সকল মেনু

যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছি জীবনকে: ড. হাছান মাহমুদ

images (14)‘জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছি। যুদ্ধের ময়দানে যেমন সৈনিক লড়াই করেন, ছিটকে পড়েন অনেক সহযোদ্ধা। আহত বা নিহত হন, কিংবা হারিয়ে যান যুদ্ধের ময়দান থেকে। তারপরও অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হয়। পরাজয় কিংবা বিজয় একটা কিছু আসে। আমি মনে করি, রাজনীতির অঙ্গণও একটি যুদ্ধক্ষেত্র।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

দেশের রাজনীতিতে আলোচিত, প্রভাবশালী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। বিদেশে পড়ালেখার সময় প্রবাসেও ছাত্রলীগের যুক্ত ছিলেন তিনি। দেশে ফিরে অধ্যাপনার পাশাপাশি দায়িত্ব পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান। প্রথমবারের মত রাঙ্গুনিয়ায় নির্বাচনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে এমপি হন। প্রতিমন্ত্রী থেকে এখন পুর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বে ড. হাছান মাহমুদ।
সাম্প্রতি এই মন্ত্রী তার জীবন, রাজনীতি, শিক্ষকতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন রাইজিং বিডি’র সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন রাইজিং বিডি’র চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান রেজাউল করিম।

রাজনীতিতে অভিষেক প্রসঙ্গে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমার বাবা প্রয়াত এডভোকেট নুরুচ্ছফা তালুকদার আওয়ামী লীগ করতেন। নিজ গ্রাম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে আমার বাবা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি রাঙ্গুনিয়া থানা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও ছিলেন।
‘মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও আমার বাবা। ছোটবেলা থেকে বাবাকে রাজনীতি করতে দেখেছি। যুদ্ধের সময় ভীবিষিকা দেখেছি। বাবাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে দেখেছি। চোখের সামনে আমাদের বসতবাড়ি পুড়ে যেতে দেখেছি। আমার তিন বোন। সবার বড় বোন জন্ম হয়েছে, যখন আমরা ঘরবাড়ি ছাড়া। উদ্বাস্তু হয়ে ভিন্ন গ্রামে আরেকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। মূলত রাজনীতির পরিমন্ডলে আমার বেড়ে উঠা।’

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হই ১৯৭৯ সালে। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হই সে বছরই। মহসিন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই ১৯৮০ সালে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে ভর্তির আগে অবশ্য মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক ছিলাম। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য মনোনীত হই। ১৯৮৬ সালে সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পাই। ১৯৮৮ সালে হই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি।

‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করি। ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারিনি ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায়। সে সময় পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছি না আমি। ওই নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই ছাত্রঐক্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম আমি।

‘১৯৯১ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী হই। সেই বছর ২৮ বছরে পা দিয়েছিলাম। বয়স নির্ধারন করে দেয়ায় ছাত্রলীগ করতে পারি নাই। প্রথমবারের মতো ছাত্রলীগে সে নিয়ম চালু হয়। ছাত্রলীগের সম্মেলনের কিছুদিন পরে ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মনোনীত হই। কমিটিতে আমিই ছিলাম বয়সে সবচেয়ে ছোট।’

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। সে বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাসেলস হয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলেন। বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিমান বন্দরে আমরা তাঁকে সংবর্ধনা জানাই। বিমান বন্দরে তখন তাঁকে বললাম, আমার লেখাপড়া অনেক হয়েছে। দেশে রসায়নে মাস্টার্স, বিদেশে এসে হিউম্যান ইকোলজি ও আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। আপা আমি এখন দেশে ফিরে যেতে চাই। দেশে আমাকে একটা ছোটখাট কাজে লাগিয়ে দিন। তখন তিনি বললেন, তুমি পিএইচডি করোনি। পিএইচডি করে আসো। পিএইচডি করে আসলে ছোট নয়, অনেক বড় কাজে লাগিয়ে দেব। পিএইচডি করে না আসলে তুমি তোমার চেস্টায় যা পার সেটা করবা। আমার কোন সাহায্য সে ক্ষেত্রে পাবেনা। তখন আমি তাঁকে বললাম, পিএইচডি করতে ৪ বছর সময় লাগবে এবং এই সময়ে রাজনীতিতে আমি পিছিয়ে পড়বো। প্রধানমন্ত্রী তার পরও আমাকে পিএইচডি করতে বলেন। বেলজিয়ামে এনভায়রনমেন্ট কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করি। সেখান থেকে ২০০১ সালে আমি দেশে ফিরি। সে বছর নভেম্বরে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বিশেষ সহকারি নিয়োগ দেন। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক করেন। এভাবে যুক্ত হই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে।

