সকল মেনু

খুলনাজুড়ে তীব্র হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট

মেহেদী হাসান, খুলনা প্রতিনিধিঃ  গ্রীষ্মের দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলনাজুড়েই শুরু হয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট। কিন্তু পানির প্রয়োজন তো অন্য কিছুতে মেটানো সম্ভব নয়। তাই, যেভাবেই হোক সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনের তাগিদেই ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের পানযোগ্য এক কলসি পানির জন্য ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে কাক্সিক্ষত পানি। আর যারা ক্লান্ত শরীরে দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে না পারছেন তাদের নগদ টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাবার পানি। এভাবেই গ্রীষ্মে পানি সংগ্রহে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে, খুলনা নগরের ডিপ টিউবওয়েল ফেল করেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা মোটর ছেড়েও পানি উঠছে না। ফলে বাধ্য হয়ে আরও অধিক শক্তিশালী সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর হিড়িক পড়েছে। পানি সংগ্রহের এ যুদ্ধ সহসা মিটছে না- বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনায় কৃষি কাজের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। ফলে পানির স্তর (লেয়ার) নিচে নেমে গেছে। এ কারণে গ্রামের অধিকাংশ ডিপ-টিউবওয়েলেই (নলকূপ) পানি উঠছে না, পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। লবণাক্ততায় পুকুরের পানিও পানের অযোগ্য। ফলশ্রুতিতে সুপেয় পানির অভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছে ডুমুরিয়া উপজেলার ৭নং শোভনা ইউনিয়নটি। ৪০ হাজার জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ এ ইউনিয়নে মোট ভোটার রয়েছে ১৮ হাজার। কিন্তু চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচ- খরা ও কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প স্থাপনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠেছে না। গৃহস্থালির কাজে পুকুর, নদী ও খালের লবণাক্ত পানি ব্যবহৃত হলেও বাদুরগাছা ও বাগাছড়াসহ প্রতিটি গ্রামেই সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য এলাকা থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। স্থানীয় ইউপি সদস্য দেবব্রত সরদার বলেন, শোভনা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে ৫০টির অধিক গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের গভীরতা অন্তত ৫৩০ ফুট। কিন্তু বর্তমানে মাত্র একটি নলকূপে পানি উঠছে। বাকীগুলোতে পানি উঠছে না। ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলা বাজার থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে, অথবা সেচ পাম্প থেকে ৫০ লিটার পানি ২০ টাকা দরে কিনে আনতে হচ্ছে। ফলে জনসাধারণের ভোগান্তির শেষ নেই। পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ওয়ার্ডের বাদুরগাছা ও বাগাছড়া গ্রামের ১৫টি ডিপ টিউবওয়েলের একটিতেও পানি উঠছে না। জনদুর্ভোগ এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেক দূর থেকে মহিলাদের খাওয়ার পানি/জল আনতে হচ্ছে। এটা খুবই কষ্টসাধ্য। ধানে পানি দেওয়ার স্যালো বোরিংগুলোতেও পানি উঠছে না। শিগগিরই বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। সঙ্কট উত্তরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
বাদুরগাছা গ্রামের গৃহবধূ স্বপ্না ম-ল বলেন, ‘উত্তরপাড়ায় ডিপ-টিউবওয়েলে (নলকূপ) পানি উঠছে না। তাই দুই গ্রাম ডিঙ্গিয়ে দক্ষিণপাড়ায় পানি নিতে এসেছি। কিন্তু এখানেও টিউবওয়েলে ভালো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এক কলস পানি ভর্তি করতে সময় লেগে যাচ্ছে আধা ঘন্টা। চাপতে চাপতে ক্লান্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না’। স্থানীয় বাসিন্দা স্বর্ণা রায় বলেন, ‘পানির কষ্টে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগে দুই থেকে তিন মিনিটে একটি কলস ভর্তি করা যেত। কিন্তু এখন আধা ঘন্টায়ও কলস ভরা সম্ভব হচ্ছে না’। ঢাকায় অবস্থানরত স্থানীয় বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবি আলী বাদশা বলেন, সম্প্রতি তিনি স্ব-পরিবারে গ্রামে বেড়াতে যান। কিন্তু সুপেয় পানি সঙ্কটের কারণে তার শিশু কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে একদিন থেকেই ফিরে যান তিনি। তিনি বলেন, ‘সত্যিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শোভনায়। জিয়ালতলা ও শোভনার বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে মিষ্টি পানি উত্তোলন করায় ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এসব গভীর নলকূপ বন্ধের পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর হবে। তিনি মাছ চাষে অতিমাত্রায় মিষ্টি পানির ব্যবহার বন্ধের আহবান জানান।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক হাসান বলেন, শোভনা ইউনিয়নে পানি সঙ্কটের খবর তিনি জানেন না। তবে পানির এ সমস্যা সাময়িক। বৃষ্টি হলেই সমাধান মিলবে। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে, গ্রীষ্মের শুরুতেই খুলনা মহানগরীতে পানির সঙ্কট শুরু হয়েছে। তাপদহ, খরা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় নগরজুড়েই সাব মার্সিবল মেশিন বসানোর হিড়িক পড়েছে। এ ক্ষেত্রে আইন থাকলেও প্রভাবশালীদের দাপট ও পানি সরবরাহের মানবিক দৃষ্টি থেকে তা নজরদারী থেকে শিথিল রয়েছে ওয়াসা।
খুলনা ওয়াসার ডিএমডি এমডি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেবল সাব মার্সিবলই না, নলকূপ স্থাপন করার ক্ষেত্রেও ওয়াসার অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন ও বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পদক্ষেপ ও মানবিক বিবেচনায় শিথিল থাকতে হচ্ছে। নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করার পদক্ষেপ সম্পন্ন করার পরই এ বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top