সকল মেনু

বই পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে নবীন প্রজম্ম, ভবিষ্যৎ অন্ধকার

images (2)প্রদীপ কুমার সরকার, ভ্রাম্যমান, প্রতিনিধিঃ- বই হচ্ছে সভ্যতার বাহন। জাতির ইতিহাস , সংস্কৃতি পুস্তুকের মধ্যে ধারণ করে। মানব সৃষ্টির আদিকাল হতেই মানুষের জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর তা সংরক্ষণ করা জ্ঞান, জ্ঞান বিতরণ করা পুস্তুকের মধ্যেই সম্ভব হয়ে থাকে। আমরা অর্থাৎ জাতি শিক্ষিত হওয়া মানে কি? অর্জিত জ্ঞান সভ্যজাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে, মূল্যবোধ, শিল্প-সংস্কৃতি, প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন সবই তো পুস্তুক পড়ার মাধ্যমে অর্জন করি। বই পড়া নিয়ে অনেক মনিষী অনেক মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য গ্রন্থকার বলেছেন-জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন তা হচ্ছে বই, বই এবং বই। বাংলা সাহিত্যের আরেক স্বনামধন্য রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বই কেনা প্রবন্ধে কি সুন্দর করে বলেছেন-আমরা বাঙালি মনে হয় সেই গল্পটা জানি যেখানে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় বিষ মিশিয়ে দেওয়ার পর মৃত্যু হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা ও তার পবিত্র কালামে প্রথমেই তার সৃষ্টির প্রতি পড়ার আহবান জানিয়েছেন। অন্যদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের জীবনও পাল্টে যাচ্ছে। হৃদয়ের সুকোমল অনুভূতি গুলো কেমন যেন ভোতা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নবীন প্রজম্মের অধিকাংশই পুস্তুক পাঠের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের হাতে আজ শোভা পাচ্ছে দামি মোবাইল সেট, কম্পিউটারে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেট নিয়ে ডুবে থাকছে। আজকার তরুনদের হাতে শোভা পায় না রঙিন কবিতার বই। প্রিয়জনকে খুশি করার জন্য লিখেনা দুছত্র কবিতার লাইন। তার চেয়ে বরং অশ্লিল ভাবে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠালেই শেষ। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের প্রজম্ম কেমন হয়ে যাচ্ছে। তৈরী হচ্ছে শিক্ষা সংস্কৃতিহীন একটি ধর্ম বিবর্জিত একটি জাতি গোষ্ঠী। বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মনীষী প্রমথ চৌধুরী বলেছেন-আমাদের শিক্ষিত সমাজের লোলুপ দৃষ্টি আজ অর্থের উপরে উপরেই পড়ে রয়েছে। সুতরাং সাহিত্য চর্”ার সুফল সমন্ধে আমরা অনেকেই সন্দিহান। যারা হাজারখানা ল’ রিপোর্ট কিনেন, তারা একখানা কাব্য গ্রন্থ কিনতেও প্রস্তুত নন। কেননা তাতে ব্যবসার কোন সুযোগ নেই। এখন অনেকই ঠাট্টা করে বলেন কবিতা, গল্প কি খেতে দেয়, কবিরা শেষ জীবনে না খেয়ে মরে। তাই কবিতা দিয়ে কি হবে। একজন কবি তার একটি কবিতা লিখতে ব্যয় করেছেন কত সময়, কাটিয়েছেন কত বিনিদ্র রজনী। অথচ আমরা জাতি হিসাবে এত দুর্ভাগা যে, কত সাধনার ফলে কথার মালা সাজিয়ে যিনি আমাদের আগামী জীবনের সোপান গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অথচ আমরা তার লেখাটা পড়তেও দ্বিধাবোধ করি। এখন একজন আইনজীবী তিনি হাজারটা আইনের