ড. হাছান মাহমুদ তার নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছাত্র জীবন থেকে রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানে বিভিন্ন কলেজ, এলাকার নানা অনুষ্ঠানে আমি যেতাম। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া থেকে নমিনেশনও চেয়েছিলাম। তখন সভানেত্রী আমাকে বলেছিলেন, এখন বয়স কম, তোমাকে পরের বার দিব। দেশে ফেরত আসার পর রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি।’

রাজনীতি ও মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিয়ে এখন দারুন ব্যস্ত সময় পার করেন ড. হাছান মাহমুদ। প্রতি সপ্তাহে তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় যান। পরিবারকে আগের মতো সময় দিতে পারেন না। এতে আক্ষেপ থাকে সন্তানদের।
ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একদিন তাঁর ছোট মেয়ে আবিরা নাওয়ার মাহমুদকে তার স্কুলের শিক্ষক বাবাকে নিয়ে রচনা লিখতে বলেন। তখন সে লিখেছে, বাবা খুব ভাল। আমার বাবা আমাকে খুব আদর করেন। আমিও আমার বাবাকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমার বাবা মন্ত্রী এটা আমি পছন্দ করি না। আমার বাবা আগে আমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। মন্ত্রী হওয়ার আমি যখন স্কুলে সকাল ৭টায় চলে যাই, তখন আমার বাবা বিছানায় থাকেন, আর যখন আমি রাত ১১টায় ঘুমাতে যাই, তখন আমার বাবা মানুষজনের সাথে নিচের তলায় থাকেন। সুতরাং আমার বাবাকে আর দেখিনা।’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বেলজিয়ামে পড়ার সময় প্রথম বছরে সীমিত স্কলাশিপ পাই। এ দিয়ে আমার ঘর ভাড়া ও খাবার দাবার চলতো। তারপরও আমি বাড়তি আয়ের জন্য ছুটির দিন কাজ করতাম। সঞ্জয় বাবু নামে দিনাজপুরের এক সহপাঠি ছিল। সে আর আমি এক সাথে থাকতাম। একদিন ছুটির দিনে আমরা দু’জন একটি মেলায় সেল্সম্যানের কাজ খুঁজতে গেলাম। কেউই কাজ দিল না। কারণ সবার সেল্সম্যান আছে।
মেলায় এক বয়স্ক মহিলা বললন, আমার সেল্সম্যান লাগবে না। তোমরা একটা কাজ করো ট্রাকে করে আমাদের যে মালগুলো আসবে, সেগুলো আনলোড করতে পার। আমি আর সঞ্জয় বাবু শেষ পর্যন্ত এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশ কয়েক সপ্তাহ আমরা ট্রাকে মাল লোড-আনলোড করেছি। এছাড়া ছুটির দিনে পিজারিয়া, মেকডোনাল্ডসেও কাজ করেছি।’

বিয়ে সংসার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিয়ে পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু রাজনীতি করি-এ কথা শুনে বিয়ে কয়েক দফা ভেঙ্গে দেয় পাত্রী পক্ষ। বিয়ের জন্য বেলজিয়াম থেকে দু’দফা বাংলাদেশে আসি। কিন্তু বিয়ে না করেই ফেরত যেতে হয়েছে। তৃতীয় দফায় বাংলাদেশে এসে বিয়ে হয়।’
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিদেশে থাকাকালীন আমার পরিকল্পনা ছিল দেশে ফিরে রাজনীতি এবং পাশাপাশি শিক্ষকতা করবো। বেলজিয়ামে পিএইচডি করাকালীন দেশে আমার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল। যারা আমাকে পছন্দ করেছিল, অনেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, পিএইচডি শেষ করে দেশে এসে আমি কি করবো? তখন আমি অকপটে বলেছি, দেশে এসে রাজনীতি ও অধ্যাপনা করবো। পাত্রী পক্ষের অনেকে ভবিষ্যতে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনীতির অঙ্গণে আমি প্রবেশ করবো সে আশঙ্কায় পিছিয়ে যায়। পরে মা আমাকে বলেছিলেন, ‘পাত্রী পক্ষ তোর কাছে ভবিষ্যতের জিজ্ঞেসা করলে তুই দয়া করে রাজনীতি করবি এটা বলিস না। এ অবস্থায় আমি তৃতীয়বার দেশে এসে বিয়ে করতে সমর্থ হই। এ সময় পাত্রী পক্ষ রাজনীতির কথা জিজ্ঞাসা করেনি।’

