সকল মেনু

যেভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিদের রক্ষায় আলামত নষ্ট করা হয়

আফিফা জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা:  ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাবঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ১৪ বছর আগে নারকীয় গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। যে হামলায় দলটির কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন মারা গিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ। এমন নারকীয় হামলার আলামতও নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দের দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে আলামত নষ্টের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। আসামিদের রক্ষায় কিভাবে মামলার আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয় সেটাও আদালতে চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান আদালতকে বলেছেন। তারপরও রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছে ২২৫ জন সাক্ষীর মাধ্যমে এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা ছাড়াও বিভিন্ন আলামত আদালতে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ ২০১১ সালের ৩ জুলাই আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে তিনি ঘটনার পর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তদন্ত ও আলামত নষ্টসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। অভিযোগপত্রের একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় আসামি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক ডিসি (পূর্ব) মো. ওবায়দুর রহমান খান ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের গ্রেনেড আক্রমণ চালানোর সুবিধার্থে ও রক্ষার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত তাজা গ্রেনেড আলামত হিসেবে জব্দ করার পরও সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেননি। আদালতের অনুমতি না নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে গ্রেনেডগুলো ধ্বংস করিয়েছেন। তাছাড়া আক্রান্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর কাজে বাধা তৈরি করেন। হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা না করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা ও গ্রেফতার করেন। তাদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করে গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পাঠান। ঘটনার পর ইচ্ছাকৃতভাবে হতাহতদের আত্মীয়স্বজন বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে এজাহার না নিয়ে পুলিশকে বাদি করিয়ে মামলা রেকর্ড করিয়েছেন।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ সংলগ্ন পশ্চিম পাশের এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) আসামি খান সাঈদ হাসান এ ঘটনায় জড়িত আসামিদের সহজে গ্রেনেড হামলার সুবিধা করে দিয়েছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি ঘটনাস্থলের পাশে তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভা ও র্যা লির জন্য কোনও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেননি। ফলে ঘটনা ঘটিয়ে আসামিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। উপরন্তু তিনি একটি মিথ্যা ডিউটি প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু কন্ট্রোল রুমের ডায়েরিতে দেখিয়েছেন। ঘটনার পর নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাঠিচার্জ, টিয়ারসেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপের মাধ্যমে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভিকটিমদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া তিনি ঘটনার পরদিন ২২ আগস্ট তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে পাওয়া তাজা আর্জেস গ্রেনেডের বিষয়ে কোনও মামলা করেননি। জেলখানার মতো স্পর্শকাতর স্থানে আর্জেস গ্রেনেডের মতো মারণাস্ত্র পাওয়া গেলেও এই বিষয়ে তিনি কোনও তদন্ত বা অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করেননি। এমনকি জেলখানার ভেতরে ওই স্থানটি পরিদর্শনও করেননি। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া তাজা গ্রেনেডটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ধ্বংস করে আলামত নষ্ট করেছেন।’
তখনকার ডিএমপি কমিশনার ও পরে আইজিপি আশরাফুল হুদা সম্পর্কে সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘তখনকার পুলিশ কমিশনার ও পরবর্তীতে আইজিপি (অব.) আশরাফুল হুদা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাস্থলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ঘটনার দিন তড়িঘড়ি করে বিদেশ চলে যান। আওয়ামী লীগের ওই জনসভার স্থানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়া সত্ত্বেও তিনি বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারকে আওয়ামী লীগের জনসভা ও র্যা লির জন্য সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান। ঘটনার পর তিনি বিদেশ থেকে দেশে ফেরত এসে গ্রেনেড হামলার ঘটনার সময় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের অবহেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রকার বিভাগীয় তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরে কোনও প্রকার প্রতিবেদনও দেননি। আশরাফুল হুদা পরে যখন আইজিপি হন, তখন মুফতি হান্নান ও তার জঙ্গি গোষ্ঠীর অপতৎপরতা সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত থাকার পরও এ মামলার প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের বিষয়ে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশের আইজি ছিলেন শহুদুল হক। তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে প্রতিবাদ সভা ও র্যা লির নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার বিষয়ে কোনও প্রকার খোঁজখবর নেননি। তার অফিস থেকে আনুমানিক ৫০০ গজের মধ্যে ঘটনাস্থল। কিন্তু তিনি ঘটনার পরে কোনও সময়েই ঘটনাস্থলে যাননি। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেফতারের বিষয়ে কোনও প্রকার নির্দেশনা ও উদ্যোগ নেননি। নিরাপত্তার জন্য যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনও প্রকার বিভাগীয় তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। এমনকি ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমান এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে চাইলে তিনি তাকে সেটা করতে দেননি। মুফতি হান্নান ও তার জঙ্গি গোষ্ঠীর অপতৎপরতা সম্পর্কে তিনি আগে থেকে অবহিত থাকা সত্ত্বেও এই মামলায় তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেননি। আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং এসব পারিপার্শ্বিক ঘটনায় সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তারা পরস্পর যোগাসাজসে ইচ্ছাকৃতভাবে মূল আসামিদের প্রশাসনিক সহায়তা দিয়েছেন। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিরত থেকে তাদের নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ ও অপরাধের দায় থেকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ অভিযোগপত্রের আরেকটি অংশে উল্লেখ করেন, ‘গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের প্রথম পর্যায় থেকে মুফতি হান্নানসহ অন্যান্য অপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। এ লক্ষ্যে মুফতি হান্নান ও তার অন্যান্য সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনও প্রকার তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণ না করে জজ মিয়া নামক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে মিথ্যা ও বানোয়াট স্বীকারোক্তি তৈরি করে আদালতে লিপিবদ্ধ করানো হয়। ২০০৫ সালের ৫ অক্টোবর র্যা ব সদস্যরা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সীকে গ্রেফতার করে। তখন জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী সব গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে তার সহযোগীদের নাম প্রকাশ করে। তারপরও তাকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তার অন্যান্য সহযোগীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়নি। উপরন্তু মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী গ্রেফতার হওয়ার পরও জজ মিয়ার মিথ্যা বানোয়াট স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিল রেখে এই মামলার আসামি আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। ২০০৫ সালের ১৬ নভেম্বর তাদের মিথ্যা ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করানো হয়। মুফতি হান্নান গ্রেফতার থাকার সময় আসামি শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল গ্রেফতার হয়। মুফতি হান্নানের কাছ থেকে শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল গ্রেনেড সংগ্রহ করে ২০০৪ সালে সিলেটে আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড আক্রমণের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়।’
‘মুফতি হান্নান ও বিপুলের স্বীকারোক্তির পরও তখনকার সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি (পরবর্তীতে আইজিপি) আসামি খোদা বক্স চৌধুরী, বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মন্সী আতিকুর রহমান মামলার প্রকৃত আসামিদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের এই মামলায় গ্রেফতার দেখাননি। অন্যান্য বোমা ও গ্রেনেড হামলার ঘটনায় স্বীকারোক্তি নেওয়া সত্ত্বেও এই মামলার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবব্ধ করাননি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার আগে থেকে আসামি মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ও তার জঙ্গি গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এসব আসামির ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তারা আগে থেকে জানা সত্ত্বেও তাদের গ্রেফতারের কোনও চেষ্টা করেননি। মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা না করে ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘পরবর্তীতে এ মামলার তদন্তের সময় মুফতি আব্দুল হান্নান গ্রেফতার হওয়ার পর তার দেওয়া জবানবন্দিতে সে স্বীকার করেছে যে, নির্বিঘ্নে গ্রেনেড হামলা চালানোর জন্য তারা (মুফতি হান্নান গং) প্রশাসনিক সহায়তা পেয়েছে। এই মামলার গ্রেনেড সরবরাহকারী হিসেবে মাওলানা তাজউদ্দিনের নাম তার তদন্তকালে প্রকাশ পায়। তাকেও এই মামলায় গ্রেফতারের কোনও পদক্ষেপ নেননি তারা। উক্ত কর্মকর্তাদের কর্মকান্ডে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা আগে থেকেই জানতেন যে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীরা প্রশাসনিক সহায়তায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেছে।’
‘পরবর্তীতে এ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পিএস-২ লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিউকের ভায়রা ভাই ডিজিএফআই-এর সিটিআইবির জিএসও-১ লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার এবং সিটিআইবির ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন পরস্পর যোগসাজসে মূল অপরাধীদের রক্ষার জন্য বাদল নামীয় পাসপোর্ট দিয়ে মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাদল নামে পাসপোর্ট দিয়ে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top