বই কিনে নেন, তিনি একটি কাব্যগ্রন্থ কিনতে দ্বিধাবোধ করেন। কারণ তাতে তার ব্যবসা হবেনা। জগতে যারা সৃষ্টিশীল কিছু তৈরী করেছেন তার বিনিময়ে কিছু আশা করেননি। একজন কবি না খেয়ে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে একটি কাব্য লিখে ব্যবসার আশা করেন না। বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো আমি কারো খাটো না করেই বলছি আমার সাথে অনেক উচ্চশিক্ষিত লোকের সাথে সাক্ষাতে তারা বাংলার বিখ্যাত কবি জসীম উদ্দিন, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কায়কোবাদ, বন্দে আলী মিয়া কয়টি কাব্য লিখেছেন তা বলতে পারেন না। আমি বই কিনার জন্য কয়েকটি স্বনামধন্য বইয়ের দোকানে কবিতার বই চাইলে বিক্রেতা বলেন যে, ভাই এখন কেউ কাব্য পড়েন না। তাই প্রকাশকই প্রকাশ করেন না। কি সাংঘাতিক কথা আমরা নতুন অপুংশক জাতি হিসাবে পরিণত হচ্ছি। আমাদের স্কুল, কলেজের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন সেখানে ছেলে-মেয়েদের বিদ্যা গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক, এর ফলে ছেলেরা শারিরীক ও মানুষিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বল বৃদ্ধির প্রধান উপায় বলে মনে করেন। গোদুগ্ধ অবশ্য অতি উপাদেয় পদার্থ। কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করার শক্তির উপর নির্ভর করে, এ জ্ঞানও শ্রেনীর মাতৃকূলের নেই। তাদের বিশ্বাস এ বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। বর্তমান বাড়ীতে ঐ পদ্ধতি আরো কঠোরভাবে বলবৎ করা হয়েছে। এ যুগের পিতা-মাতারা পড়ার ব্যাপারে আরো সিরিয়াস হয়েছেন। তাই এদের গল্পের বই পড়ার সময় কই। মহামারীর মতো গ্রাস করছে শিশু কিশোর যুবাদের টিভি সিরিয়ালে। আসক্ত হয়ে পড়ছে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি চর্চার। নীতির কথা আদর্শের কথা, সংস্কৃতির কথা, বিবর্জিত হচ্ছে। তাই এ যুগের কিশোর কিশোরী যুবারা তাদের অভিভাকরে কথা শুনতে চায় না । আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে কিশোর বয়সেই পরিচিত হচ্ছে পর্ন দৃশ্য দেখার। যৌবনের প্রথম সোপানেই ঢুকে যাচ্ছে নগ্নতা, নবীন প্রজম্মের জীবন মরুভূমিতে রূপান্তির হচ্ছে। এক সময় পাড়া মহল্লার শিক্ষিতরা বটেই অক্ষর জ্ঞান সম্পন্নরাও বইয়ের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কোন লেখকের কোন কই তা নিয়ে আলোচনা চলত। এক সময় বই পড়াই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম । খেলাধুলার মত এট্ওা ছিল অন্যতম একটি শখ। বই পড়ে অনেকে বিনিময়ও করত। আমরা এক সময় দেখতাম গ্রামে গঞ্জে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী যেত তা থেকে পাঠকরা উপকৃত হত। আজকালকার যে কোন যুবকের হাতে কুরুচিপূর্ণ ম্যাগাজিনই বেশী শোভা পায়। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়নের সুবাদে বিগত এক দশকের জীবনধারা এমন দ্রুত পাল্টে গেছে যে, বিগত ৫০ বছরেও এমন হয়নি। এক সময় যুবকরা মিলে ক্লাব খুলত যেখানে শোভা পেত হরেক রকমের বই। আমাদের গ্রামের কাছে মালীগ্রাম বিদ্যালয়ের নামে একটি এনজিও কেন্দ্রীক পাঠাগার ছিল-বিকাল বেলা সবাই গিয়ে ভীড় করত বই পড়ার জন্য। সাম্প্রতিক একদিন গিয়ে দেখি কোন রকম জরাজীর্ণ দৈন্যদশা নিয়ে পাঠাগারটি টিকে আছে। কেয়ার টেকার জানালেন-এখন পাঠক সংখ্যা এখানে নেই বললেই চলে। তাছাড়া এখানে শিক্ষার্থীদের ছাড়া সর্ব সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যে কোন সময় এটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শুনে এক বুক দুঃখ পেলাম, আমাদের পরবর্তী প্রজম্ম এখন কি চরিত্রহীন মেধাহীন জাতি হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের সামজিক জীবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে বড় বড় ডিগ্রী নিলেও তাদের মধ্যে নৈতিকতা চরম ভাবে বিবর্জিত হচ্ছে। নৈতিকতা চরম অবক্ষয়ের ফলে এমন দাড়িয়েছে যে, আজ পুত্র পিতা-মাতাকে লাঞ্চিত করা তো মামুলি ব্যপার খুন হচ্ছে যত্রতত্র। পত্রিকার পাতা খুললে গা শিউরে উঠে। সম্প্রতি মিডিয়ার কল্যানে আমরা জানতে পেরেছি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠেও ছাত্রের হাতে কিভাবে বেধড়ক পিটুনী খেয়ে শিক্ষকরা কোন উচ্চবা”্য করছে না। শিক্ষককে পিটিয়ে শিক্ষার্থী নামধারী কুলাঙ্গররা রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় বুক ফুলিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এ দুঃখ ঘৃনা জানানোর ভাষা জানা নেই। যারা জ্ঞানের আধার জ্ঞানের পসরা বিলিয়ে দেন যিনি নতুন দিন রচনার মানসে। যিনি মানুষ গড়ার কারিগর তিনিই অবাঞ্চিত। এজন্য তো মুল্যবোধ হীনতা দায়ী। আজ যিনি মানুষ গড়ার দায়িত্বে নিচ্ছেন তার মধ্যে কতটুকু নৈতিকতা মূল্যবোধ আছে। আজ মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষকদের মধ্যেও ইভটিজিং। পত্রিকার কল্যানে জানা গেছে প্রায়ই ইভটিজিংয়ের, ধর্ষনের অভিযোগে শিক্ষক জেলে ঢুকছে। অনেক চরিত্রহীন শিক্ষকের লালসার শিকার হয়ে অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থী জীবনের প্রথমেই চোরাবালিতে পা দিচ্ছে। যখন বুঝতে পারে তখন জীবনের সামনে দেখে অনাবিল অন্ধকার। এজন্য আগামী দিনগুলো সে অভিশাপ নিয়ে কাটিয়ে দেয়। আজকাল বেশীর ভাগ শিক্ষকই বাস্তব বিবর্জিত মেধাহীন স্তম্ভ। জ্ঞান ফেরী করে বেড়ান যিনি তার নিজেরই জ্ঞান নেই। এর অন্যতম কারণ পুস্তুকে মূল্যবোধ জাগ্রত না হওয়া । একাডেমিক ভাবে যারা বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছেন সত্য কিন্তু তার মধ্যে মূল্যবোধ নৈতিকতা প্রতিফলিত হয়নি। আমার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের সাথে কথা হচ্ছে যাদের মধ্যে সাহিত্যের ন্যুনতম ধারণাও নেই। গ্রামীন জীবন ধারা এক দশকের পাল্টেছে দারুনভাবে। লেখা পড়া শিখাকে তারা সময়ের অপচয় বলে মনে করে। তার চেয়ে বরং প্রবাসে পাঠিয়ে দিলে টাকা পয়সায় ফুলে ফলে ফেঁপে উঠবে। গ্রামের অনেক উচ্চ ডিগ্রিধারী বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ পাশেই অকর্মনা ছেলেটি তার সামনে মটর সাইকেল শা শা করে চালিয়ে বলছে তোরা লেখাপড়া শিখে কি করবি। এই হচ্ছে এই প্রজম্মের নৈতিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়। আগামী দিনের তরুন প্রজম্মের ভবিষ্যৎ কি? সুধী মহলের কাছে প্রশ্ন রইল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top