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বেলজিয়ামে লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরি। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারির দায়িত্ব পাই। পাশাপাশি ঢাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। সেখানে আমি এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ও বাংলাদেশ স্টাডি পড়াতাম। গত ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই মাস আগ পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করি। মজার বিষয় হচ্ছে- যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতাম তখন আমার কথাবার্তায় কাউকে বুঝতে দিতাম না, দেশের রাজনীতিতে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাকে টেলিভিশনে দেখে ছাত্রদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে চাইলেও আমি কখনো তাদের সেই সুযোগ দিতাম না। শিক্ষক হিসেবে সব সময় চেস্টা করেছি, আমি যে রাজনীতির মানুষ সেটা একদমই প্রকাশ পায়নি। শিক্ষকতায় রাজনীতির কোন প্রভাব পড়ুক সেটা কখনো চাইনি। নির্বাচনের পর যখন মন্ত্রী সভায় স্থান পেলাম, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি আমার সম্মানে সংবর্ধনা সভা করেছিল। সভায় ছাত্ররা বলেছেন, স্যারকে সব সময় টেলিভিশনে দেখতাম, তিনি যখন পড়াতেন তখন রাজনীতিরও সমালোচনা করতেন মাঝে মাঝে। পাঠদানে রাজনীতিবিদ প্রভাব থাকতো না।’

রাজনীতি, শিক্ষকতা এবং মন্ত্রীত্ব এসবের পিছনে পরিবার ও জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেন ড. হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘কলেজে যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন আমার বাবা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাতে আমি রাজনীতি না করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতি থেকে পিছুপা হয়নি। বাবাও আর বাধা দিতেন না। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে কোতোয়ালী থানা হাজতে রাখা হয়েছিল। আমার জন্য কিছু বইপুস্তক পাঠাতে বাসায় খবর পাঠিয়েছিলাম। বাবা আমার জন্য বেশকিছু বই পাঠিয়েছিলেন। একটি বই ছিল ‘বিখ্যাত কারাবন্দীদের জীবন’। আমার বাবা যদি আইনজীবি না হয়ে ব্যবসায়ী হতেন। তাহলে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে আমাকে ব্যবসার হাল ধরতে হতো। সরকারি চাকরিজীবি হতেন, তিনি অবসর গ্রহণ করার পর আমাকে পরিবারের হাল ধরতে হতো। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পরও আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, কখনো পরিবারের খবর আমাকে রাখতে হয়নি। বাবা পরিবারের হাল ধরেছিলেন। আরেকজন হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। যার উৎসাহ ছাড়া আমি কখানো পিএইচডি করতে পারতাম না। অনেকটা জোর করে তিনি পিএইচডি করিয়েছেন।’

শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারির দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছি। যুদ্ধের ময়দানে যেমন সৈনিক লড়াই করেন, ছিটকে পড়েন অনেক সহযোদ্ধা। আহত বা নিহত হন, কিংবা হারিয়ে যান যুদ্ধের ময়দান থেকে। তারপরও অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হয়। পরাজয় কিংবা বিজয় একটা কিছু আসে। আমি মনে করি, রাজনীতির অঙ্গণও একটি যুদ্ধক্ষেত্র।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিরোধীদলের নেত্রীর বেশ কয়েকজন বিশেষ সহকারি ছিলেন। তার মধ্যে ২জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গা ঢাকা দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু আমি মনে করেছি আমার দায়িত্ব নেত্রীর পাশে দাঁড়ানো। সত্যকে প্রকাশ করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সেজন্য গ্রেপ্তার নিশ্চিত জেনেও আমি দায়িত্ব পালন করে গেছি। এমনকি সে সময় জানতাম আমাকে যে কোন মুহুর্তে গ্রেপ্তার করা হবে। এজন্য আমার ব্যাগে একটা লুঙ্গি, শার্ট, টাওয়েল, টুথপেস্টসহ প্রয়োজনীয় ঔষধ থাকতো। প্রতিদিন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে বাসায় ফিরতাম। আমার স্ত্রীকে বলতাম আজকে হয়তো পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ পায়নি পুলিশ।’

