালে বড় দাদা ইশ্চরচন্দ্র রায় তাকে ঢাকা ঐতিহাসিক পোগজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। ওই খানে প্রধান শিক্ষকের বেত্রাগাত দেখে গিরীশ চন্দ্র সেন মন বিষিয়ে ওঠে। পরে তাকে আর স্কুল মুখো করানো গেলনা। এ সময়ে তিনি কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য আসেন এবং বিখ্যাত ফার্সি পুস্তুকগুলো পাঠ শেষ করেন। ১৮৫২ সালে বছর বয়সে গিরীশ চন্দ্র সেন ছোট দাদা হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে ময়মনসিংহে চলে যান। প্রকৃতপক্ষে এখানেই তিনি জীবন গড়ার সন্ধান লাভ করেন। বিখ্যাত ফার্সি পুস্তকগুলো সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় ঘটে ১৮৫৩ সালে সংস্কৃতি পাঠশালা ভর্তি হয়ে সংস্কৃতি ভাষায় ঋদ্ধ হন। ১৮৫৭ সালে ২২ বছর বয়সে যুবক গিরীশ চন্দ্র সেন ৯ বছর বয়সের ব্রহ্মময়ী বেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইংরেজী শিক্ষায় অনিহার কারণে তাকে পাঠশালা শেষ করে ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে শিক্ষকতা কাজে যোগ দেন। এ সময় তিনি প্রগস পত্রিকা সংবাদ ও প্রবন্ধ লিখতেন। ১৮৭১ সালে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে গিরীশ চন্দ্র সেন বন্ধু ও মহিলা নামের দু’টি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। মহিলা পত্রিকায় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নিয়মিত লিখতেন। ১৮৭৬ সালে লক্ষৌ যান ৪২ বছর বয়সে তিনি মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ব্যাকরণ শেখেন। এক বছর পর ঢাকা চলে আসেন। ১৮৭৮ সালে বন্ধু জালাল উদ্দিনের মাধ্যমে কোরআন শরীফ কিনে অধ্যয়ন আরম্ভ করেন । ৩ বছর কঠোর সাধনার পর ১৮৮১ সালে প্রথম পারা শেরপুর চারুচন্দ্র প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। পরে কলকাতা বিধান যন্ত্রে মাসিক কিস্তিতে মুদ্রিত হতে থাকে। পরবর্তী ২ বছর পর পুরো কোরআন মুদ্রিত হয়। তার পাশাপাশি অন্যান্য গ্রন্থও প্রকাশ হতে থাকে। তার প্রাকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৩টি। তার মধ্যে বাংলায় পবিত্র কোরআনের অনুবাদসহ ইসলাম ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ ২২টি। রাত দিন পরিশ্রমের ফলে গিরীশ চন্দ্র সেন অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। ১৯০৯ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯১০ সালের ১৫ আগষ্ট ঢাকায় তিনি মারা যান। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী গ্রামের বাড়িতে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

গিরীশ চন্দ্র সেন ছিলেন একজন সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ। তিনি প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করেছেন। নরসিংদী সরকারী কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের মাস্টার্স শেষ বর্ষের এক ছাত্র বলেন, আমরা পাঠ্যপুস্তকে গিরীশ চন্দ্র সেনকে কোরআনের বাংলা অনুবাদক হিসেবে জেনেছি। কিন্তু এ মহান ব্যক্তির বাড়ি নরসিংদীতে হওয়া স্বত্বেও তাঁর জীবন ও কৃতকর্ম সম্পর্কে তেমন জানা সম্ভব হয়নি।

মেহেরপাড়া গ্রামের গিরিশ মিউজিয়ামের সভাপতি ফয়সাল আহমেদ বলেন, গিরীশ চন্দ্রের বাড়ীটির অধিকাংশ জায়গা তাঁর আতœীয় স্বজনারা বিক্রি করে দিয়েছে। ২০০৮ সালে গিরীশ চন্দ্রের বাড়ীতে ভারতীয় হাই কমিশানার এসেছিল। তখন ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব ফান্ড দিয়ে পুরানো বাড়িটির আগাছা পরিস্কার করে দিয়েছিল। সরকার যদি এখনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে গিরীশ চন্দ্রের পৈতৃক বাড়িটি রক্ষা করা যাবে। পাশাপাশি দূর দূরান্ত থেকে আগত মানুষ জানতে পারবে এ মহান ব্যক্তি সম্পর্কে।

নরসিংদী আইডিয়াল হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মন্জিল এ মিল্লাত বলেন, গিরীশ চন্দ্র সেন ছিলেন একজন সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপমহাদেশের প্রখ্যাত গিরীশ চন্দ্র সেনের স্মৃতি রক্ষায় কোন সরকারই উদ্যোগ নেয়নি। গিরীশ চন্দ্র সেনের স্মৃতি রক্ষায় সরকারীভাবে নরসিংদীতে একটি স্মৃতি জাদুঘর নিমার্ণ করা হলে নতুন প্রজন্ম এ মহান ব্যক্তির ইতিহাস জানতে পারবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top