২০০৭ এক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জুন মাসের ২৭ তারিখে আমার ছোট ছেলে সাফওয়ান আরহাম মাহমুদের জন্ম। নেত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন পরে আমার শ্বাশুড়ি নবজাতক সন্তানকে দেখার জন্য ঢাকার বাসায় যান। চট্টগ্রাম থেকে মেহমানরা গেছেন সেজন্য বাসায় ভাল খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। রাতে আমি বাসায় খাচ্ছি। সে সময় এক সাংবাদিক (একটি বিশেষ সংস্থার পত্রিকা) আমাকে ফোন করলেন। আপনি কোথায়? আমি বুঝতে পারলাম- আমার অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তখন ওই সাংবাদিক বললেন, আপনাকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? আমি বললাম- না, অন্য জায়গায় আছি। তখন আমি খাবার ফেলে অন্ধকারে বেরিয়ে যাই। খাবার টেবিল থেকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার এড়াতে আমি প্রায়ই বাইরে রাত কাটাতাম। আরেকদিন বাসায় এসেছি। স্ত্রীকে বললাম-যা ঘটুক না কেন, আজকে বাসা থেকে যাব না। স্ত্রী সারারাত পাশে বসে নামাজ পড়েছে, আল্লাহকে ডেকেছে, যাতে আমি গ্রেপ্তার না হই। তার ধারণা ছিল। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।’
নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন প্রসঙ্গে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিগত সাড়ে ৪ বছরের বেশি সময় হলো। আমি রাঙ্গুনিয়ার মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। একজন এমপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা যেগুলো- আমি পূরণের চেষ্টা করেছি। এমপি হওয়ার পর আমি যেন ‘এমপি সাহেব’ হয়ে না যাই সেই দিকেও খেয়াল রেখেছি।
‘এমপি হওয়ার আগে আমি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম। তখন আমি মানুষকে যেভাবে সময় দিতাম, এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার পর তারচেয়ে বেশি সময় দিই। আমি দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে আছি। তারপরও আমি প্রতি সপ্তাহে এলাকায় যাই। অথচ এলাকার চেয়ারম্যানও প্রতি সপ্তাহে এলাকায় যায় না। বিগত ৩৫ বছরে রাঙ্গুনিয়ার উন্নয়ন যত হয়নি, গত সাড়ে ৪ বছরে তারচেয়ে বেশি হয়েছে।
‘এ সরকারের আমলে রাঙ্গুনিয়ায় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার দুই হাজারের বেশি মানুষের চাকরি হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ায় ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার ক্যাবল কারসহ দেশের প্রথম পক্ষীশালা স্থাপিত হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে তা উদ্বোধন হবে ইনশাল্লাহ। রাঙ্গুনিয়ায় বন্ধ দু’টি পাটকল আমরা চালু করেছি। রাঙ্গুনিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করেছি। আমাদের দলের কেউ হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছি। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য আমার দুয়ার খোলা রেখেছি। রাঙ্গুনিয়ার মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে কে কোন দলের সেটি মাথায় রাখিনি। যে আমার কাছে এসেছে। আমি তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। সুতরাং রাঙ্গুনিয়ার মানুষের কাছে আমার প্রত্যাশা আরও বেশি। তাদের দুয়ারও যেন আমার জন্য খোলা রাখেন। রাঙ্গুনিয়ার মানুষের কাছে আমার আরো একটি আবেদন, আমিও মানুষ। আমার কিংবা দলের নেতাকর্মীদের যদি কোন ভুলত্রুটি থাকে তা যেন ক্ষমা করে দেন।’

ড. হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৩ সালের ৫ জুন জন্ম নেন। বাবা এডভোকেট মরহুম নুরুচ্ছফা তালুকদার। তিনি (নুরুচ্ছফা তালুকদার) দীর্ঘ কর্মজীবনে চট্টগ্রাম জেলা ও পার্বত্য জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মা এডভোকেট কামরুন্নাহার বেগম একজন মানবাধিকার কর্মীও। মানবাধিকার সমিতি, চট্টগ্রামের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ড. হাছান মাহমুদের বয়স যখন ৭ বছর, তখন তাঁর মা নুরনাহার বেগম ইন্তেকাল করেন। মায়ের ইন্তেকালের পর মায়ের ছোট বোন এডভোকেট কামরুন্নাহার বেগম তাঁকে লালনপালন করেন।
৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ২ কন্যা ও ১ পুত্রসন্তানের জনক। বড় মেয়ে নাফিসা জুমাইনা মাহমুদ। ছোট মেয়ে আবিরা নাওয়ার মাহমুদ। একমাত্র ছেলে সাফওয়ান আরহাম মাহমুদ। ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলে যথাক্রমে ষষ্ঠ, তৃতীয় ও কেজি টু’তে লেখাপড়া করছে। তাদের মা নুরান ফাতেমা একজন গৃহিনী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top